সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ২২। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

ছয়

হোমের প্রাক্তনীকথন

মারা যাবার বছর কয়েক আগে, আমার বৃদ্ধ দিদিমা বলেছিলেন, আমাদের দুই দাদুই ইংরেজ(ইংলিশম্যান), আর আমার বাবার মা এ দেশে বসবাসকারী উরোপীয়, কিন্ত কোথায় তাঁদের জন্ম না জানা থাকায় বিশেষ অসুবিধে হচ্ছে। দয়া করে আমাকে যদি একটু বলেন পাসপোর্টের আবেদনপত্রে কী লেখা যায়, আরো ভালো হয় যদি আমাকে একটা সুপারিশপত্র দেওয়া যায়, সেখানে যদি বলা যায় আমি জন্মসূত্রে ইউরোপিয়, একজন কালিম্পং নিবাসী বালিকা, এবং ইস্কুলে আমার আচরণ পড়াশুনা বরাবরই  ভালো….

যদি আমাকে কলকাতার অস্ট্রেলিয় বাণিজ্য কমিশনারের নামে একটা চিঠি লিখে দেন, চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। চিঠিতে শুধু লিখতে হবে, দুর্ভাগ্যক্রমে আমি এই পৃথিবীতে আজ অনাথ, কিন্তু আমার বাবা ছিলেন একজন ইংরেজ চা-কর, এবং আমার মা একজন ভারতীয় ভদ্রমহিলা।

এই প্রশ্নোত্তর আমার মেয়ের দেশান্তরণ(মেয়েকে আমি অস্ট্রেলিয়া পাঠাতে চাই) বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ…আমাকে শুধু প্রমাণ করতে হবে যে আমার বাবা উরোপীয় ছিলেন…

আমি জানি আমার বাবা ছিলেন স্কটসম্যান, কিন্তু আপনার পক্ষে কী লেখা সম্ভব হবে যে আমার মা ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, ভারতীয় নন? আমার খুব সুবিধা হয় তাহলে…আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন…

শিশু বয়সে আমি নেপালি ভাষা শিখি। ভাবছিলাম, আমার প্রিয় মা কী তবে নেপালি জাতির মানুষ ছিলেন? যদি এটা প্রমাণ করা যায়, আমি কী তবে নেপালের নাগরিকত্ব চাইতে পারি, যদি আমার সেরকম ইচ্ছা হয়?

আমার বাবার জন্মপত্রিটা যদি পাওয়া যায়(যেমন অনেকেই জোগাড় করেছে), তাহলে চাইকি আমি একটা ব্রিটিশ পাসপোর্টও খামচেখুমচে বার করে ফেলতে পারি। কেমন লাগবে যদি এক পকেটে ব্রিটিশ পাসপোর্ট থাকে, আর অন্য পকেটে ভারতীয়? এবং, বুকপকেটে থাকে বর্মী পাসপোর্ট?

ওরা শুধু নিশ্চিন্ত হতে চায়, আমাদের বাবারা সবাই ছিলেন ব্রিটিশ। আমাদের বাবা মায়েরা কী পাপ করেছেন তার দায় আমাদের ওপর চাপবে কেন? অথচ আমাদেরই সারা পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়, শুনতে হয় রাজ্যের কুৎসিত মন্তব্য….

পত্রলেখকদের নাম অ্যান্ড্রু দিয়েছেন পাদটীকায়: বারবারা, হেলেন, অ্যালান, টম, ডিক, এলাইজা। কেউ লিখছে জামশেদপুর থেকে, কেউ কলকাতা, বাকিদের কথা বলা নেই। স্কটল্যান্ডের ভেজা হিমেল ঠান্ডায় জমে আছে গ্রাহামের স্বপ্নের ভাবী ও আদর্শ সাম্রাজ্যসৈনিক, কিম্বা শ্রমিকরা, তাঁদের জন্মযন্ত্রণার, ব্রিটিশ বাবা খোঁজার, খুঁজে বেড়ানোর তাল তাল দলা পাকানো ইতিহাস। ইউরেশিয় সমস্যার সমাধান হতে হতে, সাম্রাজ্য মিলিয়ে গেলো হাওয়ায়। সায়েবরাজত্বে, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা চিরটাকাল শিখে এসেছেন, তাঁরা বিজেতাদের, প্রভুদের জাত, সাম্রাজ্যশাসকদের পবিত্র শ্বেত রক্ত তাঁদের শিরায় প্রবাহিত, সাম্রাজ্যবিহীন শূন্যে, সায়েববর্জিত ভারতে তাঁরা থাকেন কী করে?

কালিম্পং দার্জিলিং মুসরি নৈনিতাল সিমলা, হিমালয়ের এই সব নামজাদা শহরে, কী ভারতের অন্যত্র যেখানে যা উচ্চভূমি বা হাইল্যান্ড, কিম্বা পাহাড়টাহাড় মওজুত, যেখানে এখনো সায়েবী হেরিটেজ খুঁজতে চাখতে অথবা নেহাতই ঠান্ডা হতে বা ফুর্তিটুর্তি করতে লোকজনের পিলপিলে ভিড় গরম বর্ষা শীত মানে বছরভর আছড়ে পড়ছে, সাম্রাজ্য, জাত ও ঠান্ডা হবার বাসীজ্যান্ত গল্প সে সব ছুটিখানার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কি করে জমে থাকে, দার্জিলিং এর গল্পকথায় খানিক এসেছে। সব পাহাড় সমান নয়, সব পাহাড়ি শহরও নয় দার্জিলিং, তথাপি এই  পুরোনো   ‘রাজ’ ডেরাগুলোর যে গল্পের ভেতরেই ঢোকা যাক, অনেকদিনের জমে থাকা নাছোড়বান্দা ও হয়তো বা কিয়দাংশে অবধ্য শ্যাওলাছত্রাকের মতো, সাম্রাজ্যের গল্পের আঁশ রোঁয়া সেখানে লেগে থাকবে। থাকবেই। এই যে এই ভাবনাটা, আপনার চাদ্দিকে দুনিয়ার শত্রু বর্বর অসভ্য নেটিভ ও বিচ্ছিরি রোগজারীভর্তি বনজঙ্গল কিলবিল কিলবিল করছে, তৎসহ শরীরমন জ্বালিয়ে দেওয়া পচা গরম, তার মাঝখানে আপনি সায়েব সাদা চামড়া মোতায়েন, এমন কল করবেন যে বাইরের দুনিয়ার গন্ধটি অবধি সেখানে ঢুকতে পাবে না। আপনার থাকবার খাবার জায়গা দ্রব্যাদি তরিকা সব ভিন্ন রকমের হবে, পুরোনো বন্য নিসর্গকে বশে এনে আপনি ঠান্ডা সাদা নিরাপদ বানিয়ে ফেলবেন, একদম নিজের দেশের মতো, দেশের বাড়ির মতো ছোটবড়ো চিমনিওলা কটেজ ভিলা ম্যানর বাংলো বানানো হবে, সামনে লন বাগান ফুলগাছ। নচেৎ আপনি নিজের মতো করে একটি জমিদারি বানিয়ে নেবেন, চা বাগিচা, বন, সিঙ্কোনা বাগিচা, পাহাড়ি শহর, ক্যান্টনমেন্ট, কিছু না হলে সায়েবপাড়া বা সায়েববাড়ি। গ্রাহাম সায়েব জমিদার ছিলেন না, প্রজাশাসন করে বা কুলি খাটিয়ে ব্যবসা করে প্রচুর টাকাকড়ি রোজগারের চেষ্টা করার উদ্দেশ্যে তিনি কালিম্পং-এর হোম খুলেছিলেন, এমন কথা শত্তুরেও বলে না। অথচ দেখুন কি কল, হোম বানানোর পিছনে যে ভাবনাটা কাজ করছে আগাগোড়া, সেটা সেই আদি নির্বিকল্প সায়েবভাবনা, অর্থাৎ দেয়াল তোলো, তোলো, তুলতে থাকো, তুলতে তুলতে আলাদা করো, হও, থাকো, রাখো। সবার ওপরে মহান ঈশ্বর, তাঁর প্রতিনিধি রাজা কী রাণী, তাঁর খোদ দূত হিসেবে সায়েব অভিজাতবর্গ, অফসরলোগ, জজম্যাজিস্টর, নিদেন পক্ষে বাগিচামালিক, কোম্পানির ডিরেক্টর। ওই পরম্পরা ধরে সায়েব পাদ্রিবাবাসকল, সমাজসংস্কারক, শিক্ষাস্বাস্থ্য ইত্যাদি। আঠেরো শতকের শেষাশেষি, য়ুরোপ জুড়ে বিখ্যাত অস্ট্র-প্রাশ্যন সাম্রাজ্যের নিয়মিত দবদবা, বিখ্যাত জর্মন দার্শনিক হেগেল বলেছিলেন, দ্যাখো হে, এই হচ্ছে সৃষ্টির অন্তিম, চূড়ান্ত বিকাশ, চেহারা, রুপ? সভ্যতা আর কত উঁচুতে উঠবে? হায়, রাত পোয়াতে না পোয়াতে ফ্রান্সে শুরু হলো অগ্নুৎপাত, সেই সঙ্গে বিপ্লব বিদ্রোহ, ছোটলোকদের বড় হবার চেষ্টা। য়ুরোপ ছারখার হয়ে যাচ্ছিলো একের পর এক অভ্যুত্থান বিপ্লবে, যুদ্ধের পর যুদ্ধের পর যুদ্ধে, অথচ য়ুরোপ থেকে বহু বহু দূরে একের পর এক উপনিবেশে সায়েবরা সাম্রাজ্যবন্ধু ও নিরাপদ দ্বীপসমাজ গড়ে তুলছিলেন। সম্ভবত অন্য কিছু তাঁরা ভাবেননি, ভাবতে চানও নি।

কালিম্পং হোমের কিন্ডারগার্টেন ইস্কুলবাড়ির দেয়ালে খোদাই করা ছবিটা থেকে আমরা ইউরেশিয় সমাজের যে গল্পে পৌঁছে যাই, সে গল্পটাও আসলে ওই একটা বড় গল্পেরই অন্য, ছোট ভাগ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যেভাবে পৃথিবীর তিনটে চারটে মহাদেশ থেকে বেমালুম উবে গিয়েছে, সাম্রাজ্যকর্তা ও সাম্রাজ্য সেবকরা যৌথ উদ্যোগে যে সব ‘নিরাপদ’ ও ‘হোমলাইক’ ছোটবড় খোপখুপরি ও পাড়া, শহর, নিসর্গ তৈরি করেছেন, সেগুলোও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নিছক জায়গাগুলো থেকে গিয়েছে হয়তো, বদলে গেছে সে জায়গার চরিত্র।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *