সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৪৪। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

ত্রিলোকধারী, মহাপ্রজ্ঞা ও অন্যরা  ২

লিংউড-সঙ্ঘরক্ষিতার লেখায়, বিশেষ করে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখোমুখি’ বইটায় বিচিত্র সব চরিত্রের মিছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, সেসব চরিত্র যেভাবে, যে কায়দায় চিত্রিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ধর্মগুরু সঙ্ঘরক্ষিতা বেমালুম উধাও হয়ে যান, সে জায়গায় এসে দাঁড়ান ২৫ বছরের ফিচেল তরুণ লিংউড। ফিচেল, কেচ্ছাপ্রিয় এবং হয়তো বা খানিক অসূয়াপরায়ণ, কুচুটেও। ধর্মোদয় বিহারে থাকাকালীন, এবং তার আগেপরেও, যে মানুষদের সংশ্রবে সে তরুণ এসেছে, তাদের অনেককেই সে ভিক্ষুসুলভ স্থৈর্য সহ নির্মল দয়াদৃষ্টিতে দেখেনি, বরং নিষ্ঠুর ব্যাঙ্গ করেছে তাদের নিয়ে, যাকে বলে ব্যান্টারিং। উদাহরণ,  ত্রিলোকধারী, এবং ধর্মোদয় বিহারের আর এক চরিত্র, যাকে বিহারের অন্যদের দেখাদেখি লিংউডও ডাকছেন ‘মহাপ্রজ্ঞা’ বলে। ত্রিলোকধারীর কথা এসেছে, মহাপ্রজ্ঞার গল্প শোনা যাক।

ধর্মোদয় বিহারের অন্যতম প্রকোষ্ঠ, বিহারের পাঠাগার ও গ্রন্থাগার। সেখানে মোট শ’চারেক বইয়ের মধ্যে কিছু ধর্মগ্রন্থ ইত্যাদি ছিলো বটে, তবে বেশিটাই ‘সস্তা’ হিন্দী নভেল, রগরগে রোমান্স বা প্রেমের গল্পটল্প। খোলা থাকতো কূল্যে ঘণ্টা দুই, সন্ধের দিকটায়। দিনপিছু গড়ে বড়জোর দশ-বারো জন ঢুকতেন, প্রধানত কমবয়সী তরুণী মহিলা ও কিশোরীরা, নভেল নিতে, এবং এক আধজন বয়স্ক পুরুষ, খবরের কাগজ দেখতে। হলে কি হয়, গ্রন্থাগার যখন, একজন গ্রন্থাগারিকও ছিলেন। কি করতেন তিনি? লিংউডের জবানিতেই শোনা যাক:

দরজা দিয়ে ঢুকে একটা ছোটমতো টেবিল, তার পিছনে গ্রন্থাগারিক মশাই বসে থাকতেন।…বইপত্র যা আসতো যেতো, গম্ভীরভাবে তিনি সব লিখে রাখতেন। লিখবার সময়, একটা রিমলেস চশমা চোখে দিতেন, বড় কায়দায় খাতার ওপর কলম নামতোউঠতো, চশমার ফাঁক দিয়ে মহিলা পাঠকদের দিকে ‘পিতৃবৎ’ জুলজুল নজর ধাবিত হতো। বলা বাহুল্য, গ্রন্থাগারিক মশাই জাতিতে নেওয়ার।…আমার এবং কাশ্যপজীর সঙ্গে যথোচিত বিনয়ী ব্যবহার করতেন, তবে কাশ্যপজী চলে যাবার পর এমন ভাব করতেন যেন আমাকে এড়াতে পারলে বেঁচে যান…বয়স এই চল্লিশ মতো, মাথা জোড়া মস্ত টাক, কুঁতকুঁতে ছোট ছোট জ্বলজ্বলে চোখ, সেই সঙ্গে অবিকল ফাঁদের হাঁ-মুখের মতো চেরা একটা মুখ, সব মিলিয়ে হুবহু আস্ত একটা কোলাব্যাং। উঠে দাঁড়াতেন যখন, ল্যাগবেগে কাঠির মতো পা, বিপুল ভুঁড়ি ও সরু সরু নেপালি ব্রিচেসে তাঁকে আরো ব্যাংব্যাং দেখাতো। কথা বলতেন যখন, গলার ভিতর থেকে চাপা, কর্কশ গ্যাঙর গ্যাঙ আওয়াজ বেরুতো…

প্রথমে ভালো করে না বুঝলেও, ক্রমে গ্রন্থাগারিক মশাইয়ের ইতিবৃত্তান্ত লিংউডের গোচরে আসে। যানা যায়, পূর্বাশ্রমে তিনি প্রকৃতই এক বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন, যাঁকে মহাপ্রজ্ঞা নামে ডাকা হতো। নেপালের যাবতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য, বহু ভাষাবিদ, সুপন্ডিত ও শ্রদ্ধেয় মহাপ্রজ্ঞা নেপালে প্রচলিত থেরাবাদ থেকে  বর্জ্রযানের আবর্জনা দূর করতে চেষ্টিত ছিলেন। নেপালের কুৎসিত জাতিভেদপ্রথার বিরুদ্ধেও তিনি লড়াই চালান, যে কারণে তাঁকে রাজরোষে পড়তে হয়, প্রধানমন্ত্রী বা রাণার আদেশে চাবুকও খেতে হয়। ধর্মোদয় বিহারের উদ্বোধন উপলক্ষে তিনি কালিম্পং আসেন, এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন, জানলার পাশে যে বিছানায় লিংউড শুতেন, সেখানেই তাঁকে রাখা হয়। অতঃপর, এবং:

নেওয়ারিরা তাঁর দেখাশুনো করতো, বিশেষ করে নেওয়ারি মহিলারা। তাদের মধ্যে একজন, এক তরুণী বিধবা একটু বেশিই নজর রাখতো।প্রতিদিন সে আসতো, অসুস্থ অতিথির যত্নআত্তি সেবাশুশ্রূষা করতে, বিছানার পাশটিতে বসে থাকতো, সাধ্যমতো চেষ্টা করতো যাতে মহাপ্রজ্ঞা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই চলছিলো, হঠাৎ একদিন একদল নেওয়ারি অসুস্থ ভিক্ষুর সঙ্গে দেখা করতে এলো…বিধিমতো জুতোটুতো খুলে শুধু মোজা পরে পা টিপে টিপে তাঁরা ওপরে উঠলো(ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিন্দুমাত্র আওয়াজ ওপরের ঘরে পৌঁছয় না)…ঘরের দরজা খুলেই তারা দেখে কি, মহাপ্রজ্ঞা ও সেই বিধবা আলিঙ্গনাবদ্ধ, সে আলিঙ্গনে থেরাবাদের চেয়ে অনেক বেশি করে ছিলো বিশুদ্ধ বর্জ্রযান।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *