অক্সিজেন। পর্ব ৫। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
গানের দিদিমনি
হারমোনিয়াম নিয়ে বাইরের ঘরে বসেছিল শিপ্রা। এই ঘরে ও ক্লাস করে। গানের ক্লাসের ছাত্রীরা আসে। সন্ধে দিয়ে গা ধুয়ে পাটভাঙা শাড়ি পরে হারমোনিয়াম কোলের কাছে টেনে রোজ একবার করে বসার অভ্যেস ওর বহুদিনের। এখন তো অনলাইনে ক্লাস হয়। তবু অভ্যাস বদলায়নি ও। টুপু বেরিয়েছে কোথাও। ভারি উদ্ভট একটা সময় এল। এসময়টা তার ক্লাস ফাঁকা যায়না। বরং ভিড় উপচে পড়ে। এবছর অনলাইনে কয়েকজন শিখছে। বাকিরা আর যোগাযোগ রাখছে না। অনলাইনে সবাই ক্লাস করতে চায়না।
টুপুকে নিয়েও ভারী চিন্তা হচ্ছে। ওর চাকরিটা বোধহয় নেই। বাংলায় ভালো রেজাল্ট নিয়ে এমএ পাস করেছে ও। ভাল প্রতিষ্ঠানে চাকরিও পেল। বড় সংবাদপত্রের অফিসে সহকারী সম্পাদকের কাজ। উৎসাহে টগবগ করে ফুটছিল ছেলেটা। দুদিন হল কথাই বলছে না। শরীর ভালো লাগছে না বললেও বোঝা যাচ্ছে কয়েনের এপিঠ বা ওপিঠ। নয় রিনি সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছে, অথবা চাকরি চলে গিয়েছে। চাকরি পাবার পর পরই রিনিকে তার কাছে নিয়ে এসেছিল ও। ওই একই অফিসে ওর কিছুদিন আগেই জয়েন করেছে। মেয়েটাকে দেখে ভাল লেগেছিল তার।
টুপু বলেছিল “নে নে পিতিকে পেন্নাম ঠোক। পিতির পছন্দ না হলে তোকে ক্যান্সেল করে দোব।”
হেসে বলেছিল শিপ্রা, “ছিঃ! ও কি কথা!” তার ভাললাগা মন্দলাগা শুনবে বলে সেদিন মেয়েটাকে এগিয়ে দিয়ে এসে বাইরের কাপড় না ছেড়েই তার ঘরে ঢুকেছিল। ইচ্ছে করেই গোমড়ামুখো হয়ে ছিল ও। ওর দিকে তাকিয়ে “একটুও পছন্দ হয়নি” বলায়, মুখ শুকিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল ছেলেটা। ওর ভাবগতিক দেখে হেসে ফেলে শিপ্রা।
আজ ভাবছে জানতে চাইবে কী হল? ওকে অমন লাগছে কেন?
টুপু, তিনি, যতীন, আর টুপুর বাবা মা সবশুদ্ধু পাঁচ জনের পরিবার। এখন শীলাও থাকে। এর মধ্যে যতীনকে ধরলেও হয় না ধরলেও হয়। ছোটবেলা থেকেই ও অসুস্থ। দেখলে চট্ করে বোঝা যায়না। ওর বয়স বাড়লেও বুদ্ধি বাড়েনি। বরাবর যতীন তার ওপর নির্ভর করে এসেছে। দু’বছর হল টুপুর জেদাজেদিতে শীলাকে রাখা হয়েছে।
যতীনের দেখাশোনা করা, পোশাক কাচা, বিছানা করে দেওয়া সব দায়িত্ব ও বুঝে নিয়েছে। তাছাড়াও রান্নাঘরে বৌদিকে রান্নার জোগাড় করে দেয় ও। মেয়েটা পরিশ্রমী, চটপটে, কিন্তু একটাই অসুবিধে বাড়ি গেলে ফিরতে চায়না। বর অনেকদিন উধাও।মাথার সিঁদুর ছাড়া আর কোথাও তার ঠিকানা নেই। নিজের কচি মেয়েটাকে শাশুড়ির কাছে রেখে খাওয়া পরার কাজ করতে এসেছে ।মন ছটফট করে মেয়ের জন্য।
রান্নাঘরের পাশের ছোট স্টোররুমটা গুছিয়ে শীলাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। দাদার সঙ্গে কথা হয়েছে। শিপ্রা ভাবছে, শীলার মেয়েটার ক্লাস ওঠাউঠি হয়ে গেলে এবাড়িতেই আনিয়ে নেবে। কাছেই অবৈতনিক প্রাইমারী আছে ভর্তি করে দেওয়া যাবে। কিন্তু বৌদির মতামত নিতে হবে। বৌদির একটু পরিষ্কার পরিষ্কার বাতিক আছে। ঝামেলা করলেই মুস্কিল।
সকালে ভারী অদ্ভুত একটা কান্ড হয়েছে। পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেলে একগ্লাস লেবু জল খেয়ে সামনের পার্কে একবার ঘুরপাক খেয়ে আসার অভ্যাস তার বহুদিনের। মন তাজা লাগে। আজও গিয়েছিল। ওখানেই সজল বাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সজল বাবু গত দু’সপ্তাহে একদিনও মেয়েকে অনলাইন ক্লাসে বসাননি। বিষয়টা নিয়ে জানতে চাওয়াটা কেমন হবে, ভাবছিল ও। টিউশানির ব্যাপারটা সবসময়েই একটু স্পর্শকাতর । সম্মান রেখে চলাটা মাঝেমাঝেই বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যায়।
তাকে অবশ্য কিছু বলতে হলনা।
সজল বাবুই বললেন, “ম্যাডাম, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালই হল। মেয়ের একটু সর্দিজ্বরের মত হয়েছিল। টেনশানে ছিলাম।এখন অনেকটা সুস্থ। বুধবারের ক্লাসে ও জয়েন করবে।”
শিপ্রা নিজের চিন্তাটা একদম লুকিয়ে মিহি গলায় বলল, “ঠিক আছে। ও আসুক । শেষ দুদিনের ক্লাসের নোটেশানটা ক্লাসের পরে লিখিয়ে দেব।”
এগোতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। শিপ্রাও দাঁড়িয়ে যায়। আবার কী হলরে বাবা। মনেমনে ভাবে ও।
“ম্যাডাম একটা কথা বহুদিন হল ভাবছি, বলে উঠতে পারছি না। বলব?”
বেজায় হাসি পায় শিপ্রার। ওর এখন পঞ্চাশ চলছে। সজল বাবুর বয়স বাহান্ন তিপান্ন হবে। তাকে নিশ্চয়ই বিয়ের প্রস্তাব দেবেন না ভদ্রলোক। শুনেছে ওনার স্ত্রী মারা গিয়েছেন। যাই হোক, এত ইতস্ততঃ কিসের?
“বলুন।” অভয় দেবার ভঙ্গি করে ও।
উনি লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেন, “আমাকে আপনার গানের ক্লাসে নেবেন? মানে বয়স হয়েছে তো, তাই লজ্জা করছে। তবে একেবারে কিছু জানিনা এমনও নয়। ছোটবেলায় মায়ের কাছে গলা সাধা, দু’একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাও হয়েছে। দেখবেন নাহয় টেস্ট করে।”
ওর ওনার লজ্জা দেখে খুব হাসি পায়। কচিছানার মত হাবভাব করছে দেখো। মুখে বলে, “ঠিক আছে।আমার ক্লাসে সবাইকেই ওয়েলকাম করা আছে। আপনি আসতেই পারেন। তবে প্রথম দু’একদিন একাই বসবেন। তারপর আপনার মেয়ের সঙ্গে দিয়ে দেব। হোয়াটস্ আ্যপে ডেট জানাব, অসুবিধে হলে বলবেন। আচ্ছা আজ আসি। নমস্কার।” ওনাকে আর কিছু না বলতে দিয়েই এগিয়ে গিয়েছিল ও।
ফিরতে ফিরতে কুলকুল করে হাসি আসছিল ওর। ভদ্রলোক একটু খ্যাপা আছেন। কথা বলার সময় কেমন হাঁদা গঙ্গারামের মত মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। যেন ও পরী বা বিশ্বসুন্দরী! মহিলা অনেক দেখেছে জীবনে, কিন্তু তাকে দেখেনি। এবার মজাটা হাড়ে হাড়ে টের পাবে বাছাধন। এসব গদগদ লোক দু’চোখের বিষ ওর।
(ক্রমশ)