সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৬। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
সস্ত্রীক গ্রাহাম কালিমপং-য়ে আসেন ১৮৮৯ নাগাদ। গ্রাহাম, তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন বা কেট দুজনেই কালিমপং-য়ে আমৃত্যু থেকেছেন, মিশনের কাজ করেছেন, সে কাজের বাইরেও নানান বিচিত্র সামাজিক কাজও। সে সবের কিছু কিছুর গল্পও আমাদের গল্পে আসবে, আসতেই হবে। আপাতত শহরপত্তনের কথায় ফিরি। ১৮৬৫-তে ব্রিটিশদের হাতে তিস্তার পূব দিকের পাহাড়-সমতল যাচ্ছে। ১৮৭৯-এ চার্চ অফ স্কটলন্ডের হয়ে ম্যাকফার্লেন সায়েব কালিমপং-য়ে ডেরা ফেলছেন। এখন যেখানে কালিমপং-য়ের ঘিঞ্জি নোংরা বাজার, গাড়ির ভিড় ও হাল্লা, তার একটু ওপরের পাহাড়ে বেশ খানিক জমি নিয়ে ম্যাকফার্লেন, অর্থাৎ রেভরেন্ড উইলিয়ম ম্যাকফার্লেন, কালিমপং মিশনের শুরুয়াত করেন। ১৮৬৫-তে গ্লাসগো থেকে ভারতে এসে, নানা দেশ ঘুরে তিনি দার্জিলিং-য়ে থিতু হন ১৮৭০-এ, সেখান থেকে কালিমপং। কালিমপং পাহাড়ের জমি তখনো ভালো করে জরিপ হয়নি, সিঙ্কোনা বাগিচা ও চা বাগিচার জন্য ও বনদপ্তরের অধীন সরকারি বনের জন্য সবে মাত্র জমি বন্দোবস্ত হয়েছে ১৮৭৭-৮ নাগাদ। কালিমপং-য়ের জমিতে সরকারি রাইয়ত হিসেবে প্রজা বসানোর কাজ অর্থাৎ সেটলমেন্ট(কার জমি, কি শর্তে পাওয়া, কত খাজনা ইত্যাদি) নিয়ে শ্রীযুত মারিনদিন সায়েবের প্রথম সেটলমেন্ট রিপোর্ট জমা পড়ছে ১৮৮২-এ। চারপাশে ধূধূ পাহাড়, যার অনেকটাই সদ্য জুমচাষের জন্য বৃক্ষবিরল, এবং বাঘ-ভাল্লুক ডাকা আদিম পাহাড়ি জঙ্গল, ম্যাকফার্লেন সেখানে মিশন বসালেন। ঘরবাড়ির জন্য জমি নেওয়ার আগেই সেখানে খ্রীষ্টানদের গোর দেওয়া শুরু হয়ে গেছে, মিশনের প্রথম জমি বলতে গোরস্থানের জমি। পাকাপাকিভাবে থাকতে যাবার আগেই সেখানে ম্যাকফার্লেন ও সতীর্থ মিশনারিদের যাতায়াত শুরু হয়েছে, কালিমপং-য়ের পুরোনো গ্রামে একটা ছোট ইস্কুলও খোলা হয়েছে। সম্ভবত সেটা ১৮৭৫ সন। ১৮৭৬-এর জুনে পাহাড়ে কলেরা হানা দিলো। কিছু ওষুধপত্র নিয়ে ম্যাকফার্লেন দার্জিলিং থেকে রওনা হলেন, পেশক হয়ে তিস্তায় নামলেন। নদী পেরোনোর জন্য নড়বড়ে, পিছল সাঁকো, প্রাণ হাতে করে উঠতে হয়। সেই সাঁকো পেরুনোর বর্ণনা ম্যাকফার্লেনের ভাষায়(গ্রাহাম উদ্ধৃতি দিয়েছেন)ঃ
উৎরাই পথ বাহিয়া তিস্তা নদীর নিকটে পোঁছিবামাত্র বুঝিলাম, এই স্রোতস্বিণী অতিক্রম করা অতীব দুরূহ কর্ম্ম। সুখমান মৎ-সহিত সাক্ষাৎ করিতে নিচ প্রদেশে আসিয়াছিল…উহার নিকট কালিম্পং-এর বর্তমান অবস্থার মর্মান্তিক বিবরণ শ্রবণ করিলাম। সে বলিল, রঘুবীর(খ্রীষ্ট-ধর্মাবলম্বী গুর্খা চাষি) মৃত্যুমুখে পতিত, যে বাটিতে সে বসবাস করিত, তাহা হইতে বাটির অপরাপর মানুষ তাহার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই পলায়ন করিয়াছে; জংগবীর (শিক্ষক) ও সে(সুখমান) কোনক্রমে উহাকে গোর দিয়াছে; কিন্তু সমাধি মৃত্তিকা দ্বারা আবরিত হইবার পূর্বেই জংগবীর স্বয়ং গুরুতর রুপে রোগগ্রস্ত হইয়া পড়ে, এবং এক্ষণে সে কালিম্পং-এ রোগশয্যায় শায়িত। ইহা শ্রবণপূর্বক, পরমেশ্বরের নিকট যথাসর্বস্ব ও নিজদিগকে সমর্পণ করিয়া সেতুপরি আরোহণ করিলাম। পদযুগল হইতে বুটজুতা এবং মুজা পূর্বেই খুলিয়া রাখিয়াছিলাম, নতুবা সেতুর তলদেশে গোলাকৃতি ও পিচ্ছিল যে বংশসকল রহিয়াছে, উহাতে পদস্খলন ঘটিবার সম্ভাবনা। যে সকল ঔষধ আমি সংগে লইয়া আসিয়াছিলাম, মৎপশ্চাতে সুখমান সেই ঔষধপূর্ণ থলিটি বহন করিয়া আনিতেছিলো। পিচ্ছিল বংশমধ্যে অকস্মাৎ সে হুঁচট খায়, ফলে উহার পৃষ্ঠ হইতে থলিটি নিম্নে নদীতে পতিত হয়। থলির সংগে সুখমান স্বয়ং যে নদীগত হয় নাই, এই ভাবিয়া ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। সেতুর অপর প্রান্তে পৌঁছিয়া সুখমান বড় বিচলিত হইয়া উঠিল। সে কহিল, কালিম্পং-এ উহারা মাত্র তিনজনই ছিল, ঈশ্বর ইতোমধ্যে একজনকে গ্রহণ করিয়াছেন, এবং এই কালান্তক ব্যাধি দ্বিতীয়জনকে আক্রমণ করিয়াছে। এমতাবস্থায়, যে ঔষধ উহার চিকিৎসার নিমিত্ত আনা হইতেছিল, তাহা আমরা হারাইলাম। ঈশ্বর স্বয়ং কি ঔষধসকল ফেলিয়া দিলেন?…
তিস্তা থেকে কালিম্পং-এর খাড়া চড়াই ভাঙতে গ্রাহামকে রীতিমতো বেগ পেতে হয়। হওয়ার কথাও। এখন যে পথ ন মাইল বা ১৪ কিলোমিটার মতো, ঘুরে ঘুরে যাওয়া সে পথে নয়, গ্রাহাম উঠেছিলেন সোজা পাহাড় বেয়ে। মোটে সাড়ে তিন মাইল হাঁটা রাস্তা, সেকালের গরুর গাড়ির ঘোরা পথে তার ঠিক দ্বিগুণ। চড়াইশেষে চোখে আচমকা ভেসে ওঠা কালিম্পং-এর নিসর্গ গ্রাহামদের মুগ্ধ করেছিলো, গ্রাহাম বলছেন এ দৃশ্য যার মন আনন্দময় বিস্ময়ে ভরিয়ে দেয় না, সে নিতান্তই হতভাগা। রেভারেন্ড এ ওয়ালেস উইলিয়মসনের করা নিসর্গবর্ণনা তুলে দিয়েছেন গ্রাহামঃ
উত্তর ভারতের অধিকাংশ প্রধান নগর সে দর্শন করিয়াছে, কিন্তু সর্বাপেক্ষা মহনীয় যে দৃশ্য তাহার দৃষ্টিগোচর হইয়াছে, তাহা প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক নগররাজি নহে, অথবা প্রকান্ড ও বিস্ময়কর স্থাপত্যকর্ম্মসকল। গগনচূম্বী পর্বতমালা অপেক্ষা তাহার অধিকতর মনোরম মনে হইয়াছে কালিম্পং-এর গ্রাম্য দৃশ্য, আপন অরণ্যাচ্ছাদিত শৈলোপরি দন্ডায়মান বৃক্ষমধ্যে গিল্ড মিশন গীর্জার বাড়িখানি।
সস্ত্রীক গ্রাহাম কালিমপং-য়ে আসেন ১৮৮৯ নাগাদ। গ্রাহাম, তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন বা কেট দুজনেই কালিমপং-য়ে আমৃত্যু থেকেছেন, মিশনের কাজ করেছেন, সে কাজের বাইরেও নানান বিচিত্র সামাজিক কাজও। সে সবের কিছু কিছুর গল্পও আমাদের গল্পে আসবে, আসতেই হবে। আপাতত শহরপত্তনের কথায় ফিরি। ১৮৬৫-তে ব্রিটিশদের হাতে তিস্তার পূব দিকের পাহাড়-সমতল যাচ্ছে। ১৮৭৯-এ চার্চ অফ স্কটলন্ডের হয়ে ম্যাকফার্লেন সায়েব কালিমপং-য়ে ডেরা ফেলছেন। এখন যেখানে কালিমপং-য়ের ঘিঞ্জি নোংরা বাজার, গাড়ির ভিড় ও হাল্লা, তার একটু ওপরের পাহাড়ে বেশ খানিক জমি নিয়ে ম্যাকফার্লেন, অর্থাৎ রেভরেন্ড উইলিয়ম ম্যাকফার্লেন, কালিমপং মিশনের শুরুয়াত করেন। ১৮৬৫-তে গ্লাসগো থেকে ভারতে এসে, নানা দেশ ঘুরে তিনি দার্জিলিং-য়ে থিতু হন ১৮৭০-এ, সেখান থেকে কালিমপং। কালিমপং পাহাড়ের জমি তখনো ভালো করে জরিপ হয়নি, সিঙ্কোনা বাগিচা ও চা বাগিচার জন্য ও বনদপ্তরের অধীন সরকারি বনের জন্য সবে মাত্র জমি বন্দোবস্ত হয়েছে ১৮৭৭-৮ নাগাদ। কালিমপং-য়ের জমিতে সরকারি রাইয়ত হিসেবে প্রজা বসানোর কাজ অর্থাৎ সেটলমেন্ট(কার জমি, কি শর্তে পাওয়া, কত খাজনা ইত্যাদি) নিয়ে শ্রীযুত মারিনদিন সায়েবের প্রথম সেটলমেন্ট রিপোর্ট জমা পড়ছে ১৮৮২-এ। চারপাশে ধূধূ পাহাড়, যার অনেকটাই সদ্য জুমচাষের জন্য বৃক্ষবিরল, এবং বাঘ-ভাল্লুক ডাকা আদিম পাহাড়ি জঙ্গল, ম্যাকফার্লেন সেখানে মিশন বসালেন। ঘরবাড়ির জন্য জমি নেওয়ার আগেই সেখানে খ্রীষ্টানদের গোর দেওয়া শুরু হয়ে গেছে, মিশনের প্রথম জমি বলতে গোরস্থানের জমি। পাকাপাকিভাবে থাকতে যাবার আগেই সেখানে ম্যাকফার্লেন ও সতীর্থ মিশনারিদের যাতায়াত শুরু হয়েছে, কালিমপং-য়ের পুরোনো গ্রামে একটা ছোট ইস্কুলও খোলা হয়েছে। সম্ভবত সেটা ১৮৭৫ সন। ১৮৭৬-এর জুনে পাহাড়ে কলেরা হানা দিলো। কিছু ওষুধপত্র নিয়ে ম্যাকফার্লেন দার্জিলিং থেকে রওনা হলেন, পেশক হয়ে তিস্তায় নামলেন। নদী পেরোনোর জন্য নড়বড়ে, পিছল সাঁকো, প্রাণ হাতে করে উঠতে হয়। সেই সাঁকো পেরুনোর বর্ণনা ম্যাকফার্লেনের ভাষায়(গ্রাহাম উদ্ধৃতি দিয়েছেন):
উৎরাই পথ বাহিয়া তিস্তা নদীর নিকটে পোঁছিবামাত্র বুঝিলাম, এই স্রোতস্বিণী অতিক্রম করা অতীব দুরূহ কর্ম্ম। সুখমান মৎ-সহিত সাক্ষাৎ করিতে নিচ প্রদেশে আসিয়াছিল…উহার নিকট কালিম্পং-এর বর্তমান অবস্থার মর্মান্তিক বিবরণ শ্রবণ করিলাম। সে বলিল, রঘুবীর(খ্রীষ্ট-ধর্মাবলম্বী গুর্খা চাষি) মৃত্যুমুখে পতিত, যে বাটিতে সে বসবাস করিত, তাহা হইতে বাটির অপরাপর মানুষ তাহার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই পলায়ন করিয়াছে; জংগবীর (শিক্ষক) ও সে(সুখমান) কোনক্রমে উহাকে গোর দিয়াছে; কিন্তু সমাধি মৃত্তিকা দ্বারা আবরিত হইবার পূর্বেই জংগবীর স্বয়ং গুরুতর রুপে রোগগ্রস্ত হইয়া পড়ে, এবং এক্ষণে সে কালিম্পং-এ রোগশয্যায় শায়িত। ইহা শ্রবণপূর্বক, পরমেশ্বরের নিকট যথাসর্বস্ব ও নিজদিগকে সমর্পণ করিয়া সেতুপরি আরোহণ করিলাম। পদযুগল হইতে বুটজুতা এবং মুজা পূর্বেই খুলিয়া রাখিয়াছিলাম, নতুবা সেতুর তলদেশে গোলাকৃতি ও পিচ্ছিল যে বংশসকল রহিয়াছে, উহাতে পদস্খলন ঘটিবার সম্ভাবনা। যে সকল ঔষধ আমি সংগে লইয়া আসিয়াছিলাম, মৎপশ্চাতে সুখমান সেই ঔষধপূর্ণ থলিটি বহন করিয়া আনিতেছিলো। পিচ্ছিল বংশমধ্যে অকস্মাৎ সে হুঁচট খায়, ফলে উহার পৃষ্ঠ হইতে থলিটি নিম্নে নদীতে পতিত হয়। থলির সংগে সুখমান স্বয়ং যে নদীগত হয় নাই, এই ভাবিয়া ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। সেতুর অপর প্রান্তে পৌঁছিয়া সুখমান বড় বিচলিত হইয়া উঠিল। সে কহিল, কালিম্পং-এ উহারা মাত্র তিনজনই ছিল, ঈশ্বর ইতোমধ্যে একজনকে গ্রহণ করিয়াছেন, এবং এই কালান্তক ব্যাধি দ্বিতীয়জনকে আক্রমণ করিয়াছে। এমতাবস্থায়, যে ঔষধ উহার চিকিৎসার নিমিত্ত আনা হইতেছিল, তাহা আমরা হারাইলাম। ঈশ্বর স্বয়ং কি ঔষধসকল ফেলিয়া দিলেন?…
তিস্তা থেকে কালিম্পং-এর খাড়া চড়াই ভাঙতে গ্রাহামকে রীতিমতো বেগ পেতে হয়। হওয়ার কথাও। এখন যে পথ ন মাইল বা ১৪ কিলোমিটার মতো, ঘুরে ঘুরে যাওয়া সে পথে নয়, গ্রাহাম উঠেছিলেন সোজা পাহাড় বেয়ে। মোটে সাড়ে তিন মাইল হাঁটা রাস্তা, সেকালের গরুর গাড়ির ঘোরা পথে তার ঠিক দ্বিগুণ। চড়াইশেষে চোখে আচমকা ভেসে ওঠা কালিম্পং-এর নিসর্গ গ্রাহামদের মুগ্ধ করেছিলো, গ্রাহাম বলছেন এ দৃশ্য যার মন আনন্দময় বিস্ময়ে ভরিয়ে দেয় না, সে নিতান্তই হতভাগা। রেভারেন্ড এ ওয়ালেস উইলিয়মসনের করা নিসর্গবর্ণনা তুলে দিয়েছেন গ্রাহামঃ
উত্তর ভারতের অধিকাংশ প্রধান নগর সে দর্শন করিয়াছে, কিন্তু সর্বাপেক্ষা মহনীয় যে দৃশ্য তাহার দৃষ্টিগোচর হইয়াছে, তাহা প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক নগররাজি নহে, অথবা প্রকান্ড ও বিস্ময়কর স্থাপত্যকর্ম্মসকল। গগনচূম্বী পর্বতমালা অপেক্ষা তাহার অধিকতর মনোরম মনে হইয়াছে কালিম্পং-এর গ্রাম্য দৃশ্য, আপন অরণ্যাচ্ছাদিত শৈলোপরি দন্ডায়মান বৃক্ষমধ্যে গিল্ড মিশন গীর্জার বাড়িখানি।
(ক্রমশ)