সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৪৬। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

মহাপ্রজ্ঞা, ও পাহাড়ের বৌদ্ধপন্থা

খুঁজলে, খুঁজতে থাকলে কিছু না কিছু পাওয়াই যায়। পাওয়া গেলো, নেপালে থেরাবাদী বৌদ্ধমত প্রচারের ইতিবৃত্ত নিয়ে সারা লেভিন ও ডেভিড এন গেলনারের লেখা। ‘বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্নিমাণ: বিংশ শতাব্দীর নেপালে থেরাবাদী আন্দোলন’(রিবিল্ডিং বুধিজম: থেরাবাদ মুভমেন্ট ইন টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি নেপাল) নামের এই বই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ২০০৫ সালে। বলে রাখা ভালো, দুই লেখকের অন্যতম ডেভিড গেলনার অক্সফোর্ডের নৃতত্ত্ব বিভাগের খ্যাতনামা অধ্যাপক, গত চল্লিশ বছর ধরে তিনি নেপালের ধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে বিরামহীন গবেষণা করে চলেছেন, বিশেষ, সে দেশের বৌদ্ধমতাবলম্বী ও দলিতদের নিয়ে তাঁর একাধিক লেখা বহুচর্চিত ও বহুপঠিত। সারা লেভিনও নৃতত্ত্বের অধ্যাপক, আমেরিকার মানুষ হলেও সারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছেন গবেষণার কাজে। সে সব কাজের লেখায়, লেখার গল্পে ঢুকবার সুযোগ নেই। শুধু বলতেই হয়, নেপালের বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রসঙ্গে গেলনার এবং লেভিন যা বলেছেন, বলছেন, তা শুনতে হবে, লিংউডের বলা গল্পের সঙ্গে সে বয়ান মিলুক না মিলুক।

নেপালের থেরাবাদপন্থী বৌদ্ধদের গল্পে যাবার আগে বলে নেওয়া ভালো, ভারতবর্ষ, তিব্বত, ভুটান, সিকিম এবং নেপাল বাংলাদেশ সমেত আজকের ভারতীয় উপমহাদেশের পার্বত্য এলাকায়(বার্মা বা মায়নামারের খানিকটা বাদ দিলে) যেখানে যা বৌদ্ধ ধর্ম মতের অনুসরণ ও চর্চা, প্রায় সবটাই মোটের ওপর বর্জ্রযান বা মহাযান, থেরাবাদ অর্থাৎ আদি হীনযান মতের সেখানে চল নেই। ফেলে আসা, ছুঁয়ে যাওয়া, ভালো করে না পড়া আরো নানান কথাগল্পের মতো, বর্জ্রযান এবং থেরাবাদের বিশদ গল্পেও ঢুকবো না, বৌদ্ধ ধর্মের সেকাল একাল নিয়ে প্রচুর বইপত্র গবেষণা ইত্যাদি বর্তমান, চাইলে খুঁজে নেওয়া যায়। এখনকার আলোচনায় যেটুকু প্রাসঙ্গিক, খুব সংক্ষেপে বলি। পুবে অরুণাচল ও ভুটান থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমে কাশ্মীর গিলগিট হুনজা অবধি বিস্তৃত যে পাহাড়শ্রেণীকে আমরা মূল হিমালয় বা গ্রেট হিমালয় বলে চিনি, সেটা টপকে ওপারে গেলে তিব্বত থুড়ি চীন, খুব গহন পশ্চিমে পামির মালভূমি হয়ে মধ্য এশিয়া ও য়ুরোপে যাবার বিভিন্ন পুরোনো স্থলপথ, খুব পূর্বে সিয়াম ওরফে থাইল্যান্ড, কম্বোজ(কাম্বোডিয়া বা কাম্পুচিয়া), ভিয়েতনাম, লাওদেশ ও চীনের ইউনান ইত্যাদি। দূর্গম, দূরধিগম্য, জটাজুটময় ও রহস্যকীর্ণ এই বিপুল পর্বতশৃঙ্খলের সমস্তটা ঠিকমতো মেপে ওঠা যায়নি, এখনো, অর্থাৎ গ্রহউপগ্রহশাসিত, গুগল বা নানান সামরিক ম্যাপে বসানো, সহজ, জলের মতো বুঝে ফেলা আজকের পৃথিবীতেও।

বৌদ্ধপন্থার জন্মকাল অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের জন্মেরও বহু আগে থেকে নানান জাতের নানান রকমের মানুষ পাহাড়ের মাথায়, খাঁজে বা ভাঁজে এসেছে, বসতি তৈরি করেছে, থেকেছে, যুদ্ধবিগ্রহ করেছে। মানুষ থাকলে মানুষের দেবতা অপদেবতারাও থাকেন, অর্থাৎ ধর্ম বা ধর্মমত তৈরি হয়, সেই সঙ্গে বিশ্বাস অবিশ্বাস, সময়ের সঙ্গে তারা বদলায়, বা বদলায় না। গাঙ্গেয় সমতলভূমিতে জন্মানো ও বেড়ে ওঠা বৌদ্ধ ধর্মমত ঠিক কী করে কী করে পাহাড়ের পর পাহাড় চড়ে, ডিঙিয়ে, হিমালয়ের গভীরে পৌঁছলো, এমন কী হিমালয় পেরিয়ে পৌঁছে গেলো তিব্বতে, মধ্য এশিয়ায়, চিন সিয়াম ও অন্যত্র, সে ইতিহাস কারুর জানা নেইl এমনিতেই এ মরপৃথিবীর যাবতীয় পুরোনো চলাচলের ওপর ক্রমাগত স্মৃতির ও সময়ের পলি পড়ে, পড়তেই থাকে। সে স্মৃতিতে ধর্মের মিশাল লাগলে মানুষের স্মৃতি ও চলাচল ঢেকে যায় অপার্থিব অলৌকিকে, মানুষের ইতিহাস মুছে দেবতা ও দেববর্গের ইতিবৃত্তমুখর পুরাণ তৈরি হয়, হতে থাকে। স্থান ও কালভেদে এই সাধারণ নিয়মের বিশেষ ব্যত্যয় হয় না, সুতরাং মানুষ বুদ্ধ কী করে ও কেন দেবতায় পরিণত হলেন, বুঝে নেওয়া যায়।

কথাটা হলো, বুদ্ধের আদি শিষ্যমন্ডলি যখন ঘরসংসার ভোগসুখ ছেড়ে, প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে, চেনা ও অচেনা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছেন, সঙ্ঘ ও মঠ তৈরি হচ্ছে, পরবর্তীতে বহুক্ষেত্রেই শাসন ও ক্ষমতা মিশে যাচ্ছে সঙ্ঘের শারীরি ও ধর্মাদর্শ/ধর্মাচরণের অবয়বে, সেই শাসন ও ক্ষমতার পিছন পিছন বুদ্ধের শিক্ষা ও চিন্তার বাইরের অনেক কিছু অনায়াসে ঢুকে পড়ছে আদি ধর্মের চৌহদ্দিতে। ফলে বুদ্ধ আর আগের মতো, আগের চেহারায় থাকছেন না, ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মাচরণের পদ্ধতি বদলাচ্ছে, কোথাও কোথাও সে বদল এতটাই তীব্র ও সুদূরপ্রসারি, পুরনো ধর্মটাই আর থাকছে না। বুদ্ধজন্মের পর থেকে বৌদ্ধ ধর্মমত পৃথিবীর যে যে প্রান্তে পৌঁছেছে, সেই সব জায়গার স্ব স্ব প্রাক-বুদ্ধ ধর্মমত, কথা, বিশ্বাস, অবিরলভাবে আদি বুদ্ধচিন্তার কৃশ ও সরল ধাঁচটিকে ধ্বস্ত করেছে। তিব্বতি মালভূমি সহ হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের যে নতুন ধরণ তৈরি হয়ে উঠলো, তাতে প্রাক-বৌদ্ধ বং ধর্ম যেমন জায়গা পেলো, তেমনই ভারতীয় সমতলভূমি থেকে আসা শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মমত,  মূলত তন্ত্রসাধনার নানান অনুষ্ঠান, আচার ও সূত্র।

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply