সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৪১। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

লিংউড ওরফে সঙ্ঘরক্ষিতা : পা

কালিম্পং পাহাড় সহ সমতলের ডুয়ার্স এলাকায় সাহেবদখল কায়েম হবার গল্পে পেডং এর বিশেষ গুরুত্ব ছিলো। এমন কী দলিলহীন সায়েবপূর্ব ইতিহাসেও পেডং অঞ্চলের উল্লেখ, কি ব্রিটিশদের সঙ্গে ভুটানের যুদ্ধ, কি লেপচা-গোর্খা লড়াই, পেডং জায়গাটাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। উঁহু, কিন্তু এখন না, কোন কথা বলতে গিয়ে কোন গল্পে ঢুকে পড়ছি, সে বৃত্তান্ত পরে। হচ্ছিলো লিংউডের কথা। গুটি কেটে প্রজাপতি(প্রজাপতি নিয়েও গল্প আছে, পরে বলা যাবে) হয়ে, অর্থাৎ যথাবিধি দীক্ষা নিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে তরুণ ইংরেজ সাহেব লিংউড কালিম্পং এলেন। ধর্মোদয় বিহারের খরচখরচা সেসময় চলতো কালিম্পং নিবাসী নেওয়ারদের পয়সায়। পুরোসময়ের ভিক্ষু হিসেবে যাঁরা বিহারে থাকতেন, ধনী নেওয়ারি বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করতেন। লিংউড ও তদগুরু কাশ্যপজী( স্বনামধন্য, ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ, প্রধানত যাঁর উদ্যোগে চল্লিশের দশকে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি ভাষা ও বৌদ্ধ দর্শন চর্চার সূচনা) কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গেলেন, লোকের বাড়িতে গিয়ে পাত পেড়ে খাওয়া বিষয়টা সুবিধার হচ্ছে না, অন্য স্থায়ী ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে। ফেলতে তো হবে, কিন্তু কী করে? লিংউডের পকেট ঢুঢু, কাশ্যপও তথৈবচ। এদিকে বিহারে লোকের আনাগোনা বাড়ছে, মানে মোট খাইখরচাও। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে লিংউড ঠিক করে ফেললেন, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাজ হচ্ছে চিরবাস পরিধান করে, নতমস্তকে, মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দেওয়া, মানে ভিক্ষায় বেরুনো। দুজন বৌদ্ধ ভিক্ষু গেরুয়া-কমলা বস্ত্র পরে ভিক্ষায় বেরুচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে একজন পুরোপুরি সাদা চামড়ার সাহেব, কালিম্পংয়ে এত মানুষের বাস, বহু বৌদ্ধও আছেন, সবাই কী আর তাঁদের প্রত্যাখ্যান করবেন? কাশ্যপ সোৎসাহে রাজি হলেন, অতএব যেমন ভাবা তেমন কাজ, দুজনে মিলে প্রতি সকালে কালিম্পংয়ের বড় রাস্তা ও বাজার এলাকায় ভিক্ষায় বেরুতে থাকলেন।

ভিক্ষাবৃত্তি বেশিদিন চললো না, কাশ্যপ উত্তর ভারতে ফিরে গেলেন, ভিক্ষা করতে করতে তাঁর সঙ্গী ক্লান্ত হয়ে পড়লেন, কিম্বা অন্য ব্যবস্থা হয়ে গেলো। সে যাক। বিধি, ভিক্ষায় বেরুতে হলে, ভিক্ষুরা অবনতমস্তক হবেন, মানে চোখ নামিয়ে পথ হাঁটবেন। কাশ্যপ চলে যাবার পর লিংউড-সঙ্ঘরক্ষিতা সেইমতো একাই পথে নামছেন, মাথা নামানো, চোখ নিচু, হাতে ভিক্ষাপাত্র। চোখ নিচু, তবে বন্ধ তো নয়। আশপাশের বাজারদোকান লোকজন, মন ভালো করা পাহাড়ি প্রকৃতি, ভিক্ষায় বেরিয়ে এসব অবশ্য কিছুই দেখা যাবে না, লিংউড দেখতে পাবেন কাতারে কাতারে, রাশিরাশি, ঠাসাঠাসি, পা, শুধু পা:

দেখতে পাচ্ছিলাম শুধু পা। কতোগুলো পা বেঁটে মোটা, রং খুব পাতলা চায়ের মতো, গুছিগুলো কী বড় বড়, একেবারে প্রায় ফুটবলের মতো। জানতাম, পাগুলো নেপালি কুলিদের। দিনের যে কোন সময়ে এদের দেখা যাবে, ছুঁচোলো বাঁশের ঝুড়িতে চাপানো বিশাল বোঝার ভারে ন্যুব্জ। বাকি কিছু পা কালো, লাঠিমতোন, হাড্ডিসার হাঁটুর ঠিক ওপরে ধুতি পতপত করছে। কিছু পা খুব চাপা যোধপুর ব্রিচেসে মোড়া, কিছুর গায়ে পশ্চিমি কেতার ট্রাউজার্স। আর কিছু পা অবশ্য ভদ্রগোছের, কালো, বাদামি বা নীল স্কার্ট কিম্বা খয়েরি আলখাল্লার আড়ালে লুকোনো। মানুষের পায়ের পিছনে পশুদের পা, খচ্চরের, মেটে বাদামি। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে এমন হুড়মুড়িয়ে পাগুলো চলে যেত, হলদে ধুলোর ঝড় উঠতো, রাস্তার ধারে কোনক্রমে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো।কিছু পা যাচ্ছে আমি যেদিকে যাচ্ছি সেদিকে, কিছু উল্টোদিকে। কিছু যেত হড়বড় করে, তাড়াতাড়ি। কিছু যেত আস্তে আস্তে, থেমে থেমে। আমি হাঁটতাম ভিক্ষুদের যেভাবে হাঁটা উচিত…

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *