সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ২৬। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
বারো
জেন ম্যাকেব ও কালিম্পং উদ্ধার
এক
বছর কয়েক আগে, দার্জিলিং কালিম্পং নিয়ে লেখা বইপত্র খুঁজছি, আচমকাই একটা লেখার সন্ধান পেলাম। লেখা মানে পুরো লেখা নয়, কোন একটা বইয়ের অংশ। জেন ম্যাকেব লিখিত সে লেখার শিরোনাম ‘কালিম্পং উদ্ধার’, বা ‘রিকভারিং কালিম্পং’। পড়ে ফেললাম তৎক্ষনাৎ। আশ্চর্য সে লেখায় যত কালিম্পং-এর কথা, ততটাই নিউজিল্যান্ডের। হতেই হবে, যেহেতু লেখক নিজেও নিউজিল্যান্ডের বাসিন্দা। কোথায় কালিম্পং, কোথায় সাত সমুদ্র পারের নিউজিল্যান্ড, কি সম্পর্ক এ দুয়ের? এই আখ্যান এতদূর অবধি যাঁরা পড়েছেন, সে সম্পর্ক ও সম্পর্কের ইতিহাস বিষয়ে ওয়াকিফহাল, অনেক কিছু না বললেও সম্ভবত চলবে। ম্যাকেবের লেখা প্রথম যখন হাতে আসে, অতশত জানা ছিলো না, হোমের শান্ত ও আপাত অপরিবর্তিত নিসর্গের মধ্যে যে সাম্রাজ্যভাবনা ও দর্শন আমূল প্রোথিত, সে সুলুকসন্ধানও পাওয়া হয়ে ওঠেনি। বিস্মিত হয়ে পড়লাম, পড়ে আরো বিস্মিত হলাম, নিউজিল্যান্ড দেশে গ্রাহাম সায়েবের পাঠানো দেশান্তরী আবাসিকদের পরিবারদের খুঁজে খুঁজে বার করেছেন ম্যাকেব, তথাপি কী আশ্চর্য, কালিম্পং বা হোম প্রসঙ্গে সে সব পরিবারের লোকজন কিছুই জানেন না। তাঁদের নিজেদের মধ্যে পারিবারিক যোগাযোগ আছে, পালাপার্বণে কি অনুষ্ঠানে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ হয়। অথচ সে সব আড্ডাগল্প মেলামেশায় ভুল করেও কালিম্পং-এর কথা আসে না, কখনোই, একেবারেই না। জেন ম্যাকেব বলছেন, একদিকে হোম, কালিম্পং, ভারতবর্ষ, অন্যদিকে নিউজিল্যান্ড প্রবাসী ওজিবি পরিবারেরা, এ দুইয়ের মধ্যে নিরন্ধ্র নীরবতার দেয়াল, টপকানো যায় না। কারুর বাবা, কারুর মা, অনেকেরই ঠাকুমা দিদিমার শৈশব কৈশোর কেটেছে কালিম্পং-এর হোমে, অথচ নিজেদের সন্তানসন্ততিদের তাঁরা কেউ কিচ্ছু বলেন নি। কেন? ম্যাকেব উত্তর খুঁজতে শুরু করলেন।
সম্প্রতি, হালের এই লেখার সূত্রে ম্যাকেবের লেখায় ফিরতে হলো। লেখায় লেখা টানে, চোখ বুলোতে হলো তাঁর অন্য লেখাপত্রেও। গ্রাহাম সায়েবের ডেরার যে ইতিহাস-গল্প আমরা পড়ার চেষ্টা করছি, তার সর্বোত্তম আকর জেন ম্যাকেবের লেখা। নানান সূত্র ঘেঁটে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিরবচ্ছিন্ন দৌড়োদৌড়ি করে, বহু বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে ম্যাকেব যে কাহিনী নির্মাণ করেছেন, তাতে বিবিধ ঐতিহাসিক তথ্য ও বিশ্লেষণ তো আছেই, উপরন্তু আছে ভুলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া মানুষদের বিচিত্র সব গল্প। ম্যাকেবের বলা না হলেও, সে সব গল্পের কিছু কিছু ইতোমধ্যে আমাদের আখ্যানে এসেছে। আরো কিছু গল্প আমরা ম্যাকেবের কাছ থেকেও জানবোশুনবো। কিন্তু ম্যাকেবের গল্পের মূল চরিত্র তিনি নিজেই, অন্য গল্পে ঢোকার আগে তাঁর গল্প শুনে ফেলাটা দরকার।
জেন ম্যাকেবের লেখা দুটি পৃথক বইয়ের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমটির সংক্ষিপ্ত নাম কালিম্পং কিডস, বা ‘ ‘কালিম্পং-এর ছোটরা’। ছবিগল্পে(ছবি বেশি, গল্প কম) ঠাসা এই বই ওটাগো য়্যূনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ২০২০ সালে। ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪ সালে জমা পড়া ম্যাকেবের মূল গবেষণাপত্রের নামও কালিম্পং কিডস: দি লাইভস অ্যান্ড লেবারস অব অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অ্যাডলসেন্টস বিটুইন ১৯০৮ ট্যু ১৯৩৮। ‘কালিম্পং কিডস’ নামে জেন একটা ওয়েবসাইটও চালান। এ ভিন্ন, জেনের মূল বা প্রধান বইটির নাম রেস, টি, অ্যান্ড কলোনিয়াল সেটলমেন্টস: ইম্পিরিয়াল ফ্যমিলিজ, ইন্টেরাপ্টেড, প্রকাশিত হচ্ছে ব্লামজবেরি অ্যাকাডেমিক থেকে ২০১৭ সালে। গ্রাহামস হোম ইত্যাদি নিয়ে আপাতত যা বলা হবে, মোটের ওপর এই দুটি বই ধরে।
ম্যাকেবের বই, লেখা মানে তাঁর নিজের গল্পও। কালিম্পং ও গ্রাহামস হোম নিয়ে তাঁর আগ্রহের কারণ কি? কিভাবে তিনি এদিককার পাহাড়ে পৌঁছলেন, কেনই বা ছুটে গেলেন হোমে, কোন রহস্য নিরসনের আশায়? ‘রেস, টি অ্যান্ড কোলোনিয়াল সেটোলমেন্ট’ বইয়ের ভূমিকায় বলা সে গল্প জেনের নিজের জবানীতেই শোনা যাক:
২০০৭-এর ১লা ডিসেম্বর। আমি পৌঁছলাম উত্তরপূর্ব ভারতের দার্জিলিং জেলায়, হিমালয়ের পাদশৈলে অবস্থিত ছোট্ট শহর কালিম্পং-এ। ডঃ গ্রাহামের হোম, যেটা কিনা একটা আবাসিক ইস্কুল, সেটা দেখার জন্যই এখানে আসা। আমার বিশ্বাস, আমার ঠাকুমা লর্না পিটার্স এই ইস্কুলে পড়েছিলেন। মাত্র কয়েক মাস আগেও এর বিন্দুবিসর্গ জানা ছিলো না। লর্নার বাবা ব্রিটিশ প্ল্যান্টার ছিলেন, তাঁর মা ভারতীয়, তিনি অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন, এবং কি করে কি করে যেন লর্না এবং তার ভাইবোনেরা ১৯২০ নাগাদ নিউজিল্যান্ডে চলে এসেছিলেন, এইটুকু শুনেছিলাম। এর কয়েক বছর পর, তাঁদের প্ল্যান্টার বাবাও চলে আসেন, ডুনেদিন শহরের উপকন্ঠে, পাইন হিল নামের বাড়িটায়, লর্না, তাঁর স্বামী, এবং তাঁদের দুই ছেলের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। তাঁদের ছোট ছেলের নাম ডন, আমার বাবা। আমার বয়স যখন পাঁচ, ১৯৭৮ সাল, লর্না মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে অবধি, ভারতবর্ষের সঙ্গে তাঁর সংযোগ, কি করে, কেন তিনি নিউজিল্যান্ডে এলেন, এ সব বিষয়ে কাউকে কিছু না বলেই।
(ক্রমশ)