সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৩৯। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

সঙ্ঘরক্ষিতা
……………………………
মনিলার, তাঁর বলা গল্পে ফেরত আসা যাবে। আপাতত, দূরবীন পাহাড় থেকে নেমে আসা, তিস্তা ও রিললি নদীর মধ্যেকার খাড়া গিরিশিরায় জমে থাকা যে সব গল্পের মধ্যে ঢুকতে চাইছি, তার দ্বিতীয় প্রধান সূত্র, অর্থাৎ, সঙ্ঘরক্ষিতার কথায় আসি। থেরাবদি বা হীনযানপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষু সঙ্ঘরক্ষিতার আসল লম্বা নাম ডেভিড ফিলিপ এডওয়ার্ড লিংউড, তিনি জন্মেছিলেন ও মারা গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। জন্ম ও রক্তসূত্রে পাক্কা ব্রিটিশ সায়েব লিংউড-সঙ্ঘরক্ষিতা সুদীর্ঘ জীবনে(জন্ম ১৯২৫, মৃত্যু ২০১৮, মানে তিনি বেঁচে ছিলেন ৯৩ বছর) নানান রকম গল্পের মধ্যে ঢুকেছেন বেরিয়েছেন, যার সবটা খুব সুবিধার ছিলো না। তাঁর তৈরি ধর্মগোষ্ঠী ওরফে কাল্ট অদ্যাবধি চালু, ব্রিটেন ও ব্রিটেনের বাইরে শিষ্যমন্ডলী ছড়িয়ে, এখনো বহু মানুষের কাছে তিনি গুরুস্থানীয়। এহেন এক ব্যক্তির জীবনকথা কিম্বা ভাবনাচিন্তা নিয়ে অনেক কিছু বিশদে বলবার সুযোগ নেই, শুনতেবলতে চাইছি তাঁর বলা কালিম্পংকথা, তাঁর কালিম্পঙবাসের কাহিনী। মানুষ হিসেবে যেমনই হোন, সঙ্ঘরক্ষিতা সুলেখক, বেশ গুছিয়ে, রসিয়ে গল্প বলতে পারতেন, বৌদ্ধ ভিক্ষু হলে কী হয়, পরনিন্দা পরচর্চা ইত্যাদিতে বিস্তর উৎসাহ ছিলো, সেই সঙ্গে টপাটপ কেচ্ছাটেচ্ছাতেও। সত্যি বলতে কী, আজীবন তিনি কেচ্ছামন্ডিত থেকেছেন। সে গল্পের টুকরোটাকরা আমরাও চাখবো নিশ্চয়। এখন প্রথম পঞ্চাশের কালিম্পঙ, তা নিয়ে লিংউড-সঙ্ঘরক্ষিতা কথিত গল্পগাছা।
বৌদ্ধ ধর্ম ও নিজের জীবন নিয়ে সঙ্ঘরক্ষিতা অনেক লিখেছেন, তাঁর মৃত্যুর আগে থেকেই শিষ্যরা সেসব খন্ডে খন্ডে বার করছেন। ২০১৭তে প্রকাশিত, রচনাবলির কুড়ি নম্বর খন্ড সঙ্ঘরক্ষিতার আত্মজীবনী, দি রেইনবো রোড: টুটিং ব্রডওয়ে থেকে কালিম্পং, জনৈক ইংরেজ বৌদ্ধের স্মৃতিকথন নামে আলাদা বই হিসেবেও বার হয়েছিলো ১৯৯৭ সালে। সে বই দুষ্প্রাপ্য, লিংউডের স্মৃতিরক্ষার্থে তৈরি ইংল্যান্ডের উর্গেন সঙ্ঘরক্ষিতা ট্রাস্ট, এবং উইন্ডহর্স পাবলিকেশনস যৌথভাবে যে রচনাবলি প্রকাশ করেছে, তা অনায়াসে পাওয়া যায়। রেইনবো রোডের একেবারে শেষ অংশে, এছাড়া ১৯৯১-তে প্রকাশিত ফেসিং দি কাঞ্চনজঙ্ঘা: পূর্ব হিমালয়ে এক বৌদ্ধ ইংরেজ বইয়ে(উইন্ডহর্স) কালিম্পং প্রসঙ্গ বিশদে এসেছে। ১৯৬২ সালের অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে কালিম্পং(অনেক পরে গিন্সবার্গ বলেছিলেন বৌদ্ধ লামাদের খোঁজে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন স্রেফ এলএসডি নেওয়া বন্ধ করার উপায় খুঁজতে) নামের আর একটা ছোট লেখার কথা জানা যায়, সেটা পাওয়া গেলো না। গিন্সবার্গ নিজে সঙ্ঘরক্ষিতাকে নিয়ে কিছু বলেছেন কিনা, সন্ধান পাওয়া গেলো না। সত্যকথন বিষয়ে লিংউড-সঙ্ঘরক্ষিতার বিশেষ সুনাম ছিলো না, ফলে গিন্সবার্গের সঙ্গে কালিম্পঙে তাঁর তথাকথিত মোলাকাত কতটা গভীর ছিলো, জানা সম্ভব নয়।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অনুরাগ কিম্বা অন্য যে কারণেই হোক, সঙ্ঘরক্ষিতা যে কালিম্পং এবং পূর্ব হিমালয় অঞ্চল পছন্দ করতেন, বোঝা যায়। ‘ফেসিং দি কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নামে রেইনবো রোড বইয়ের শেষ অধ্যায়ে কালিম্পঙে প্রথম আসা(১৯৫০, লিংউডের বয়স তখন সবে ২৫) নিয়ে তাঁর উচ্ছসিত নিসর্গবর্ণনার পুরোটাই তুলে দেওয়া যায়:
পোয়াটাক মাইল উজানে, সবুজ বনে ঢাকা খাড়াই পাহাড়ি ঢালের মাঝখানে, তিস্তা সেতুর সুললিত শ্বেতশুভ্র তোরণ ভেসে উঠলো স্বপ্নের মতো।…আমাদের জিপগাড়িটা দ্রুত পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকলো, একের পর এক সরু সরু বাঁক ঘুরে অনেকটা উপরে পৌঁছে গেলাম মুহূর্তে। সাঁকোর ওপরকার লোকজন গাড়ি দেখাচ্ছে পিঁপড়ের মতো, নদীটাকে মনে হচ্ছে পাহাড়ের ঠিক মাঝামাঝি এলিয়ে থাকা, ধূসর-সবুজ জেড পাথরে তৈরি একটা ফিতে।…আমাদের পিছনে, পশ্চিমে, দার্জিলিং পাহাড়ের বেগুনি-ঘননীল, সামনে উত্তরে, রঙ্গিত নদী পেরিয়ে দূর দিগন্তে ছড়িয়ে যাওয়া সিকিম পাহাড়ের আবছা ধোঁয়া ধোঁয়া নীল। ঠান্ডা হয়ে উঠলো হাওয়া, অথচ আকাশ ঝকঝকে নীল, চারপাশ রোদে ধুয়ে যাচ্ছে। মেঘের ওপরে চলে এসেছি আমরা। নিচে তাকিয়ে দেখা যাচ্ছে পেঁজা মেঘের ঝাঁক নদীর বুক ছুঁয়ে ভেসে চলেছে। আশপাশের গাছপালা সব বদলাচ্ছে, শালের জায়গা নিচ্ছে ফার এবং পাইন, ছোট হয়ে আসছে বাঁশগুলো। কয়েকশো গজ অন্তর অন্তর ঝলসে উঠছে পইনসেটিয়া ফুলের উজ্জ্বল গোলাপি লাল। সরে যাচ্ছে খড়ে ছাওয়া কুটির, দোকানপাট, ধর্মস্থান…তিস্তা থেকে সাত আট মাইল আসার পর, তিন হাজার ফুট ওপর থেকে, কুড়েগুলো মিলিয়ে গেলো, দেখা যেতে থাকলো টালির চাল আর সাজানো বাগান ওলা ইংরেজি বাংলো। খুব শিগগিরই আমরা দেখতে পেলাম, সামনে, পাহাড়ের কাঁধের ওপরে বিছিয়ে থাকা, কালিম্পং শহরটাকে।
(ক্রমশ)