সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ২৪। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

গত পর্বের পর

নয়

কলকাতা ও দার্জিলিং ফেরত অনাথ ডলি, ঠান্ডা সুন্দর কালিম্পং পাহাড়ে এসে কেমন ছিলেন? ডিক্সন বলছেন, হোমের কঠোর কঠিন ভিক্টোরিয় অনুশাসন মানতে মানতে ডলি তাঁর শৈশব হারিয়ে ফেললেন। একে তো হোমসমাজের সবচাইতে নিচুতলার বাসিন্দা ডলি এবং তাঁর মতন আবাসিকের দল, তদুপরি, খুব ভোরে উঠে থেকে ইস্তক হাড়ভাঙা খাটুনি: ঝাড়ু দাও, মোছো, ধোয়াধুয়ি করো, রান্না চাপাও, কাঠ কুড়োও, দূরের ঝরনা থেকে জল নিয়ে এসো। বিন্দুমাত্র সময় নেই অন্য কিছুর, বিশ্রামের, খেলাধুলোর। বাইরের যে বাস্তবের মধ্যে গিয়ে আজ না হয় কাল পড়তেই হবে, তার জন্য তৈরি হও, তৈরি হও, তৈরি হতে থাকো। পরিশ্রম, সঙ্গে ধর্মশিক্ষা, সকাল থেকে সন্ধ্যা, সপ্তাহের প্রথম থেকে শেষ। এক বড় ছুটির সময় কিছু ছাড়, কিছু অবসর,পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর, খেলা করার, মাটিতে শুয়ে থাকবার। বাকিটা লৌহদৃঢ় নিয়মানুবর্তিতা। ডিক্সন বলছেন, ভালবাসার কথা প্রচার করা হতো বটে, ভালবাসা অভ্যাস করা হতো না।

প্রতি বছর হোমের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে খুব ধুমধাম হতো। প্রথম প্রথম স্কুলবাড়িতে শিক্ষকেরা অনুষ্ঠান করতেন, ১৯০৬ থেকে নতুন তৈরি জার্ভি হলে বড় করে উদযাপন শুরু হয়। আবাসিকরা সবাই সার দিয়ে দাঁড়াতো, সমবেত গান হতো, আনন্দিত চিত্তে চলো বলি, দয়াময় ঈশ্বরকথা সকলি। জার্ভি হলের উদ্বোধন হয় বাংলার ছোটলাট সর এল হেয়ারের হাতে। স্কটল্যান্ডের মেজর জার্ভি প্রদত্ত অর্থে হল তৈরি, সেকারণে প্রয়াত মেজরের নামে নাম। ১৯০৬, মানে হোমের একটু বড় বাসিন্দারা তখন বাইরের উপনিবেশে যেতে শুরু করেছে। হোমে নতুন ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে নিয়মিত, ১৯০৭ এ সুন্দর ঘড়িঘর তৈরি হলো, তারপর হাসপাতাল, আরো কটেজ। ছেলেদের কেউ শিখছে চাষের কাজ, কেউ কাঠের। মেয়েরা শিখছে ঘরের কাজ, উল বোনা, হাতের কাজ। বিশেষ করে ঘরের কাজ, উপনিবেশে ঘরের কাজ জানা মেয়েদের খুব কদর।

১৯১২ সালে, এলাহি বিদায় সম্বর্ধনার আয়োজন হলো, এক ঝাঁক বড় ছেলেমেয়ে চলে যাচ্ছে নিউজিল্যান্ড। কালিম্পং থেকে দার্জিলিং, খেলনা রেলগাড়িতে করে শিলিগুড়ি, সেখান থেকে বড় ট্রেনে চেপে কলকাতা। কলকাতা থেকে এস এস সঙ্গোলা জাহাজে চড়ে মেলবোর্ন, জাহাজ বদলে এস এস ওয়ারিমোতে চেপে ডুনেডিন। সব মিলিয়ে দু মাসের ধাক্কা। ছ জন মেয়ে, সাত জন ছেলের দলে কুড়ি বছরের ডলি হিগিন্সও ছিলেন। কলকাতার ওয়েলেসলি স্ট্রিটের ইউনাইটেড ফ্রি চর্চ, তার হলে তরুণ অভিযাত্রীদের বিপুল সম্বর্ধনা দেওয়া হলো, কলকাতার শেরিফ মি. আর এচ গ্রেসন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন। কলকাতার হোমবন্ধু সমিতি থেকে অনেকে এসেছিলেন, সবাই মিলে খুব হইহই। প্রত্যেক দেশান্তরীকে একটা করে নতুন বাইবল দেওয়া হলো, সঙ্গে একটা করে স্তোত্রগ্রন্থ। সবাই ভালো ভালো কথা বললেন, বিশেষ করে শেরিফ গ্রেসন। ইংল্যান্ডের প্রশিক্ষণ জাহাজে যে ছেলেদের পাঠানো হয়েছে, তারা খুব উন্নতি করেছে, বাণিজ্য তরীতে কাজ পেয়েছে। কেউ জানতেন না, মাত্র দেড় বছর পরে শুরু হবে যে বিশ্বযুদ্ধ, তাতে এই ছেলেদের বেশিরভাগই মারা যাবে।  তখনকার মতো সবার খুব আনন্দ, কালিম্পং থেকে আসা দলেরও, সবাই মিলে খুব খাওয়াদাওয়া হলো। কে জানতো, এত বছর একসঙ্গে কাটানো এই দলটার লোকজন কে কোথায় ছিটকে চলে যাবে, নিজেদের মধ্যে আর দেখাসাক্ষাৎ হবেই না। হোমের কঠোর অথচ নিশ্চিন্ত নিশ্চিত জীবন থেকে গিয়ে পড়তে হবে নতুন দেশের নতুন সমাজের অনিশ্চয়তায়, কী খাওয়া কী পরা কোথায় থাকা কিছুরই স্থিরতা নেই।

সে সব পরের কথা। জাহাজঘাটায় হোমবন্ধুরা ভিড় করে এলেন, আরো অনেকে, আগের দিনের উৎসবের খবর ছবি কাগজে বড় করে বেরিয়েছে। যাই হোক, যাত্রা শুরু হলো, এস এস সঙ্গোলা জাহাজে উঠে পড়লেন সবাই। ডিক্সন জানাচ্ছেন, স্কটল্যান্ডে তৈরি এই জাহাজ ১৯০৮ থেকে ১৯১০ অবধি কলকাতা এবং মাদ্রাজ থেকে কুলি তুলে ফিজিতে চালান দিতো, অন্তত গোটা ছয়েক এরকম যাত্রার কথা জানা যাচ্ছে। ১৯১২ সালে, কালিম্পং হোমের অনাথ ইউরেশিয় ছাত্ররা কুলি খাটতে না হোক, মজুর খাটতে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের সাদা ব্রিটিশ উপনিবেশে যাত্রা করলেন।

 

 

দশ

কলকাতা থেকে পুরো ছ’হাজার সমুদ্রমাইল বা (ন্যোটিকাল মাইল) পাড়ি দিয়ে মেলবোর্ন। পথে জাহাজ থেমেছে রেঙ্গুনে, ব্রিটিশ মালয়দেশের পেনাঙে, অন্যত্র। যেখানেই থেমেছে স্থানীয় সায়েবসমাজ হোমের দলটাকে বিশেষ খাতিরযত্ন আদরআপ্যায়ন করেছে। এমনকি প্রথম ধাপের যাত্রা শেষের মেলবোর্নেও বিস্তর যত্ন আত্তি মিলেছে। ডুনেডিন পৌঁছে সব বদলে গেলো।যে বন্ধুরা একসঙ্গে ছিলো, তাদের দ্রুত নিজের নিজের কাজের জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। শহর ঘোরা নয়, চায়ের পার্টি নয়, ভাষণ নয়। অনেক মজা হয়েছে, এখন যাও, খাটো, সাম্রাজ্যের গৌরববর্ধন হোক। ছেলেরা গেলো খামারে খাটতে, মেয়েরা বাড়ির কাজে। একা, সহায়সম্বলহীন ডলি নতুন দেশে অজানা অচেনা পরিবেশে ডুনেডিনের এক পরিবারে কাজে লাগলেন। বাড়ির সব কাজই প্রায় করতে হতো, কাপড় কাচা, ইস্ত্রি করা, ঘর মোছা, বাজার করা, হিসেব রাখা। এই বাড়িতে থাকতে থাকতেই এক মাওরি যুবকের সঙ্গে আলাপ, প্রেম, ঘনিষ্ঠতা। বিয়ের সব মোটামুটি ঠিকঠাক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো, ডলির প্রেমিক লেক্স মাওরি রেজিমেন্টের হয়ে যুদ্ধ করতে গেলেন, আর ফিরলেন না। অথচ তাঁর সন্তান তখন ডলির গর্ভে।

ডলি অকূল পাথারে পড়লেন। শরীরের এই অবস্থায় কোনো বাড়িতে বা পরিবারে থাকা বা কাজ করা অসম্ভব, ফলে তাঁকে আবার একটা হোমে যেতে হলো। তাঁর আগে নিজের সমস্যার কথা বলে তিনি হোমের বন্ধু মেরিকে(হোম থেকে আসা দলের মধ্যে মেরি ছিলেন) চিঠি দিচ্ছেন, মেরি পরামর্শ দিচ্ছেন গ্রাহামকে চিঠি লিখে সব খুলে বলতে, কালিম্পং এর হোমই তো সবার একমাত্র বাড়ি, আর তিনিই তো সবার বাবা, কিছু উপায় নিশ্চয় করবেন। ডলি সেইমতো লিখলেন, চিঠির অপেক্ষায় বসে থাকলেন মাসের পর মাস, হোম থেকে কোন উত্তর এলো না, গ্রাহাম কিছু বললেনই না। এদিকে সময় এগিয়ে আসছে, যে বাড়িতে কাজ করতেন তার গৃহকর্ত্রীকে বলতেই হলো। তাঁর মাধ্যমে, বা অন্য কোনও ভাবে, ক্রাইস্টচর্চের মহিলা আবাসে তাঁর ঠাঁই হলো। সদ্যোজাত শিশু ক্যাথলিনকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে কাটালেন বেশ কিছুকাল, যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। তারপর আবার একটা নতুন বাড়ি, আবার কাজে লাগা। যে পরিবারে ডলি কাজ করতে গেলেন, সে বাড়ির বড় ছেলে নিয়মিত তাঁকে ধর্ষণ করতো, ফলে পেটে আবার বাচ্চা এলো। আবার ঠাঁইনাড়া হওয়া, আবার হোম। ক্যাথলিনের বয়স তখন চার। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাবে না, তাকে অন্য পরিবারে দিয়ে দিতে হলো। হোম থেকে আবার একটা কাজের বাড়ি, কাজ করতে করতে আর একজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব, প্রেম। সেই প্রেমিক যে বিবাহিত, ডলি জানতেন না, ফলে যা হবার হলো। ডলি যখন বুঝলেন তিনি পুনরপি সন্তানসম্ভবা, প্রেমিকপুরুষটি দিগন্তে বিলীন হয়ে গেছেন। অবশ্য তিনি পরে ফিরে আসবেন, নিজের ছেলেকে দত্তক নেবার ব্যবস্থাপত্রও করবেন।

এসবের পরে, ডলির বার দুয়েক বিয়ে ও আরো সন্তানাদি হয়। দুই স্বামীই মোটের ওপর নিষ্কম্মা, অত্যাচারী, দ্বিতীয় জন তদুপরি চূড়ান্ত মাতাল। এই বাড়ি ওই বাড়ি ও এই হোম ওই হোম করে ডলির জীবন কেটেছে, ১৯৫৪ সালে যখন মারা যাচ্ছেন, বরাবরের মতোই তিনি সহায়সম্বলহীন, কপর্দকশূন্য।

 

(ক্রমশ)

 

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *