সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৩৬। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

কালিম্পং-এর নানা বাড়ি,  নানান লোক, বহু গল্প

 ………………………………………………………….

গ্রাহাম হোম, অর্থাৎ দেয়লোর পথ থেকে নেমে ফিরে আসছি শহরে। তিস্তা থেকে শহরে ওঠার চড়াই পথ, ওদিকে আলগাড়া পেডং যাবার রাস্তা, এগুলো কালিম্পং-এর পুরোনো এলাকা, বাজার ও বাজার লাগোয়া মিশন অঞ্চল তো বটেই। সে তুলনায়, বাজার থেকে দূরপিন বা দূরবীন পাহাড় যাবার যে পথটা গিরিশিরার কাঁধ ঘেঁষে ওপরে উঠছে, সেই পথ ঘিরে বসতি তৈরি হয়েছে বেশ পরে। দূরবীন যাবার মূল পথ, রিংকিংপং রাস্তা পাহাড়ের যে ঢালে সেটা খাড়া নেমে যাচ্ছে রিল্লি বা রেল্লি নদীর উপত্যকায়। পাহাড়ের অন্য, মানে পাহাড়ের বাঁ ঢাল নামছে তিস্তায়। এই ঢালে রিংকিংপং, অন্য ঢালে আপার কার্ট রোড। পাহাড়ের দুই ঢালের মাঝামাঝি, কিম্বা ঢালের ওপরেই এখনো বেশ কিছু পুরোনো বাড়ি বেঁচে আছে, তাদের কোন কোনটার বয়স একশো বছরেরও বেশি, কোনটা কিছু কম। অনেক বাড়ি ভাঙা পড়েছে, যেমন হয়, হয়ে থাকে। গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে কালিম্পং যাতায়াত চলছে, চোখের সামনেই দেখলাম জনবিরল ও আধা জঙ্গুলে রিংকিংপং পথের দু-ধারেই আখাম্বা বাড়ি গজালো, হোটেল, লজ, রিসর্ট এইসব, লোকের থাকবার ফ্ল্যাটবাড়ি। এই পথের অনেকটাই সেনাদখলে, সে জায়গাটা বাদ দিলে, বা দূরবীন পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছনোর আগের যে গিরিশিরা বা রিজে অধুনা-ভূতখ্যাত হানাবাড়ি মর্গান হাউজ, সেটাকে ছেড়ে রাখলে, বাকি পুরো পাহাড় বড় বড় বাড়ির জঙ্গলে ঢেকে গিয়েছে। তাদের খাঁজেখোজে এক আধটা পুরোনো বাড়ি আছে বটে, কিন্তু সেগুলোকে খুঁজে বার করা দুষ্কর।

সে তুলনায়, পাহাড়ের উল্টো দিকের ঢালে, মানে আপার কার্ট রোডে, আতিশি(অতীশ দীপঙ্করের নামে সম্ভবত) পথে, চিত্রভানু হয়ে পাইনউড নার্সারীর দিকে যাওয়া সরু পথে, বা বলা ভালো, কার্ট রোড থেকে ডান ও বাঁ দিকে উঠেনেমে যাওয়া অসংখ্য সরু সরু পথের বিপন্ন আক্রান্ত নির্জনে পুরোনো বাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। সময়ভ্রমণে বেরুলে, এই সব পথ ধরে যেতে হয়, বাড়িগুলোকে খুঁজে খুঁজে বার করতে, বাড়ির গল্প পড়তেশুনতে হয়। কখনো কখনো, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো, বিস্মৃতির কুজ্ঝটিজাল ছিন্ন করে, এক আধজন পুরোনো মানুষের দেখা বা সন্ধান পাওয়া যায়। এঁদের কেউ কেউ(বা অনেকেই) চলে গেছেন, কেউ কেউ আছেন। তাঁদের বাড়িগুলো, তাঁরা, যে কালিম্পং-এ ছিলো, ছিলেন, না থাকা বা ভীষণরকম বদলে যাওয়া সেই সায়েবি শহরের গল্প শোনা দরকার।

তিস্তার ওপারের দার্জিলিং পাহাড়ে পুরোনো বাড়িঘর যা ছিলো, তাদের গল্প সেভাবে লেখা হয়নি। যা ছিটেফোঁটা পাওয়া গিয়েছে, এই আখ্যানে তাদের যৎকিঞ্চিৎ উল্লেখমাত্র আছে। পুরোনো বাড়ির সঙ্গে পুরোনো বাড়ির বাসিন্দা পুরোনো মানুষ, তাঁদের ভালোমন্দ লাগা, বাড়ির স্থাপত্য, ছাদ দেয়াল মেঝে, ইটকাঠ, উঠোন, বাগান, গাছপালা, এসবের যে নিবিড় নিগূঢ় সংযোগ, তা নিয়ে তেমন বয়ান খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে যে গল্প আমরা বলবার চেষ্টা করেছি, তা বড় অর্থাৎ বহুধাব্যাপ্ত বিষয়ের, নিসর্গের, নিসর্গবদলের, জনগোষ্ঠীর, অর্থনীতির, ইতিহাসের। সায়েবসময়ে দার্জিলিং পাহাড় ক্ষমতার কেন্দ্র ছিলো, সাম্রাজ্য ও সাম্রাজ্যশাসন তার যাবতীয় ইতিহাস ও স্মৃতিকে ঘিরে রাখবে, এটাই স্বাভাবিক। তুলনায় অর্বাচীন ও নবীনতর কালিম্পং-এর গল্পে ঢুকেও দেখা যাচ্ছে, সাম্রাজ্য ও সাম্রাজ্যবিহ্বলতা সে গল্পেও ওতপ্রোত, অন্তত গ্রাহামস হোম বা শহরপত্তনের যে কাহিনীর মধ্যে এতক্ষণ ঘোরাঘুরি হলো, সেখানে তো বটেই। সায়েবসময়ে তৈরি হওয়া, সায়েবদের বানানো হিল স্টেশান, সাম্রাজ্যের কথা বা সাম্রাজ্যভাবনা তার রক্তে মাংসে রোমকূপে চারিত হবে না, হতে পারে না, অসম্ভব।

সাম্রাজ্যের কথা, বড় ইতিহাসের গল্প থেকে একেবারে দূরে যাওয়া সম্ভব নয়। তথাপি, মূলত আপার কার্ট রোড ও রিংকিংপং পথকে ঘিরে যে পুরোনো বাড়িঘর ছিলো ও আছে, তাদের নিজস্ব গল্পও আছে। এইখানে কালিম্পং-এর স্ব-চরিত্র, স্বাতন্ত্র্য বা বিশেষ, এই শহরে সায়েবসময়ের মার্কামারা ঔপনিবেশিক গল্পের মধ্যে বাড়ির, মানুষের, সময়ের অন্য ছোট ছোট গল্প মিশে আছে। আগেই বলেছি, দার্জিলিং এর তুলনায় কালিম্পং-এর গল্প সংখ্যায় বেশি, বৈচিত্র্যেও ধনী। হয়তো এর ঐতিহাসিক কারণও ছিলো। মার্কুস ভিব্যেক সম্পাদিত গবেষণাকাজের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখিত, সে কাজের মূল সন্ধান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেপরে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কালিম্পং শহরে এসে নানান কারণে জমা হচ্ছেন আশ্চর্য সব বর্ণিল ও গল্পময় মানুষেরা। দূরবীন পাহাড়ের নিচের অংশে, অর্থাৎ রিংকিংপং ও আপার কার্ট পথের আশেপাশে, বিভিন্ন সায়েবি, বাঙালি ও পাহাড়ি বাড়িতে তাঁরা থাকছেন পাঁচ, ছয়, দশ, পনেরো বছর, হয়তো বা তারও বেশি। থাকছেন, এবং মেলামেশা করছেন স্থানীয়দের সঙ্গে। এই ব্যক্তিত্বসমূহ প্রসঙ্গে আলাদা করে অনেক কথা বলা যায়, বলাও হয়েছে, কিছু কিছু আমাদের আখ্যানে আসবে, আগ্রহী পাঠক খুঁজে নিতে পারবেন। আমরা অন্য গল্পে যাই, যেখানে নদীর সঙ্গে নদী মেশার মতো করে বিভিন্ন দেশ, সময় ও সংস্কৃতির এক বিচিত্র সঙ্গম, এবং তা ঘটছে কালিম্পং-এর বিশেষ এক এলাকায়, বিশেষ কিছু বাড়িকে কেন্দ্র করে। এই রকম এক বাড়ির মালিক, মনিলা দে, তাঁর পারিবারিক বাড়ির নাম, মঞ্জুলা। মনিলার নাম শোনা ছিলো, সম্প্রতি তাঁর শেষ জীবনের লেখা কালিম্পং-এর গল্প বা কালিম্পং স্টোরিজ পড়বার সুযোগ হলো। আমাদের এই পর্যায়ের কালিম্পং পাঠও সেই গল্প থেকে শুরু হোক।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *