সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৪৮। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
মহাপ্রজ্ঞার গৃহত্যাগ
এই করে করে নানি কাজি শেষমেশ গান, মানে ধর্মস্তোত্র লিখতে শুরু করলেন। নেওয়ারি ভাষা, যাকে ‘নেপাল ভাষাও (‘নেপালি ভাষা’ নয়, সংস্কৃত ঘেঁষা ওই ভাষার নাম ‘খস কুরা’) বলা হয়ে থাকে, ‘ললিতবিস্তার’ নামে সে ভাষায় লেখা বুদ্ধের এক জীবনী তাঁর হাতে এলো, মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেটা পড়ে ফেললেন। পড়ে ফেলেই একগুচ্ছ গান বেঁধে ফেললেন, নেপালি কিংবা নেপাল ভাষায় নয়, হিন্দিতে। সে গান তুমুল জনপ্রিয় হলো, প্রেম বাহাদুর ওরফে নানি কাজি বিখ্যাত হয়ে উঠলেন রাতারাতি। অতঃপর, ১৯২৪ সাল নাগাদ তিব্বতি বৌদ্ধ সাধক কিয়াংসে লামার সংস্পর্শে এসে তিনি বৌদ্ধ হয়ে উঠতে চাইলেন, এমনকি কিয়াংসে লামা যখন নেপাল থেকে তিব্বতের দিকে যেতে চাইছেন, ঘরসংসার একেবারে ছেড়ে তিনি তাঁর সঙ্গী হতেও চাইলেন। সেটা ঘটে উঠলো না, উল্টে লামা বললেন, কাঠমান্ডুতে নিজের ঘরে গৃহস্থধর্ম পালনের মধ্য দিয়েও ধর্মপালন হয়, তিব্বতে গিয়ে লামা হতে হয় না। কিন্তু ততক্ষণে নানি কাজির চোখে ও মনে ধর্মের ঘোর লেগেছে, বাড়িতে বা সংসারে থাকতে পাগল পাগল লাগে। অনেক পরে, ১৯৮৩ সালে লেখা নিজের আত্মজীবনীতে মহাপ্রজ্ঞা সে যন্ত্রণার কথা লিখছেন:
…কিন্তু আমার মন আর মানে না। গৃহত্যাগের ইচ্ছা এত তীব্র, মন শান্ত হয় না কিছুতেই। গাছের পাতার মতো সে মন নড়ছে তো নড়ছেই। আমার শরীর ঘরে আছে, মন ঘরে নেই, সে এ পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিবিক্তির মহাসংগীতে আমার মন ভরে উঠছিলো, আমার ঠোঁটেও সেই গানের কলি। ঘরে থাকলেই, গৃহলক্ষ্মীর(অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী) কথাগুলো তিরের মতো আমার দিকে ধেয়ে আসতো। বাবামায়ের কাছে গেলেও, তাঁরা আমার ওপর রেগে থাকতেন, কারণ আমার কাজ নেই, ঘরে অন্নসংস্থানও নেই। তাঁরা রাগে কাঁপতেন, মনে হতো যেন কুপিত এক পিশাচ কিম্বা ডাকিনী, আমাকে এক্ষুনি খেয়ে ফেলবে। তাঁদের ক্রুদ্ধ অশ্রু, তাঁদের কথা, ঢিলপাথরের মতো আমার মাথায় আছড়াতো। পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে গেলে তারা আমাকে আমার ধর্মভাব নিয়ে যা নয় তাই বলতো, ব্যাঙ্গবিদ্রুপ করতো, খারাপ খারাপ গালাগাল দিতো…টিনের বাক্স বাজাতো।…গোটা পৃথিবী যেন আমার গলা টিপে ধরে বাইরে ছুঁড়ে ফেলছে, মনে হতো। নিষ্ঠানন্দ বজ্রাচার্যের লেখা ললিতবিস্তার যত পড়ছি, তত প্রবল হচ্ছে সংসারত্যাগের ইচ্ছা। মনে হতো, ললিতবিস্তারের শীতল জলে সংসারত্যাগের তীব্র বাসনাকে ডুবিয়ে রাখি।
কিয়াংসে চলে গেছেন, নানি কাজি আর এক লামা কুশ্য রিম্পোচেকে ধরে পড়লেন, তিব্বতে যাবার জন্য। কুশ্যও রাজি হলেন না। নানি তার অনুগমন করলেন। পথে আরো দুই নেওয়ারি সঙ্গী জুটলো, যাঁরা তিব্বতি বলতে পারেন। তিব্বতের কিইরং এলাকার ফাকপা গুম্ফায় শিক্ষানবিশ নিংমাপা সাধু হিসেবে তাঁদের দীক্ষা হলো। দীক্ষার পর নানি কাজির নতুন নাম হলো মহাপ্রজ্ঞা। দ্রুত কাঠমান্ডুতে ফিরলেন তিন বন্ধুর দুজন, মহাপ্রজ্ঞা ও আরো একজন। সেখানে নাগার্জুন পাহাড়ের একটি নিংমাপা বিহারে তাঁদের আশ্রয় জুটলো। দল বড় হতে থাকলো, মহাপ্রজ্ঞা ও অন্য নতুন ভিক্ষুরা গুরু মানলেন বিখ্যাত তিব্বতি লামা শেরিং নরবুকে। শেরিং ও তরুণ শিক্ষানবিশ লামারা কাঠমান্ডুর পথে পথে ঘুরে ভিক্ষা চাইছেন, ধর্মপ্রচার করছেন, নেওয়ার সমাজে তাঁদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, এমতাবস্থায় তাঁরা রাজরোষে পড়লেন। কাঠমান্ডুর পুরোনো বজ্রাচার্যেরা জাতিতে বড়, রানা সরকারের কাছে অভিযোগ করলেন, মহাপ্রজ্ঞা আসলে প্রেম বাহাদুর, হিন্দু ও শ্রেষ্ঠ পরিবারের সন্তান, ধর্ম বদলে বৌদ্ধ হয়েছে। তিব্বতি ভিক্ষুর হাতের ছোঁয়া খাচ্ছেন বলে এমনিতেই রানারা মহাপ্রজ্ঞার নেওয়ারি দলের ওপর চটে ছিলেন, ভিক্ষাটিক্ষা নিষিদ্ধ করে শেরিং নরবু ও তাঁর দলবলকে নেপাল থেকে বের করে দেওয়া হলো।
(ক্রমশ)
