রান্নাঘরের গল্প। শেষ পর্ব। লিখছেন মহুয়া বৈদ্য
শেষ পাতে চাটনি
রান্নাঘরের এত গল্প বলার পর নিজের রাঁধাবাড়া নিয়ে দুচারটে কথা না বললে পাপ হবে। সেই যে মায়ের হাতে চড় খেলাম প্রথমবার রান্নার পর, তারপর আবার রাঁধলাম সেই বিয়ের পর। সে গল্প তো আগেই বলেছি। বিয়ের পর প্রথম রান্না সেই বিখ্যাত মুসুর ডাল।
মুসুর ডাল নামিয়ে যখন খেতে বসেছিলাম, আদিখ্যেতা করার মতো কোনো স্বাদ আমি পাইনি, তবে আদিখ্যেতা যথেষ্ট হয়েছিল। সবকিছুই আমি এত ইতিবাচকভাবে নিই,যে সত্যিই বিশ্বাস করেছিলাম,রাঁধতে আমি পারব এবং ভালোই পারব। তা রেঁধেছি বটে একটা সময়। রান্না নিয়ে যথেষ্ট পরীক্ষা নিরীক্ষা ও করেছি। কাঁচকলার ডাল, কমলালেবু চিকেন, নাড়ুর পায়েস, থোড়ের কাটলেট, এঁচড়ের লুচি ইত্যাদি ইত্যাদি তখন বাঁয়ে হাত কা খেল। সমস্ত রান্নাবান্নার মধ্যে আমাকে তুমুল আকর্ষণ করতো সাবেকি বাঙালি রান্নাগুলি। বিশেষত ঠাকুরবাড়ির রান্না নিয়ে ছিল তুলনাহীন আগ্রহ। একবার কেজিখানেক মাগুর মাছের হিঙ্গী বানিয়ে চাখতে গিয়ে কি দশা আমার। এই খাই সেই খাই…শেষে মোল্লানাসিরুদ্দিনের বেড়াল মাপার গল্প মনে পড়ায় যাহোক করে নিজেকে ক্ষান্ত দিলাম। অই কেরোসিনের স্টোভে একবার মুরগির মাংসের বিরিয়ানি বানিয়েছিলাম! আহা! বিশেষ এক্সপেরিমেন্ট করে বিরিয়ানির মাংসের লেয়ারের উপর একস্তর টমেটো দিয়েছিলাম! উফ! সেই টমেটোর স্বাদ, কী যে বলবো, এখনো নোলায় জল আসছে। যাইহোক, ঠাকুরবাড়ির রান্নায় ফিরি। হিঙ্গী ছাড়া চাল পটল বানিয়েছিলাম, অনবদ্য। খাসির মাংসের একটা পদ পড়লাম, এখন নাম মনে পড়ছে না, বিভিন্ন মশলাপাতি একসাথে মেখে আটঘন্টা রাখার পর ঢিমে আঁচে ঘন্টাদুই বসিয়ে রাখতে হবে, সে পড়েই ঠিক করলাম, খাসির মাংস নাই বা হলো, মুরগির মাংস দিয়েই রাঁধব। রেঁধেছিলাম। ঢিমে জনতার স্টোভে হওয়া সে রান্না এমন সুগন্ধ তুলল যে উপর থেকে কাকিমা এসে জেনে গেলেন কি রেসিপি! এ আমার মল্লিকপুরের রান্নাঘরের সৃষ্টি।
রান্নার এই জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে,আমি টাকা জমিয়ে কিনে ফেললাম প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর “আমিষ ও নিরামিষ আহার” এর দুটি খন্ড এবং ” আচার জারক চাটনী”। আচার নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া না করলেও আগের দুটি খন্ড চেটেপুটে শেষ করেছি প্রায়। কোনো এক বছর মায়াপুরে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার একটি প্রসাদ তৈরির বই হাতে আসে। সে রেসিপিতে সুক্তো আর ছোলার ডাল খেয়ে মনে হয়েছিল এই পৃথিবীর আর সবকিছুই অবাস্তব হলেও আমার কিচ্ছু যায় আসে না। এক প্রবাসী আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে এসে চিকেন মটন ইত্যাদি ফেলে শুধু সেই সুক্তো দিয়েই ভাত খেয়েছিলেন এবং মুক্তকন্ঠে গুণকীর্তন করেছিলেন মনে আছে। এখন আর রান্নাবান্না প্যাশনে নেই। তবে মাঝেসাঝে ঝলকে ওঠে বইকি! কমলালেবু চিকেন, ক্ষীরের মালপো, দই এর মালপো, রেজালা এসব সহজ রান্না করে ফেলি টুকটাক। পুরোনো সময়টা আমাকে মৃদু ছোঁয়া দিয়ে যায়…থালার উপর ধোয়া কলার পাতা, তার উপর বাটি চেপে চেপে বানানো পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল ভাতের চূড়ো, পাশে আলু-মরিচ-পোস্ত ভাজা, মৌরলা মাছ ভাজা, সোনামুগের মিষ্টি ডাল–তাতে কিসমিশ, নারকেল কোরা, ছোট ছোট মুগডালের বড়া মেশানো ডুমুরের নিরামিষ তরকারি, মোচা আর চিংড়ির তরকারি, পুকুরের জ্যান্ত কাতলা মাছের কালিয়া আর কাজু মেশানো আমের চাটনি, গোবিন্দভোগ চালের ঘন পায়েস … এসব পরিপূর্ণ আয়োজনের কথা খুব মনে পড়ে।
আমার রান্নাঘরের কথকতার বৃত্তান্ত এভাবেই হয়তো সম্পূর্ণতা পেল, অথবা এই সম্পূর্ণতা থেকে সূচনা হল আরো কিছু অসম্পূর্ণ গল্পকথার …
(শেষ)