সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৩৩। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

হোমের ভিতরে
…………………………….
এক
হোমের আবাসিক নই, এবং তিন কূলে কোনদিন কেউ হোমে ছিলোনা, ফলে হোমের আসল ভিতরটা, মানে কটেজবাড়িগুলোর ভিতরটা কেমন, জানবার সুযোগ ছিলো না। জেন ম্যাকেবের লেখার সূত্র ধরে সে সুযোগ ঘটে গেলো অকস্মাৎ।
জেন যখন কাজ শুরু করছেন, নিউজিল্যান্ডপ্রবাসী ও হোমের আদি আবাসিকদের মধ্যে মাত্র একজনের সঙ্গেই তিনি কথা বলতে পেরেছিলেন। বাকিদের যে গল্প জোগাড় হয়েছিলো, এবং যার কিছু কিছু আমাদের গল্পেও ঢুকেছে ইতিমধ্যে, প্রধানত আবাসিকদের ফাইল থেকে নেওয়া। সে গল্প জীর্ণ কাগজে আবছা হয়ে আসা অক্ষরের, হলদে বাদামি হয়ে যাওয়া সাদাকালো ছবির, জ্যান্ত মানুষের সজীব স্মৃতি সেখানে ফাইলবন্দী, কেজো আনুষ্ঠানিকতায় মোড়া। হোমের অপরূপ নিসর্গের পুরু পেঁয়াজখোসা সরিয়ে, জলে স্থলে অন্তরীক্ষে সতত বিরাজমান তীব্র সায়েবগন্ধ গায়ে না মাখার চেষ্টা করতে করতে, ভিতরের গল্পের খোঁজ করতে করতে আমারো মনে হয়েছে কতবার, হোমের ঘরবাড়িগুলো যদি কথা বলতে পারতো!
ঘরবাড়ি, নিসর্গ, নিসর্গের মধ্যে নিথর জমে থাকা নেহাৎই পুরোনো কাগজ ও ছবি হয়ে যাওয়া নয়, রীতিমতো হেঁটেচলে বেড়ানো জ্যান্ত মানুষদের কথা শুনবার সুযোগ ঘটলো একটা তথ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারি হাতে পেয়ে। হোমের প্রাক্তন আবাসিক ও তিব্বতি চলচ্চিত্রকার কেসাং সেৎসেন( আমাদের পাহাড়ের নেপালি ভাষায় সহজ করে বলা হয়, ‘চেতেন’) এই ছবি বানিয়েছিলেন ২০০০ সালে, হোমের শতবর্ষপূর্তি উৎসবে যোগ দিতে এসে। ‘আমরা হোমের লোকজন’ বা ‘উই হোমস চ্যাপস’ নামের ছবিতে উৎসব অবশ্য উপলক্ষমাত্র। যে সব মধ্যবয়সী ও প্রৌঢ় আবাসিক ওজিবি অর্থাৎ হোম প্রাক্তনী কালিম্পং এসেছিলেন সে সময়, তাদের সঙ্গে টুকরো টুকরো কথাবার্তা জুড়ে জুড়ে এক ঘণ্টার ছবি, যার পঁচাত্তর থেকে আশি ভাগ ঘরের ভিতরে তোলা। উৎসবের মতোই, হোমের নিসর্গও এ ছবিতে নিছক প্রেক্ষাপট, আসল গল্প হোমের আবাসিকদের, সুখদুঃখের, আনন্দবেদনার স্মৃতিচারণের। দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে মনে হলো, হোমের বিচিত্র ইতিহাসের গভীরে আমিও ঢুকে যাচ্ছি, দর্শক হিসেবে নয়, অংশীদার হিসেবে।
যাঁরা কথা বলেছেন ছবিতে, তাঁদের কারুর জন্ম ১৯৫০ -এ, কারুর ৫৫-য়। কেউ বা আবার জন্মেছেন আরো আগে, ১৯৪৫ কিম্বা ৪৮-এ। অর্থাৎ তাঁরা সবাই হোমে আসছেন সায়েব পরবর্তী সময়ে। ইদানিং কাঠমান্ডু নিবাসী কেসাং নিজে হোমে শৈশব কৈশোর কাটাচ্ছেন ৭০-এর দশকে। তাঁর সহপাঠি(নী)দের অনেকেই ছবিতে উপস্থিত, যাঁদের অধিকাংশ তিব্বতি কিম্বা ভুটানি, আধা বা অন্তত পোয়াটাক সাদারক্ত আছে, এমন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান খুব কম। বোঝাই যায়, সায়েবরা ভারত ছেড়ে দেশযাত্রা (বা হোমযাত্রা) করছেন তো করছেনই, দূরের চা বাগান এবং কাছের শহর ক্রমাগত সায়েবশূন্য হচ্ছে, যে তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা এদিকে ওদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে ছিলেন, তাদেরও বেশিরভাগ দেশ ছাড়ছেন। অবশ্য কেসাং-এর ছবি থেকেই স্পষ্ট, পঞ্চাশ কি ষাটের দশকে, এমনকি সত্তরের গোড়াতেও যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাচ্চারা হোমে এসে পড়ছে, তাদের অনেকেই দেশ বলতে ভারতবর্ষকে বুঝতো না।
হোম গড়ে উঠছে বিশ শতকের প্রথম দিকে, এই ছবি তৈরি হচ্ছে ২০০০ সালে, প্রায় একশো বছর পর। হোমের গল্প বলতে শুনতে ইউরেশিয় বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের যে গল্পের মধ্যে থাকতেই হচ্ছিলো আমাদের, সে গল্প তখনি বাসি, দিশি জীবাণুমুক্ত হোমনিসর্গ জুড়ে সাদাকে ছাপিয়ে কালো হলদে বাদামি ঢুকে এসেছে। তথাপি, হোম হচ্ছে হোম, তার পরিচালকরা, শিক্ষকরা ও কটেজ-আন্টিরা নিজেদের সাম্রাজ্যঐতিহ্য বিষয়ে সজাগ। ২০০০ সালে হয়তো ততটা নয়। কিন্তু যাঁরা কথা বলছিলেন ছবিতে, তাঁরা যখন ছোট, তখনকার হোমে প্রায় সবাই সায়েব, নিদেন পরিচালকরা তো বটেই। সায়েবসময়ের নিয়মকানুন তখনো বাহাল, হোমের ভিতরে থাকতে আসা মানে বাইরের দুনিয়া এবং নিজের পুরোনো জীবনের সঙ্গে সম্পর্কছেদ, নিজের ভাষা রীতিনীতি ভুলে সায়েবি ভাষা ও আদবকায়দা শেখা, নিজের ধর্ম ভুলে খৃষ্টউপাসনা করা।
(ক্রমশ)