সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৩২। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

ছয়

আরো দশটা সায়েবসময়ের গল্পে যেমন হয়, কালিম্পং, কালিম্পং-এর গ্রাহামস হোমের গল্পও তেমনি, বড় নদী বা গল্পের ভিতরে ছোট ছোট অসংখ্য যে সব নদীগল্প জমে থাকে, সেসব খুঁজে পাওয়া যায়ই না প্রায়। আমরা অনেকক্ষণ ধরে সায়েবসাম্রাজ্য ও সাম্রাজ্যের উপযুক্ত মজুর তৈরির গল্প শুনছি, সেই সঙ্গে কালিম্পং শহর পত্তনেরও। এই গল্পগুলোর সবগুলোই বড়, সাম্রাজ্যের, ধর্মপ্রচারের, সাদা কালো হলদে বাদামি বা গায়ের রঙের, কিম্বা কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে বললে, ‘ভালো কাজ’ করবার, যাকে সায়েবরা সমাজসেবা বা ডু-গুডিং বলে থাকে। সায়েবসময় শেষ হতে চায় না, ঐতিহাসিক সায়েবসাম্রাজ্য ফৌত হয়ে গেলেও না, ফলে যে সব লেখাপত্র আমরা ঘাঁটছি, তার মোদ্দা ঝোঁকটা বড়র দিকেই, ছোটরা নজরের আড়ালে চলে যায়।

 

হোমের গল্পের ক্ষেত্রে এ কথাটা আক্ষরিকভাবেই সত্যি। মাঝে মধ্যে এই বই ওই বই কিম্বা হোমের আবাসিকদের ফাইল ইত্যাদিতে সাদাকালো ছবির ঝাঁক উড়ে আসে, একেবারে খুদে এবং একটু বড় বাচ্চারা বসে বা দাঁড়িয়ে, পিছনে হোমের ইস্কুলবাড়ি বা কটেজঘরের দেওয়াল। মিজুতানি, মে এবং ম্যাকেবের গবেষণাকাজে এই ছবিগুলোকে, ছবির ভিতরের বাচ্চাদের কথা বলাতে চেষ্টা করা হয়েছে, হারিয়ে যাওয়া নদীগল্পের বিস্মৃত ধারাপথের কিছু কিছু অংশের সন্ধান মিলেছে। আমরা যেমন দেখছিলাম, একশো বছর ধরে হোমে জমা পড়া, জমা থাকা ও বাইরে চালান করে দেওয়া শৈশবকৈশোরের গল্প শুধু যে গবেষকরা খুঁজছেন তা নয়, পুরোনো আবাসিকদের পরিবারের মানুষজনও সেই একই খোঁজে কালিম্পং-এর হোমে ছুটে আসছেন। পুরোনো গল্পে নতুন মানুষ ঢুকে পড়ছেন, পুরোনো ছবির গায়ে নতুন রঙ লাগছে, সব সময় রূপকার্থে নয়, সত্যিই, নিজেদের দিদিমা দাদুর আড়াল করে রাখা হারানো শৈশবের ছবিতে রঙ লাগিয়ে যত্নে সাজিয়ে রাখছেন বাড়িতে।

 

এইসব, এইরকম অনেক নাড়াচাড়া চলছে, চলবেও। কিন্তু হারানো গল্পের হারানো সোতার কতগুলোকেই বা খুঁজে পাওয়া যাবে? ছবি থেকে গল্প মেঝেয় লাফিয়ে নেমে সত্যিই তো আর বাচ্চা বেড়ালের মতো দৌড়োদৌড়ি করবে না, কিম্বা মানুষবাচ্চার মতো কেঁদে উঠবে না টোয়া করে, মাথা খুঁড়লেও না। বিভিন্ন বইয়ের পাতায়, নেটের মাকড়শাজালে নানান সাদাকালো ছবি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো, যে সব বাচ্চাদের, তাদের মায়েদের বাবাদের গল্প জেন ও অন্যান্যরা বলার চেষ্টা করছেন, যদি তাঁদের নিজেদের মুখ সেই গল্পগুলো বলতে পারতো?

 

আমি তো নেহাৎই বাইরে থেকে, নিসর্গলোলুপ ও হেরিটেজমুগ্ধ ট্যুরিস্ট যথা, হোমের মধ্যে ঘুরেছি, আমাদের এদিককার পাহাড়গুলো থেকে যা বেমালুম মোটামুটি মুছে গেছে সেই সায়েবসময়ের খোঁজে। কালিম্পং-এর ভিক্টোরিয়া ওরফে ডম্বর চক থেকে আলগাড়া লাভা যাবার বড় রাস্তা ছেড়ে হোম ঢুকবার ছোট রাস্তায় যাবার পথে একের পর এক কটেজবাড়ি, কাঠপাথরের, সাদানীল, সবুজাভ সাদা, কিছু বা হলদে বাদামি। ছোট ছোট জানলায় কাঁচ বসানো, বাড়ির মাথায় সার বাঁধা চিমনী। কোন বাড়ির দেওয়ালে বোগেনভালিয়ার লাল কিম্বা বেগনি, কোনটার গায়ে সাদা ও গোলাপি পাহাড়ি গোলাপের  ঝাড়। সবুজ ঘেসো জমি ঘিরে গাছের পর গাছের পর গাছ। একটু ওপরে উঠলে ইস্কুল বাড়ির দালান, গ্রাহামের আবক্ষ মূর্তি, লম্বা ঘড়িঘর বা ক্লকটাওয়ার, আরো ওপরে কেট গ্রাহামের গীর্জা। এই সব ছবি দেখেছি, দেখি, আরো দেখবো নিশ্চয়। কিন্তুর ছবির ভিতরের গল্পের কি হবে? ভেজা কালো মাটিতে ঘাসের শিকড়ের মতো, কটেজ বাড়ির দেওয়াল আঁকড়ে থাকা বোগেনভালিয়া বা গোলাপের মতো, কটেজের ভিতরের পালিশ করা মসৃণ কাঠের মেঝে, সিঁড়ি, ঘরের মধ্যের সারসার থাকথাক বিছানা, এমন কি বাইরের লনে কি বাগানে, হয়তো বা দেয়ালে চিমনিতেও, যে সব বাচ্চাদের শ্রম, কান্না, দুঃখ ও আনন্দ জমে আছে একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে, কি করে চেনা যাবে তাদের, শোনা যাবে অগুন্তি না বলা সব গল্প?

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *