সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৪২। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

পা থেকে পাহাড়, মানুষ
কালিম্পংয়ে এসে লিংউড শুধু পা দেখছিলেন, বলাটা অন্যায় হবে। তিনি পাহাড়ও দেখতেন। ধর্মোদয় বিহারের উল্টোদিকে স্তরে স্তরে বিন্যস্ত হিমালয়, তার শীর্ষে কাঞ্চনজঙ্ঘা। বিহারের যে ঘরে লিংউড-সঙ্ঘরক্ষিতার ঠাঁই হলো, তার জানলা থেকে অবারিত হিমালয়ের নিসর্গ, পাহাড়ের ভাঁজে মানুষের বানানো কালিম্পং। রেইনবো রোড থেকে আরো দু এক টুকরো তুলে দেওয়া যায়। লিংউডের লেখায় কালিম্পংয়ের যে ছবি ধরা পড়ে, প্রথমে ধর্মোদয় বিহার, পরে হারমিটেজ বলে আর একটা বাড়ি থেকে যে নিসর্গ তিনি নিয়মিত দেখতেন, আশির দশকের মাঝামাঝি অবধি যার কিছুটা কিছুটা আমিও দেখেছি, আজকের কালিম্পংয়ের চৌহদ্দি থেকে সে ছবি সে নিসর্গ মোটামুটি বিলুপ্ত, রিংকিংপং রোড বা আপার কার্ট রোডের হাতে গোনা কয়েকটা বাড়ি বাদ দিলে, আদিগন্তবিস্তৃত যে দৃশ্যকে চলতি কথায় প্যানোরামা বলা হয়, শহরের কোন কোণা থেকেই তা আর দেখা যায় না। লিংউডের নিসর্গবর্ণনাকে সে কারণে দলিল হিসেবে দেখা যায়, উচিত:
এবং, সে কী রং! শুধু এহেন বর্ণবিন্যাসের জন্যই কালিম্পং অন্য জগত হয়ে ওঠে। পাহাড়ের নীল ও গাঢ় গোলাপি থেকে শুরু করে নেপালি মেয়েদের চুলে লাল এবং হলদে ফুল, সবটাই অপার্থিব রকম ঝকঝকে, ঘন, অবিকল প্রি-রাফালাইট ছবি। মাঝে মাঝে রঙগুলো এতটাই উজ্জ্বল হয়ে ঝিকিয়ে উঠতো, যেখানে যা আছে তার সব কিছুকেই মনে হতো যেন রত্ন দিয়ে তৈরি। এবং, যখন এইসব ঘটছে, সেই পুরো সময়টায়, শহরের কলহাস্য ও সংগীতের অনেক ওপরে, রঙ এবং জীবনেরও ওপরে, এমনকি প্রকৃতির শান্ত স্থৈর্য ও সভ্যতার নিরাপত্তার ওপরেও—সবকিছু, সবকিছুর ওপরে—ভেসে থাকতো তুষাররাজ্য।…পদপ্রান্তে উপত্যকার, মাথার ওপরে আকাশের নীল নিয়ে ঝকঝকে তুষারশৃঙ্গরাজি ছড়িয়ে আছে দিগন্তের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে…
…সকালবেলাটা সবচাইতে সুন্দর। ভোর হবার আগেই জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখতাম গোধূলির আবছা নীলের মধ্যে প্রেতমূর্তির মত বরফের পাহাড়, ঠিক বরফও নয় আবার, বরঞ্চ শক্ত তুষার। তারপর, সূর্য যেই উঠতে শুরু করতো, পাহাড়ের নীল চুড়োর মাথাটা ঝলসে উঠতো তীব্র লালচে-গোলাপি রঙে, কয়েক মিনিটের মধ্যে সে রং ছড়িয়ে পড়তো পর্বতশৃঙ্গের সমস্তটায়। পুরো গিরিশ্রেণীকে মনে হতো লালচে-গোলাপি আগুনের গনগনে পিণ্ড, আকাশের আবছা নীলের মধ্যে জ্বলে উঠছে। লালচে-গোলাপি বদলে গিয়ে আরো টকটকে গোলাপি-লাল, সেখান থেকে অ্যাপ্রিকট ফলের সোনালি-হলুদ, তারপর, বিশুদ্ধতম, উজ্জ্বলতম সোনা। শেষে, সূর্য সরিয়ে নিত দিগন্ত থেকে যত ধোঁয়াটে আবছায়া, সোনা বদলে যেত গলানো রুপোয়, রুপো থেকে ঝলসে ওঠা সাদা।
হিমালয়ের পার্বত্য নিসর্গ লিংউড-সঙ্ঘরক্ষিতাকে মুগ্ধ করেছে আজীবন। সম্ভবত সে কারণেই, ১৯৫০-এ কালিম্পং এসে, টানা ১৪ বছর তিনি সেখানে থেকে যান। ‘সম্ভবত’ বলার কারণ, নিসর্গে যতটা, লিংউড ততটাই আগ্রহী ছিলেন মানুষে, হয়তো বা তারো বেশি। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখোমুখি’ বইতে কালিম্পঙের বিভিন্ন নামী অনামী ব্যক্তিত্ব প্রসঙ্গে অনেক কিছু বলা আছে, আছে অনেকের অনুপুঙ্খ রুপ বা চেহারাবর্ণনা, ছেলেদের বেশি, মেয়েদের কম। বর্ণনা এত তীক্ষ্ণ ও জীবন্ত, মনে হয় দিব্যি দেখা যাচ্ছে মানুষগুলোকে, বোঝা যাচ্ছে। বিখ্যাতদের কথা আলাদা করে বলতে হবে। ভিক্ষুজীবনের সূত্রে লিংউডের সংস্পর্শে আসা কয়েকজন সাধারণ মানুষের গল্প বলি, যেমন ত্রিলোকধারী, বা ত্রিলোকধারী প্রসাদ সিং।
(ক্রমশ)