সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ২৩। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

সাত

বদলাতেই হয়। গ্রাহামের ইস্কুলবাড়ির কথাই ভাবুন। এখনও যখন যাই, আজকের কালিম্পং-এর সরু সরু ঘিঞ্জি ভিড়ঠাসা পথঘাট পেরিয়ে আপনিও যখন যাবেন, মনে হবে, এ তো অন্য জগৎ, অন্য সময়। গ্রাহাম সায়েবের পুরোনো বাড়ির সামনে নজরচৌকি বসানো, সেখানে নাম লিখিয়ে চড়াই ঠেলে আপনি ইস্কুলের আঙিনায় ঢুকবেন, হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ে চড়বেন, কেট গ্রাহামের স্মারক হিসেবে নির্মিত ক্যাথরিনস চ্যাপেল নামের সুদৃশ্য ছোট্ট গির্জাবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে দেখবেন, রোদে ভিজে আছে সাদানীল বাদামিহলুদ পাথরে কাঠে তৈরি চিমনিওলা বাড়ি, বড় বড় ওক আর পাইনগাছের সবুজ পাতা, এখানে ওখানে ঘেসো জমি, ছোটবড় মাঠ। কিম্বা পাহাড়ে যেমন হয়, প্রথমে ছেঁড়া ছেঁড়া, পরে ঘন সাদা মেঘ উঠে ও উড়ে আসবে পাহাড়ের গা বেয়ে, এত ঘন ফুট দুই দূরে কি আছে ঠাওর হয় না, শুধু এখানে ওখানে ঝাপসা হয়ে যাওয়া রঙ, সাদা, কালো, নীল, মেটে লাল, হলদে, ধূসর। অথবা, আমার যেমন হয়েছে বেশ কয়েকবার, টিপটিপ ঝরঝর বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই, সেই বৃষ্টির মধ্যে দোল খাচ্ছে লাল সোয়েটার, ছাপছাপ ফুলফুল রঙিন ছাতা, ক্লাস ভাঙলো, বাচ্চারা যে যার হোস্টেলের দিকে।

অন্য বহু জায়গায় যেমন হয়েছে, গ্রাহামসাহেবের জায়গাটা বাইরে থেকে বদলায়নি। হোমপত্তনের পর থেকে একটা গোটা শতাব্দী ও নিদেনপক্ষে এক কুড়ি বছর কেটে গেছে, হোমের চারপাশে লম্বা বাঁকা চৌকো চ্যাপ্টা বাড়ির জঙ্গল, বাইরের রাস্তা দিয়ে দেয়লো পাহাড়ের মাথায় বানানো নতুন পার্ক দেখবার জন্য ট্যুরিস্টভর্তি গাড়ি সকাল থেকে দৌড়চ্ছে। হোমের বর্তমান কর্তাদের ধন্যবাদ দিতে হয়, অন্তত নিজেদের জায়গাটাকে তারা বাঁচিয়ে রেখেছেন। রেখেছেন বলেই না আমি ডরসেটের গ্রামে ছবিগুলো পাঠাতে পারলাম, গ্রাহামের সাক্ষাৎ ছাত্র এক অদেখা পাহাড়ি মহিলা নিজের ছোটবেলার কথা মনে করতে পারলেন তৎক্ষণাৎ।

হোমের আবাসিকদের খালি পায়ে হাঁটতেই হতো, যে কথা ডরসেটের মহিলাও বলেছেন। মিজুতানির লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, গ্রাহামসায়েবের চালু করা সেই প্রথা চলেছিলো গত শতকের ষাটের দশকের প্রায় শেষ পর্যন্ত। স্কটদেশের বারনারডোর কটেজে এই নিয়ম চালু ছিলো, স্কটল্যান্ডের দেখাদেখি কালিম্পং-এও। গ্রাহাম নিশ্চয় কালিম্পং পাহাড়টাকে স্কটল্যান্ডই ভাবতেন একরকম। স্কটল্যান্ডের মাটি, কালিম্পং-এর মাটি, ছোঁয়া লাগলে গরীব ইউরেশিয় বাচ্চারা বিলাস শেখে না, তাদের অপদার্থ বাপ-মাদের মতো নিজেদের অবস্থা বিস্মৃত হয় না, নিজের কাজ নিজে করতে শেখে।

হোমের ইউরেশিয়(বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান) বাচ্চাদের কথা আগে বলা হয়েছে, আরো বলা হবে। হোম থেকে, হোমের বাইরে থেকেও ভারতের ইউরেশিয়রা লাগাতার ও অবিরলভাবে দেশের বাইরে গিয়েছেন, প্রথমটায় কানাডায় ও নিউজিল্যান্ডে, পরে অস্ট্রেলিয়ায়। দেশের মধ্যেও অ্যাংলো সায়েবরা নিজেদের দ্বীপদুনিয়া বানানোর চেষ্টা করেছেন, যেমন অধুনা ঝাড়খণ্ডের ম্যাকলাকসিগঞ্জ। মিজুতানি বলছেন হোমের ছেলে ছাত্রদের তুলনায় মেয়ে ছাত্রদের চাকরিভাগ্য ভালো ছিলো, নার্সিং প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই হাসপাতালে চাকরি পান, সায়েবরাজত্বে ওই কাজে বাঙালি ঘরের(বা দিশি) মেয়েরা বড় যেতেন না। বাকি যারা পড়ে থাকতেন, সায়েবি উপনিবেশে যাঁদের ঠাঁই হতো না, তাঁরা সব কোথায় থাকতেন? কলকাতার বো ব্যারাকের মেটেলাল বাড়িগুলোয়, বা ওয়েলেসলি অঞ্চলের গলিঘুঁজিতে, কিম্বা পার্ক স্ট্রিট পার্ক সার্কাস এলাকায়? সে গল্পের মধ্যে ঢুকবার সুযোগ নেই, বরং অ্যান্ড্রু মে কি বলছেন, আর একবার দেখা যাক।

বেসিল এ নামের হোমের এক প্রাক্তনী ১৯৪৯ সালে পার্ডিকে চিঠি লিখছে।ব্যক্তিগত কিছু কাগজপত্র পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে ওমর খৈয়ামের রুবায়েৎ তুলে দিয়ে বেসিল বোঝাতে চাইছিলো, সাম্রাজ্যের নাগরিক হয়ে ওঠার কাজটা তার মতো প্রাক্তনীদের( হোমের পুরোনো ছাত্রদের ডাকা হতো, এখনো হয়, ওজিবি বলে—অর্থ, ওল্ড বয়েজ অ্যান্ড গার্লস)  কাছে ঠিক কতটা কঠিন ছিলো: ‘রাতদিনের চৌকোকাটা ছকে/ সে খেলে, অসহায় গুটি চালে নখে’। অ্যান্ড্রু বলছেন, আরো কেউ কেউ  নিজেদের মিশ্ররক্তের উত্তরাধিকারকে জেনেছে ‘প্রথমাবধি ভুল’ বলেই, যেমন ডোনাল্ড কে(১৯৪৭ সালের চিঠি):

জন্মের সময় আমাকে মেরে ফেলা হলে কত ভালো হতো! মানসিক উৎপীড়নে ভরা এই জীবনটাকে তাহলে সহ্য করতে হতো না…কোন কিছুর ওপরেই আমাদের আইনসঙ্গত দাবি নেই, যেখানেই যাই, কুৎসিত নির্মম মন্তব্য সব শুনে যেতে হয়…বাইবেলের সেই অংশ, যেখানে বলা আছে ‘পিতার পাপ তাহাদিগের সন্তানকুল মাথি বর্ষিবে’…এটা পড়ে সম্ভবত তাদের নিজেদের বিবেক সান্তনা পায়, আমাদের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে, লঘু হয়ে যায়…

আট

হোমফেরৎ সমস্ত ছাত্রদের কি গতি হয়েছে বুঝবার জো নেই। একশো কুড়ি বছর মানে নিদেনপক্ষে পাঁচ প্রজন্ম, সবার ইতিবৃত্তান্ত খুঁজে বার করাটা একেবারে অসম্ভব না হলেও কঠিন, দুঃসাধ্য। ওজিবি বা হোমের প্রাক্তনীরা কি করছেন এখন খুঁজতে গিয়ে দেখা গেলো, অনেকেই নিয়মিত কালিম্পং-এর  সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, নানান প্রয়োজনে অর্থসাহায্য করেন। তাঁদের একটা বড়সড় সংগঠনও আছে, গ্লোবাল ওজিবি অ্যাসোসিয়েশন বা বিশ্ব ওজিবি সংস্থা নামে, সংক্ষেপে ‘গো’। গো-র ওয়েব সাইটে গিয়ে জানা গেলো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা হোমপ্রাক্তনীরা তাঁদের পুরোনো ইস্কুল এবং ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য কি কি করছেন। ফেসবুক-এও এঁদের একটা আলাদা পাতা আছে, সেখানে ঢুকে সাম্প্রতিক এক বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেলো। ২০২৪-এর মার্চ মাসে প্রকাশিত এই বইয়ের নাম ডলি:দি জার্নি, লেখক জান ডিক্সন। সংগ্রহ করলাম। গবেষণামূলক লেখা(লেখকের উদ্দেশ্য সেরকম ছিলোও না)হিসেবে যে খুব যুতের, বলা যাবে না। কিন্তু যে গল্পে আমরা আছি, সে গল্পের প্রসঙ্গে বা ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, ডলি, অর্থাৎ ডরোথি এথেল হিগিন্স নাম্নী যে মহিলার জীবনকথা এই বইতে বলা হয়েছে, তিনি কালিম্পং-এর হোমের প্রথম আবাসিকদের অন্যতম। ১৯০১ সাল নাগাদ বালিকা ডলি হোমে থাকতে আসেন। বই থেকে জানা যাচ্ছে, তাঁর বাবা ফ্রেডরিক আসামের চা বাগিচায় কাজ করতেন, তাঁদের পারিবারিক বাড়ি ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ার অঞ্চলের হ্যাম্বলডন গ্রামে, কলকাতাতে নিজের বাড়ি। ডলির মায়ের নাম ছিলো মার্গারেট, দার্জিলিং-এর ইডেন হাসপাতালে তিনি নিতান্ত অল্প বয়সে মারা যান, ডলির বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। এর পরপরই, ফ্রেডরিক কলকাতায় ডলিকে তাঁর বোনের জিম্মায় রেখে আসামে তাঁর কর্মস্থলে ফিরে যান, আর ফেরেন না, ১৮৯৭-এর ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে তাঁর মৃত্যু হয়। অতএব অনাথ ডলিকে ইংল্যান্ডে না পাঠিয়ে কলকাতার সেন্ট মেরিজ হোমে পাঠানো হয়। সেই দাতব্য প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে তখন অ্যালিস কোমলে, উদ্যোগী সমাজসেবী, তৎকালীন কলকাতার খ্যাতনামা ডাক্তার জন কোমলের স্ত্রী। অ্যালিসের সঙ্গে গ্রাহামের বিশেষ পরিচয় ছিলো। কলকাতার হোমে( কালক্রমে এইটিই কি এখনকার দমদমের সেন্ট মেরিজ ইস্কুল হয়ে উঠেছিলো? খুঁজেটুজে দেখলাম, মুরগিহাটার আদি সেন্ট মেরিজ অনাথশালাটি পরে দমদমে উঠে যাচ্ছে বটে, কিন্তু সেখানে তো স্রেফ ছেলেদের রাখা হতো! তাহলে?) থাকতে থাকতেই ডলির ফুসফুসে সংক্রমণ হয়, আর একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁকে অ্যালিস পাঠিয়ে দেন দার্জিলিং-য়ের ইডেন হাসপাতালে, যার পোশাকি নাম সে সময় ইডেন স্যানাটোরিয়াম। সেখান থেকে কালিম্পং, ড্যাডি গ্রাহামের জিম্মায়, তাঁর হোমের নাম তখন সেন্ট অ্যান্ড্রুজ কোলোনিয়াল হোম। ডলির দেখভাল বা পরিচর্যার জন্য কোন পয়সাকড়ির বন্দোবস্ত ছিলো না, ডক্টর গ্রাহামকে অ্যালিস বারবার সনির্বন্ধ অনুরোধ করছেন, তাঁকে যেন বিনি পয়সায় কালিম্পং হোমে রাখা হয়।

ডলির মা মার্গারেটের সঙ্গে তাঁর বাবা ফ্রেডরিকের নিয়মমাফিক বিয়ে হয়েছিলো কিনা,  মার্গারেট বা ডলির গায়ে কতটা য়ুরোপীয় ও ক ছটাক দিশি রক্ত, সে তথ্য ডিক্সন দিয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু তাঁর বই থেকে একটা খবর জানা গেলো। আজীবন ডলি জানতেন, তাঁর জন্মস্থান এডিনবরা, যাবতীয় কাগজপত্রে আগাগোড়া সেভাবেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন। ডিক্সন বলছেন, গ্রাহামের পাহাড়ি বাড়ি এতটাই নির্জন বিচ্ছিন্ন ছিলো, এবং সে বাড়ির পরিবেশ, আদবকায়দা এবং মহল্লা সব এতই অ–ভারতীয়, ও সাদা খ্রিস্টান মার্কা ছিলো, স্কটল্যান্ড থেকে বিশেষ আলাদা করা যেতো না। ফলে, ডলি যে এডিনবরাকে নিজের জন্মস্থান জানবেন, এতে আশ্চর্য কী?

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *