সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৩৪। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

দুই
কেসাং-এর ছবিতে পুরোনো আবাসিকদের নিজেদের মুখে বলা নিজেদের কথা আছে। হোমে কাটানো সময়ের কথা মনে করতে করতে কারুর চোখ ছলছল করছে, কেউ কেঁদে ফেলছেন। এক তো স্বজন পরিজনহীন দূর প্রবাসে নির্বাসন, তদুপরি, মনের কথা বলবার বা সান্তনা দেবারও কেউ নেই। একটি বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়ে হোমের হস্টেলে এসে জমা পড়ছে, চেনা কেউ ত্রিসীমানায় নেই, নেই ভালোবাসা বা স্নেহও। সহানুভূতি বা করুণা নয়, নিশ্ছিদ্র কঠোর অনুশাসন। নিয়ম ভাঙা চলবে না, স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে হবে, ভুল করলেই কঠিন শাস্তির জন্য তৈরি থাকতে হবে। ছবিতে দেখানো হচ্ছে কটেজবাড়ির ভিতরের ঘর, সার সার শূন্য বিছানায় এক একটা করে খেলনা ভাল্লুক, অর্থাৎ টেডি। দুঃখের বা আনন্দের কথা বলতে হতো টেডিকেই। যে বাচ্চা মেয়েটির কথা হচ্ছিলো, হোমে আসার পর থেকে অনেক অনেকদিন অবধি সে এতোটাই দুঃখী ও সন্ত্রস্ত থাকতো, প্রায়ই বিছানা ভিজিয়ে ফেলতো। হোমের নিয়মে বিছানা ভেজানো অমার্জনীয় ও গর্হিত অপরাধ, যে করে তাকে বকুনি খেতে তো হতোই, মাঝরাতের ঠান্ডায় বিছানার চাদর কেচে শুকোতে হতো। ২০০০ সালে মেয়েটি মাঝবয়সী মহিলা, বলতে বলতে তাঁর গলা ধরে আসছে, থাকবন্দি বিছানা টপকে ছোট এক ফালি জানলা দিয়ে বাইরের সবুজ ঢাল, গাছপালা দেখা যাচ্ছে।
আর একজন আবাসিক, একটি বাচ্চা ছেলে বলছে, হোম, বাড়ি? আমরা বলতাম বটে হোমই আমাদের বাড়ি, কি করে তা সম্ভব? বাড়ির মতো, পরিবারের মতো অন্য কিছু কি হতে পারে, জোর করে অন্য কিছুকে, অন্য একটা জায়গাকে, তা সে যত ভালো, যত সুন্দরই হোক, বাড়ি বানানো কি যায় আদৌ? পুরোনো কথা মনে করতে করতে ছেলেটি, অর্থাৎ সাক্ষাৎকারের সময়ে যিনি মধ্যবয়সী পুরুষ, ঘাড় নিচু করে হাঁটুতে মুখ গুজছেন।
ছবির মধ্যেই, মনে করতে করতে আর একটি মেয়ে বলছে:
“চা বাগিচা ছেড়ে বাবা দেশে ফিরে গেলেন, আমাকে অন্য কারুর হাতে তুলে, মা ট্রেন ধরলেন। কারুর সঙ্গে এজন্মে আর দেখাই হলো না। বাবার মৃত্যুর খবর হোম থেকে জানানো হয়েছিলো। হোমের জীবন শেষ করে অনেক কষ্টে আসাম পৌঁছে শুনলাম, দু মাস আগে মা মারা গেছেন…হোমে বড় হয়ে উঠছি, আমার কেবল মনে হতো, মায়ের কোলে ছোটমতো একটা কাউকে দেখেছি নিশ্চয়। সেটা নিশ্চয় আমার ভাই, নিজের ছোট্ট ভাই। কটেজের আন্টিকে, হোমের অন্য বড়দের কতবার জিজ্ঞেস করেছি, আমার কি একটা ভাই আছে?…কেউ কিছু বলেনি।…আরো অনেকদিন পর, আমার তখন বিয়েটিয়ে হয়ে গেছে, হোম থেকে ডাক এলো, আমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে চায়, আমি কি আসবো? গিয়ে দেখি, যে দেখা করতে চাইছে, সে আমার নিজের হারিয়ে যাওয়া ভাই। এতদিন কোথায় ছিলো? জানতে পারলাম আমারই মতো, সেও হোমেই বড় হয়েছে। হোমের একদিকে একটা বাড়িতে ও, আর একদিকে আর একটা বাড়িতে আমি। অতগুলো বছর কেটে গেলো, কেউ কাউকে চিনলাম না, জানলাম না…কেউ কিছু আমাদের বলেইনি…”
আর একজন, বা অনেকেই, বলছেন, হোমের জীবনে মানিয়ে নিতে প্রচুর সময় লেগেছিলো। সেই আদিকাল থেকেই, খুব ছোট বাচ্চাদের হোমে ছেড়ে যাবার চল ছিলো, কারুর বয়স তিন বা চার, কারুর পাঁচ বা ছয়, অনেকে আরো আরো ছোট। হোমে থাকতে থাকতে কি মনে হতো তাদের? ছবি থেকে নেওয়া আরো একজনের জবানিতে:
“হোম কি বাড়ি? বাড়িতে কি মিলিটারি ইস্কুলের মতো, সব কাজ নিয়ম মেনে, সময় বেঁধে করতে হয়?”
হোমের একমাত্র যে জীবিত ও আদি আবাসিকের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন জেন, সেই রুথ ডেন বোগার্ট বলছেন:
“সোজা আমাকে ‘আলাদা ঘরে’ (আইসোলেশান ওয়ার্ড–সেসময়ের দস্তুর ছিলো নতুন আসা বাচ্চাদের কোয়ারান্টাইনে রেখে জীবাণু ও ব্যাধিমুক্ত করা) পাঠিয়ে দেওয়া হলো। দু তিন সপ্তাহ ধরে আমি কাঁদছি তো কাঁদছিই। হাসপাতালের ঘরের মতো একটা ঘর, ধারেকাছে কেউ নেই, সাদা জামাকাপড় পরা নার্সরা এসে খোঁচাচ্ছে আর চিমটি কাটছে…”
অত ছোটবেলায় পরিবার ও চেনাজানা পরিসর থেকে আচমকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বার পর, ঠিক কি যে হচ্ছে অধিকাংশ বাচ্চাই বুঝতো না। ছবি থেকে এরকম আরেকটি বাচ্চার স্বর:
“সত্যি বলবো? কি যে হলো, কোথায় এসে পড়লাম, কিছু বুঝিনি। মা-কে খুঁজছি, মা কোথাও নেই…বিছানা থেকে পড়ে যাচ্ছি, মাটি থেকে তুলে ঠিক করে শুইয়ে দেবার মতো কেউ নেই…একবার এখানে যাও, একবার ওখানে…সারাক্ষণ এত টানাহ্যাঁচড়া হতো যে কিচ্ছুটি বুঝে উঠতে পারতাম না…”
জেন মনে করিয়ে দিয়েছেন, প্রথম থেকেই বাচ্চাদের কঠিন নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে বেঁধে ফেলাটা স্বয়ং গ্রাহামের নীতি, তিনি মনে করতেন, শ্রমের মাধ্যমে ‘ক্ষতিকর দিশি প্রভাব’ থেকে আবাসিকদের মুক্ত রাখা যাবে, ‘শ্রমের প্রকৃত মর্যাদা’ যে কি, তারা বুঝতেও পারবে।
(ক্রমশ)