সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৩৭। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

থাকা না থাকা: মঞ্জুলা ও মনিলা

………………………………………………….

এক

মনিলার নাম শোনা ছিলো। আমাদের পাহাড়ি শহরগুলোয় কলকাতার নানান বনেদী ওরফে  অভিজাত পরিবারের বহুকালের বাস, শুনেছিলাম, বা ধরে নিয়েছিলাম, তিনিও সেরকম কেউ। ওই পর্যন্তই। নামের পিছনে রক্তমাংসের যে মানুষটা থাকে, সে যে কোথাও জন্মায়, আসে, গাছের বা ঘাসের মতো বেড়ে ওঠে, দেখতে দেখতে বড় হয়, বুড়ো হয়, একসময় চলেও যায় আবার, সেসব নিয়ে কে অত ভাবে! অথচ মানুষের সঙ্গে তার চারপাশের গাছপালা পাখিপতঙ্গ অন্য মানুষজন এবং যেখানে সে থাকে, যেটা তার বাড়ি( সবার অবশ্য বাড়িটাড়ি থাকে না), এসবের নিরন্তর সম্পর্ক হয়, হতে থাকে। কালক্রমে সে সম্পর্কে ভালোবাসার মিশাল লাগে, মায়ার আস্তর পড়ে, স্মৃতি তৈরি হয়। এই আখ্যানের পাঠকমাত্রেই জানেন, স্মৃতি অর্থে নিসর্গও, যা আছে, যা ছিলো অথচ এখন নেই, তার মাঠপ্রান্তর, দেয়ালদরজা, কোনাঘুপচি মনে করা। কালিম্পং-এর যে গল্প মনিলা বলেছেন, সেখানে স্মৃতি এবং নিসর্গ বুড়ো পাথর কি গাছের গুড়িতে জমা প্রাচীন শ্যাওলার মতো, জমে আছে। অনেক বাড়ির, মানুষের, সময়ের, গল্প বলেছেন মনিলা, সব গল্প এখানে বলা যাবে না, বলার দরকারও নেই। খুঁজে দেখলাম, মনিলার বই বেরুনোর অনেক আগেই, সঙ্ঘরক্ষিতা নাম্নী এক য়ুরোপীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু সে সব গল্পের অনেকগুলোই বলে ফেলেছেন। গল্পের কেন্দ্রে বিখ্যাত ও বিচিত্র সব মানুষ ভিড় করে আছেন, তাঁদের নিয়ে মনিলা, সঙ্ঘরক্ষিতা ও অন্যান্যদের বলা গল্প আমরা শুনবো নিশ্চয়। তাঁর আগে, মনিলার নিজের গল্প শোনা যাক।

মনিলার গল্প, মানে মঞ্জুলারও। মঞ্জুলা, মনিলার দিদি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে, কলকাতার আকাশে হানা দিচ্ছে জাপানি বোমারু বিমান, উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে নিজেদের পারিবারিক বাড়িতে বিষাক্ত ক্ষয়রোগে ভুগে যখন মারা যাচ্ছেন মঞ্জুলা, তাঁর বয়স মাত্র পনেরো, মনিলার তিন। দিদির কথা মনিলার সেভাবে মনে ছিলো না, থাকার কথা নয়। তাঁর গল্পে দিদির মৃত্যু এসেছে উপলক্ষ্য হয়ে, সে ঘটনা না ঘটলে হাতিবাগানের মিত্র পরিবার কালিম্পং পাহাড়ের মাথায় ডেরা বাঁধতেন কিনা সন্দেহ। এবং, কালিম্পংবাস শুরু যদি না হতো, নতুন মঞ্জুলা, অর্থাৎ মনিলাদের কালিম্পং-এর বাড়িও তৈরি হতো না।

বছর কয়েক আগে, ‘আনফরগেটেবল কালিম্পং’ যখন প্রকাশিত হচ্ছে, স্থানীয় একটি চ্যানেল মনিলার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করে। সে সাক্ষাৎকার এখনো অবধি ইউটিউব অঞ্চলে জমা আছে, চাইলে দেখা যায়। অর্ধেক নেপালি, অর্ধেক ইংরিজিতে, মনিলা গত শতাব্দীর চতুর্থ ও পঞ্চম দশকের, অর্থাৎ, সায়েবি কালিম্পং-এর সঙ্গে এখনকার কালিম্পং-এর তুলনা করছেন। সম্ভবত ক্যামেরাটা এক জায়গাতেই বসানো ছিলো, বিশেষ কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। শুধু, নেহাৎই আটপৌরে ঘরোয়া পোশাক পরা বয়স্ক এক মহিলা তাঁর সামনের টেবিলটায় রাখা বিবর্ণ সাদাকালো ছবি তুলে তুলে ধরছিলেন, এবং না থাকা মানুষ, জায়গা, ও সময়ের কথা বলছিলেন।  তাঁর বইটায় এইসব ছবিগুলোই দেওয়া আছে, মা বাবা দিদির সঙ্গে, বা ময়না নামক আয়ার কোলে শিশু মনিলা, একটু বড় বয়সে টাট্টু ঘোড়ার পিঠে, আরো একটু বড় হয়ে গাড়ির মধ্যে, উচ্ছল কিশোরী মনিলা। স্মৃতিভারাতুর ও বয়:ক্লান্ত যে মহিলার মুখ দেখা যাচ্ছিলো পর্দায়, তাঁর সঙ্গে সে কিশোরীর বিন্দুমাত্র মিল নেই। লালচে বাদামি হয়ে আসা একটা আবছা, ঝাপসা ছবি বারবার উঠে আসছিলো, ভিক্টোরিয় শৈলীতে তৈরি দোতলা বাড়ি, তার মাথায় একাধিক চিমনি। প্রায় মন্ত্রোচ্চারণের ভঙ্গিতে, মনিলা বলে যাচ্ছিলেন, মঞ্জুলা, মঞ্জুলা, মঞ্জুলা।

সাক্ষাৎকারে, তাঁর বইয়ে, বারবার, ঘুরেফিরে, মঞ্জুলার কথা। কি করে তাঁর বাবা আপার কার্ট রোড থেকে তিস্তার দিকে নামা পোড়ো জঙ্গুলে পাহাড়ি ঢাল পরিষ্কার করে সেখানে এমন এক স্বপ্নের বাড়ি বানিয়েছিলেন, যা দেখলে সায়েবদেরও তাক লেগে যেতো। তার দরজাজানলা সব কাঁচের, সামনে ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া জাপানি বাগান, ফোয়ারা ও মর্মরমূর্তিতে শোভিত সে সুরম্য বাগানে নেই এমন গাছ ছিলো না। এবং, বাড়ির প্রতি ঘর থেকে দৃশ্যমান, গাছে ঢাকা পর্বততরঙ্গ, পাহাড় যেখানে আকাশে মিশছে, সেই আশ্চর্য মোহানায়, অভ্রংলিহ ও ঝকঝকে সাদা, কাঞ্চনজঙ্ঘা।

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *