সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৪৫। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
মহাপ্রজ্ঞার খোঁজে
যে কারণেই হোক, মহাপ্রজ্ঞা লিংউডের ওপর প্রসন্ন ছিলেন না, এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর লাগাতার ষড়যন্ত্র ইত্যাদির ফলে, ধর্মোদয় বিহারে নতুন এক ওপরওয়ালা ভিক্ষুর আগমন হয়, যিনি লিংউড সাহেবের পাখনা ছাটনার্থে দ্রুত ও কড়া ব্যবস্থাদি গ্রহণ করেন। কালিম্পং এ এসে অবধি লিংউড যে পরিমাণ উড়ছিলেন(সদর্থে, নানান ভালো ভালো উদ্যোগ নিচ্ছিলেন), তাতে অন্য অনেকের মতো, মহাপ্রজ্ঞারও চোখ টাটায়, এবং তিনি বিহার কর্তৃপক্ষের কাছে জবরদস্ত চিঠিচাপাটি পাঠাতেই থাকেন, যার মূল কথা, সায়েব ভিক্ষু এসে এটা ওটা করে এবং বিস্তর ছেলেছোকরা জুটিয়ে বিহারের শান্তি ও পবিত্রতা নষ্ট করছেন, এমন চলতে থাকলে সৃষ্টি রসাতলে যেতে বাধ্য, সুতরাং, অতএব, প্রভৃতি। যাই হোক, অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে লিংউড-সঙ্ঘরক্ষিতাকে বিহার ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়। ইতিমধ্যে আরো দুই সাহেব এসে বিহারে জুটেছিলেন, তাদের নিয়ে লিংউড বিহারের বাইরে থেকেই নানাবিধ কাজকর্ম চালাতে থাকলেন। সে সব কথায় ফেরা যাবে।
আপাতত বলা দরকার, যা যা বলছি,শুনছি, সবটাই লিংউড উবাচ। গোড়াতেই বলা হয়েছে, অন্য যে গুণই থাক, নির্ভেজাল সত্যবাদিতার জন্য অন্তত এই সাহেব ভিক্ষু প্রসিদ্ধ ছিলেন না। সুতরাং, কোথাও না কোথাও বহু কূট প্রশ্ন কুটকুট কামড়ায়, এক আগমার্কা গোঁড়া ভক্ত না হলে তা এড়ানো যায় না। প্রথম প্রশ্ন, লোকজনকে নিয়ে লিংউড-সঙ্ঘরক্ষিতা যা যা বলেছেন, তার কতটা সত্যি, কতটাই বা বানানো? আলবৎ আমরা গল্পই শুনছি, শুনতে চাইছি, তবে কিনা গল্পের মধ্যেও ইতিহাস ঢুকে থাকে, এবং ঐতিহাসিক চরিত্রদের নিয়ে কতদূর অবধি গুলগল্প করা যায়? যাঁদের গল্প লিংউড করেছেন, তাঁদের কেউই ধরাধামে নেই, দীর্ঘ জীবনের লীলাখেলা(পরে, পরে)সাঙ্গ করে বছর কয়েক আগে তিনি নিজেও অন্যত্র গমন করেছেন। তা হলেও, গল্প বা ইতিহাস, বা ইতিহাসের গল্প, এরা কখনোই পুরোটা মরে না, চাইলে, খুঁজলে, খুঁড়লে, কিছু না কিছু ঠিক পাওয়া যায়। লিংউড ফিচলেমো করতে পারেন, প্রবৃত্তিপ্ররোচিত হয়ে অপছন্দের লোকজন সম্পর্কে চারটি বাজে কথাও বলতে পারেন। কথাটা হলো, আমরা কি সে বয়ানকে দিব্য গসপেল জ্ঞানে মেনে নেবো, নাকি আরেকটু খুঁড়বো, খোঁজখবর করবো? লিংউড সাহেবকে আমরা যে পাকড়েছি সে তো ধর্মগুরু হিসেবে নয়, বরং এইজন্যে যে তাঁর স্মৃতিকথন থেকে পুরোনো না থাকা কালিম্পং-এর গল্প বেরিয়ে আসছে অবিরল, গল্পের নিয়মে এবং টানে সে গল্প অন্য অনেক গল্প এনে জড়ো করছে, একের পিঠে দুই, তিন, পাঁচ দশ হাজার লক্ষ। উপেক্ষা করি, সে সাধ্য কোথায়?
সুতরাং, অতএব, লিংউড-কথিত গল্পের সূত্র ধরে আমরা আরো একটু এদিক ওদিক যাই, তাঁর বয়া করা চরিত্রবর্ণনা একটু অন্যভাবে, অন্যদের বয়ানে, উল্টেপাল্টে দেখি। যাঁদের কথা লিংউডের লেখায় এসেছে, সবাই বিখ্যাত ছিলেন না, যেমন ত্রিলোকধারী। বিখ্যাত না হলে সচরাচর খুঁজে পাওয়া যায় না, ত্রিলোকধারীকেও গেলো না। মহাপ্রজ্ঞাকে খুঁজতে গিয়ে চমকে উঠতে হলো। লিংউড যাকে কুচুটে ও লম্পট কোলাব্যাং(কোলাব্যাংরা লম্পট কুচুটে ইত্যাদি হতে পারে কি না সে প্রশ্ন অমীমাংসিত থাকুক) বানিয়ে ছেড়েছেন, সেই মহাপ্রজ্ঞার আসল নাম প্রেম বাহাদুর শ্রেষ্ঠা, কাঠমান্ডুর বাসিন্দা। উইকিপিডিয়ায় তাঁকে নিয়ে যে সুলিখিত ও তথ্যসম্বৃদ্ধ পৃষ্ঠাটি আছে, তার শিরোনাম, ‘বৌদ্ধ ঋষি মহাপ্রজ্ঞা’। পৃষ্ঠায় তাঁর যে ছবিটা দেওয়া আছে, তা দেখতে খানিক হো চি মিন খানিক সুন ইয়াত সেন গোছের, রিমলেস চশমা একটা আছে বটে, সৌম্যকান্তি বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল মুখে বসানো সে চশমার ভিতরের চোখদুটি আশ্চর্য বাঙময়, যেন তারা অনেক দূর অবধি দেখতে পায়। ছবিটা টানতে থাকলো, বলতে থাকলো লিংউডের কেচ্ছাক্লিন্ন ও অসূয়াগ্রস্ত বয়ানের চৌহদ্দির বাইরে গিয়ে ছবির পিছনের লোকটাকে খুঁজতে।
(ক্রমশ)
