নষ্ট চাঁদের আলো : অনলি দ্য ডেভিল এন্ড আই/উইল ফিল দ্য রেস্ট…। লিখলেন সুমনা চৌধুরী

0

পাইরেট বা জলদস্যু—শব্দটি শুনলে আমাদের প্রজন্মের মনে প্রথমেই যিনি হাজির হন, তিনি  ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো। হলিউড অভিনেতা জনি ডেপ যে চরিত্রে অভিনয় করে আমাদের প্রজন্মের কাছে প্রায় অমরত্ব লাভ করেছেন। হাতে উদ্যত তলোয়ার, মাথার খুলির সঙ্গে আড়াআড়ি দুটি হাড়সংবলিত তাঁর সেই জলদস্যু জাহাজের নিশানের কথাই–বা আমরা কে ভুলতে পারি!

তারও আগে, আমরা যারা সমস্ত কৈশোর কাটিয়েছি গল্পের বইয়ে মুখ গুজে, অনিল ভৌমিকের দুঃসাহসী ফ্রান্সিস আর তার বন্ধু হ্যারিও আমাদের মনে কম আলোড়ন তুলে যাননি। উত্তাল সমুদ্র, জাহাজের ডেক, বিবিধ দ্বীপ, নাবিকেরা, মৃত্যু মুখ থেকে প্রতিবার ফ্রান্সিসদের ফিরে আসা—এই যাবতীয় রোমাঞ্চকর অভিযানের মাঝেই আমাদের সমুদ্রকে চেনা-জানা কৈশোরে। লা ব্রুশের মতো হাড় হিম করা ভিলেনকে দিয়ে ‘জলদস্যু’-শব্দটির সাথে পরিচিত হওয়া। কৈশোর পেরোতে পেরোতে রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ আমাদের ততোদিনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আরেক সামুদ্রিক জলদস্যু ব্ল্যাকবিয়ার্ড দ্য পাইরেট-এর সঙ্গে। এরও পরে টেলিভিশনের আমাদের মধ্যবিত্ত ঘরের মধ্যমণি হয়ে জুড়ে বসা। ক্যাবল চ্যানেল মধ্যবিত্তের চৌহদ্দির ভেতরে আসার লাভটা ছিল এই, বড়োদের চ্যানেলের পাশাপাশি ছোটোদের চ্যানেলও পৌঁছে গেল ঘরে ঘরে। ছুটির দিনের সকাল-দুপুর-বিকেলের কিছু বরাদ্দ সময়ে ছোটোদের হাতের কাছেও পৌঁছে গেল মোটামুটি পৃথিবীর একাংশ। গল্পের বই থেকে সরাসরি চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠলেন এক চোখে তাপ্পি, মোটা দাড়ি-গোঁফ, উদ্যত তলোয়ার হাতে জলদস্যুরাও— মাথার খুলির সঙ্গে আড়াআড়ি দুটি হাড়সংবলিত নিশান উড়ানো জাহাজ নিয়ে। আর বারেবারেই ফিরে এলেন ব্ল্যাকবিয়ার্ড দ্য পাইরেট, তাঁর লুকানো গুপ্তধনের ধাঁধা নিয়ে। সেই গুপ্তধন উদ্ধারের দুর্ধর্ষ সব স্বপ্নিল অভিযান যে জলদস্যু জীবনের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটালো বড় হতে হতে রোমান্টিকতায় মুড়ে তা এসে মিশে গেলো ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো-তে।  নীল সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো, জাহাজে জাহাজে লড়াই, ম্যাপ হাতে গুপ্তধন উদ্ধার, পাল তুলে দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া, দুঃসাহসিক অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়া— রোমাঞ্চকর এই সবকিছুর মাঝেই জলদস্যু শব্দটি নিহিত হয়ে থাকলো আমাদের মনে।

কিন্তু জলদস্যু জীবন কি আসলেই এতটা রঙিন আর প্রাণবন্ত ছিল? অথবা লুঠপাট, হত্যা ও নৃশংসতায় সামুদ্রিক ত্রাস হিসেবে তাদের যে পরিচিত হয়ে উঠা—সেসবের পেছনের ইতিহাস-ই বা কী? বাংলা সাহিত্যে জলদস্যুদের ইতিহাস নিয়ে সম্ভবত তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য উপন্যাস-গল্প  লেখা হয়নি। যাওবা লেখা হয়েছে সেগুলোকে জলদস্যুদের গল্প না বলে গুপ্তধন বা ট্রেজার হান্টিং-এর গল্প-উপন্যাস বলা যায়।

আর ঠিক এখানে এসেই অলোক সান্যালের ‘নষ্ট চাঁদের আলো’ আঠারো শতকে আটলান্টিক জুড়ে দৌরাত্ম্য চালানো জলদস্যুদের পটভূমিকায় এক অনন্যসাধারণ উপন্যাস হয়ে উঠেছে। সময়, ইতিহাস ও ঘটনাক্রম—এমনভাবে বুনেছেন অলোক গোটা উপন্যাসে, আমরা পড়তে পড়তে ক্রমশ আঠারো শতকের বেনিন উপকূল, চার্লস টাউন, স্লেভ কোস্ট, ভার্জিনিয়া, বাহামা, ইয়র্ক সিটি আর বর্তমান লন্ডনে হারিয়ে যেতে থাকি। গোটা উপন্যাসে দুটো সময়কে ধরতে চেয়েছেন অলোক। বর্তমান শতাব্দী এবং আঠারো শতকের আটলান্টিকের বাণিজ্য পথ। তার-ই সাথে এসেছে সে সময়ের ইংল্যান্ড তথা ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশে তাদের শোষণ চালিয়ে যাওয়ার চরিত্রটিও। উপন্যাসটিতে গল্পের রহস্য-রোমাঞ্চ-অ্যাডভেঞ্চারের সাথে নির্বিঘ্নে এসে মিশে গেছে ঔপনিবেশিক সময়ের ইতিহাস, সমাজ, জীবন-যাপন, শাসন আর শোষণের পদ্ধতি।

১৫০০ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শাসন যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ক্যারিবীয় দস্যুদল। ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ (প্রথম) কর্তৃক জলদস্যুতা বৈধকরণ যা চলে রাজা এডওয়ার্ড (ছয়) এর সময় অব্দি। সেই বৈধতাকরণের রাণীর সিলমোহর লাগানো কাগজটির নাম ছিল লেটার অব মার্ক। ফ্রান্স এবং স্পেন—শত্রুদেশের জাহাজ লুঠ, পোড়ানো, নাবিক হত্যার জন্য জলদস্যুদের অবাদ ছাড় দেওয়ার ইংল্যান্ডের বৈধতাপত্র। বদলে শাস্তি নয়, জুটবে প্রশংসা। জাতীয় নায়কের মর্যাদা। ফলস্বরূপ সে সময়ে নৌযুদ্ধে দক্ষ নাবিকরাও গিয়ে দস্যুদলে যোগদান করেন। বৃদ্ধি পায় জলদস্যু বন্দরের সংখ্যা। জলদস্যুদের ইংল্যান্ডের শাসক কতৃক নাম তখন পাইরেটস নয়, প্রাইভেটিরস। স্বয়ং ইংল্যান্ডের রানির আশীর্বাদধন্য।—এ সমস্ত খানিক জানা এবং বেশিরভাগটাই অজানা ইতিহাস উপন্যাসের গল্পের মোড়েই অলোক আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন। উপন্যাসের চরিত্র রয়াল নেভির অফিসার পিটার রোচের এর সাথে গভর্নর স্পোটসউডের সংলাপের মাঝে। যে পিটার রোচ রেবেল পিটার নামে উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠবেন পরবর্তীতে। আমরা তাঁকে চিনবো বর্ণবিদ্বেষী আন্দোলনের প্রধান মুখ—এক শেতাঙ্গ পুরুষ হিসেবে। হয়ে উঠবেন শোষিত গণমানুষের প্রতিনিধি। গায়ের রং, পেশা কিংবা কোনো নির্দিষ্ট সমাজ দিয়ে যাঁকে বিচার করা যাবে না।

উপন্যাসে পিটার আর গভর্নর স্পোটসউডের সংলাপের মাঝে উঠে আসবে  প্রাইভেটিরসদের আটলান্টিক ত্রাস জলদস্যু হয়ে উঠার আরও ইতিহাস—

“এঁরা প্রত্যেকেই শত্রু দেশের কাছে ছিলেন বর্বর সামুদ্রিক লুঠেরা এবং ইংল্যান্ডের জনগণের কাছে দেশনায়ক। তাঁদের বীরগাথা, রোমহষর্ক যুদ্ধজয়ের কাহিনী, শত্রু জাহাজকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার বর্ণনা ইংল্যান্ডের প্রতিটি শিশুর কাছেই রাতবিছানায় শুয়ে মায়ের মুখে শোনা কোনো রূপকথার গল্পের মতোই আকর্ষণীয়। নাহ্, তাঁদের অবদান কিংবা বীরত্ব নিয়ে গভর্নর স্পোটসউডের মনেও এতটুকু সংশয় নেই। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে সামুদ্রিক লুঠে অভ্যস্ত মানুষগুলোকে যদি হঠাৎ নির্দেশ দেওয়া হয়— ভাইসকল, লুঠপাট অনেক হয়েছে। এবারে এসব থামাও। ফ্রান্স এবং স্পেনের সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্ব শেষ। সুতরাং আর কোনো সংঘাত নয়। আগামীতে নতুন করে প্রাইভেটারিং লাইসেন্স ইস্যু করা হবে না। দস্যুতায় ইতি টেনে এবার লক্ষ্মীছেলের মতো চাষাবাদ কিংবা পশুপালন শুরু কর। কাটলেসের বদলে হাতে তুলে নাও লাঙল। শত্রুর রক্ত না ঝরিয়ে জল ঝরাও ক্ষেতে। কেমন হয় ব্যাপারটা?

রক্তের স্বাদ কি কখনো জলে মেটে? প্রাইভেটিররা বছরের পর বছর ধরে একটা কাজই দক্ষতার সঙ্গে করে এসেছে। যুদ্ধ এবং লুঠ। মানুষের রক্তের স্বাদ পাওয়া ডোরাকাটা প্রাণীর কাছে যেমন লোভনীয় সারঙ্গ নিতান্ত নিরামিষ ভোজন, প্রাইভেটিরদের কাছে সাধারণ নিরুদ্বেগ জীবনও কতকটা সমান প্রকৃতির। এখন তার ফল ভুগছে আটলান্টিকের ত্রিমুখী বাণিজ্য। ইংল্যান্ডের ভাগ্যনির্দেশকদের সম্ভবত এই সরল অথচ অনিবার্য পরিণতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না।”

ইতিহাস ঘেটে যেটুকু জানা যায়, প্রাইভেটিরসদের দুঃসাহসিক সব অভিযান সফল হওয়ায় সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে অষ্টাদশ শতকের ত্রিশের দশক পর্যন্ত সোনালি সময় পার করে দস্যুরা। জলদস্যুতার সেই সোনালী যুগে প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক জলদস্যু পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সব নৌপথে বিচরণ করে। ক্যারিবীয় অঞ্চলে উপনিবেশকারী পশ্চিম ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর নৌবাহিনী আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকে জলদস্যু নিধনের অভিযান শুরু করে। নৌবাহিনীর ধরপাকড় ও বিচারের সম্মুখিন হয়ে ক্যারিবীয় জলদস্যুদের দাপট কমতে শুরু করে।

এ তো গেল ইতিহাস। এবারে উপন্যাসে ঢোকা যাক। আঠারো শতকের জলদস্যু বৃত্তান্তে গেলে অবশ্যম্ভাবীভাবে যার নাম চলে আসে, তিনি ব্ল্যাকবিয়ার্ড। এডওয়ার্ড ‘ব্ল্যাকবিয়ার্ড’ টিচ।  ‘আটলান্টিক ত্রাস’ বলে যাঁকে অভিহিত করেছে পরবর্তী ইতিহাস। তাঁর ফ্লাগশিপ কুইন অ্যানস রিভেঞ্জ-এর দাপটে আঠারো শতকের আটলান্টিক মহাসাগরের ত্রিমুখী বাণিজ্য পথ পযুর্দস্ত। ওক্রেকোক খাঁড়ির যুদ্ধে রয়েল নেভির হাতে ব্ল্যাকবিয়র্ডের মৃত্যুতে আটলান্টিকের বাণিজ্যপথ সংকট মুক্ত হয় বটে কিন্তু তাঁর ফ্ল্যাগশিপ আর লুকোনো ঐশ্বর্য নিয়ে এই শতাব্দী অব্দিও রয়ে গেছে নানা কিংবদন্তী। ঠিক এই প্রেক্ষাপট থেকেই উপন্যাসের শুরু। বর্তমান শতাব্দীর সমুদ্র প্রত্নতত্ত্ববিদ এমা মিলারের লক্ষ্য আঠারো শতকে ডুবে যাওয়া ব্ল্যাকবিয়র্ডের জাহাজ কুইন অ্যানিস রিভেঞ্জ উদ্ধার। মিলারের নেতৃত্বে সেই লুকোনো ঐশ্বর্যর খোঁজে যোগ দেবেন তাঁর ভাই এলিন এবং ফাদার সাইমন। আমরা দেখা পাবো জোনাথন ডারওয়ার্ড জুনিয়র সহ গায়েরা, আফ্রেয়া, থমাস, আইয়ানা, ব্রোকেনটুথ—অসংখ্য ছোটো বড়ো চরিত্রের। এবং এই এতো চরিত্র আর ঘটনার মিশেলে, দুই শতাব্দীর সমান্তরালভাবে বহমান গল্প-রহস্য-রোমাঞ্চ-ষড়যন্ত্রের মাঝে পাঠক হিসেবে কোথাও আমরা গল্পের খেই হারাবো না।

গুপ্তধন-রহস্য-রোমাঞ্চের ঘনঘটার মাঝেও আমরা শুনতে পাবো প্রচন্ড রাজনৈতিক উচ্চারণ। যখন ফাদার সাইমন এলিনকে বলবেন :

 

‘আমারও লজ্জা হয় এলিন। লজ্জা হয় যখন জানতে পারি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সহযোদ্ধার গায়ের রং আলাদা হওয়ার কারণে তাকে ‘ব্লাডি নিগার’ বলে বিদ্রুপ করা হয়েছিল। মাত্র সত্তর আশি বছর আগের মানসিকতা! হয়তো এখনো আছে। প্রচ্ছন্নভাবে কারোর কারোর মনে। আসলে বর্ণবিদ্বেষের এই বিষবৃক্ষ সেই সুদূর অতীতে রোপিত হয়েছিল। একদিন আমাদের এই পশ্চিমি সভ্যতা কালো চামড়াদের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। আর তারপর প্রয়োজন শেষে তাদের ভুলে যেতে তিলমাত্র দ্বিধা করেনি।”

অথবা যখন জলদস্যুদের বিচার পদ্ধতি নিয়ে এলিনের সংশয়ের উত্তরে ফাদার সাইমন  বলবেন :

‘বিচারেও যে যোজন ফারাক ছিল মাই সন। একই অপরাধে ভিন্ন শাস্তি, এ তো কোনো নতুন কথা নয়। এমনকী কখনো শাস্তি এক হলেও তার প্রয়োগ ছিল আলাদা। কারোর ক্ষেত্রে দস্তুরমত আদালত বসিয়ে বিচার হতো। কারোর ক্ষেত্রে সেসব ছিল নেহাতই অপ্রয়োজনীয়। সোজা ধরে এনে চৌরাস্তার মোড়ে বেঁধে রাখা হতো। ইচ্ছেমতো গায়ের জ্বালা মেটানোর পরেও যদি হৃদপিণ্ড সচল থাকে, তবে গিয়ে ফাঁসির দড়ি জুটত গলায়। এ কেমন বিচার বলতে পারো এলিন? দস্যুতার অপরাধে শাস্তি যদি ফাঁসি হয়, তবে তার জন্য শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গে এমন প্রভেদ কেন?’

অথবা বলবেন :

“হিস্ট্রি ইজ রিটন বাই দ্য ভিক্টরস। উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন। তবু তারই ফাঁকে ফাঁকে সত্যিটাও পড়ে থাকে মাই সন। অবহেলায়, অনাদরে। অনেকটা সেই নিগার স্লেভদের মতো। কেউ কেউ নিজের উদ্যোগে সেই ধূলিমলিন সত্যকে তুলে আনেন। তাঁদের জন্যই আমরা মিথ্যের খোলস ভেঙে ভেতরের আসল ঘটনায় উঁকি দেওয়ার সুযোগ পাই।”

পিটার রোচের রেবেল পিটার হয়ে উঠার দৃশ্য রচনা করছেন অলোক এভাবে :

“ঠিক বলেছেন মি. হোয়াইট। ভুলটা আমারই। সংশোধন আমাকেই করতে হবে।’

কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই পিটার সবাইকে পেছনে ফেলে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল। হতচকিত জন হোয়াইট প্রথমটায় কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। তারপর গাছেদের আড়ালে হারিয়ে যেতে থাকা ভার্জিনিয়ার কালেক্টরকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে উঠলেন, ‘স্যার পিটার। স্যার পিটার ফিরে আসুন। ফিরে আসুন দয়া করে।’

জবাবে গাছেদের ছায়া ছায়া অন্ধকার ফুঁড়ে জবাব ভেসে এল, ‘রক্তঋণ… রক্তঋণ… রক্তঋণ।’

ক্যারেজ থেকেই লাথি ছুঁড়লেন জন হোয়াইট। দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘ছোটোলোকগুলো যাবে কোথায়? এখানেই পচবে। আগে যাও, স্যার পিটারকে দেখ। শেয়াল কুকুরে খেয়ে না ফেলে। তা হলে সর্বনাশ হবে। যাও গর্দভের দল।’

জন হোয়াইট তখনো জানতেন না, সর্বনাশের আগুন তাঁকেও পুড়িয়ে মারতে চলছে। নতুন করে রিবিলিয়নের আঁচ লাগতে চলেছে এই উপনিবেশের গায়ে। ব্রিটিশ অহংকারকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে চলেছে মশাল ধরা একটা হাত।

রাতের অন্ধকার পুরোপুরি ক্ষয়ে যাওয়ার আগে, সেই আগুনের ছোঁয়ায় লাল হয়ে উঠল ইয়র্ক সিটির আকাশ। সকলে অবাক চোখে দেখল লকলকে শিখা গিলে নিচ্ছে গুদামঘর। দস্যি বাতাস তাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে আরও। পরপর জ্বলছে তামাক বোঝাই ঘরগুলো! কটু গন্ধে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে ক্রমশ। সেই নাচতে থাকা সর্বগ্রাসী আগুনে জঙ্গলের সামনে মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে এক অকুতোভয় শ্বেতাঙ্গ। পরনে মলিন সাদা জামা। ডান হাতে ধরা রয়েছে মশাল।”

রেবেল পিটারের মুখে ধ্বনিত হচ্ছে :

“আগুন দরকার আচাক। আগুন দরকার যে আরও। এই উপনিবেশ থেকে অমানুষদের তফাতে রাখতে গেলে আমাদের আরও আগুন দরকার। এমনকি জলেও।”

উপন্যাসের মাঝে যখন উচ্চারিত হচ্ছে :

“সাদা চামড়ারদের এত ঔদ্ধত্য কেন ব্রোকেনটুথ। তোমরা, আমরা কি মানুষ নই? তাহলে কেন আমাদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হবে? কেন আমাদেরই দেশ লুঠ করে আমাদেরকেই বর্বর অসভ্য জাতি বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে? এই অনাচারের বিরুদ্ধে রিবেল পিটার রুখে দাঁড়িয়েছে। চামড়ার রঙ দেখ না, রিবেল পিটার একজন মানুষ। তোমার আমার মতোই।”

—এইসমস্ত দৃশ্যে উপন্যাসটি নিছক এক রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্প হয়ে থাকছে না। বরং দেশে দেশে, যুগে যুগে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে পিঠ টান করে দাঁড়ানো শোষিত গণমানুষের স্বর হয়ে উঠছে।

ঘোরে আচ্ছন্ন ফাদার সাইমন যখন অপরিচিত ভাঙা দাঁতের ছেলেটির উদ্দেশে বলেন—

‘নিজের দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার আমাদের সবার। কেউ তা জোর করে কেড়ে নিতে পারে না। দাসত্ব অনেক করেছ। এবার উঠে দাঁড়াও। ঝড় তোলো। পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্রে আগুন লাগাও। দাবানলের মতো ছড়িয়ে যাক সেই আগুন। তাতে পুড়ে ছাই হয়ে যাক সভ্য জাতির যাবতীয় অহংকার। আগুনে পুড়ে খাঁটি মানুষ হোক তারা। এ এক অতি দীর্ঘ লড়াই ভাই। তার জন্য মনের এবং শরীরের শক্তি দরকার। আর শক্তির জন্য আমাদের কঠিন সময়েও খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলে চলে না। খেয়ে নাও ছেলে। তৈরি করো নিজেকে।’

—তখন তা আর শুধু আঠারো শতকের সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের কালো চামড়ার মানুষদের শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার শপথেই আটকে থাকছে না। সমুদ্র-কাঁটাতার আর মানচিত্র মুছে তা হয়ে উঠছে আজকের গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের শোষণ-বিরোধী স্বর। গণমানুষের স্বর। নির্যাতকের বিরুদ্ধে নির্যাতিতদের সংগঠিত হওয়ার স্বর।

ওক্রেকোক খাঁড়ির যুদ্ধের আগে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নাবিক মি. ওডেল যখন ব্ল্যাকবিয়র্ডকে জিজ্ঞাসা করছেন— ‘আপনি জন্মসূত্রে একজন ব্রিটিশ হয়েও ইংলিশ মার্চেন্ট শিপ লুঠ করছেন!’ উত্তরে কোয়ার্টার মাস্টার থমাস বলেন—

 ‘আপনার জবাবের মধ্যেই আমাদের উত্তর লুকিয়ে আছে মি. ওডেল। আমাদেরও একটাই কর্তব্য। বেঁচে থাকা। এডওয়ার্ডের জন্ম ব্রিস্টলে। আমারও। কিন্তু শুধু জন্মের সুতো দিয়ে কোনো সম্পর্ক বোনা যায় না। ইংল্যান্ড আমাদের কাছ থেকে শুধু নিয়েছে। বিনিময়ে কিছুই দেয়নি। তাই দেশের প্রতি আমাদের সহানুভূতির ভাঁড়ার শূন্য।’

—ইতিহাস-সময়-মানচিত্র ভেদ করে কেমন করে যেন তা যেন ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিখন্ডিত হওয়ার ইতিহাস এবং তৎপরবর্তী ‘দেশ বনাম রাষ্ট্র’ নামক উগ্র দক্ষিণপন্থীয় বাইনারির সাথে এসে মিলে যায়। কোয়ার্টার মাস্টার থমাসের স্বরের সাথে মিশে যায় মিহির সেনগুপ্তের স্বখেদ উচ্চারণ—

“দেশ ছাড়ার দীর্ঘদিন বাদে ১৯৮৬ এর শরতের এক কাকভোরে যখন সীমান্ত পেরিয়ে বেনাপোলে ঢুকব, সেদিন নো-ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল, সেটা যেন একটা বিরাট হাঁ-মুখ ফাটল, যেখানে আমার দেশ নামক বোধটা চিরকালের জন্য তলিয়ে গেছে দুটো অথবা পরবর্তীকালে তিনটে নির্বোধ, চৈতন্যহীন, হৃদয়হীন রাষ্ট্রের হাতে। আর কেউ কোনোদিন জিজ্ঞাসা করবে না, তোমার দেশ কোথায়? ভদ্রাসন কোথায় ছিল তোমার? আমাকেও আর কষ্ট করে উত্তর খুঁজতে হবে না। এতদিনে তো জেনেই গেছি, দেশ বলে সত্যিই কিছু আর নেই।”

‘নষ্ট চাঁদের আলো’ উপন্যাসের ধারাবিবরণী এভাবেই এগিয়েছে। আঠারো শতকের বেনিন উপকূলে কালো চামড়ার ক্রীতদাস পাচার থেকে শুরু করে জলদস্যুদের ইতিহাস, ব্ল্যাকবিয়ার্ডের উত্থান এবং অন্তিম পরিণতি, পিটার রোচের ‘রেবেল পিটার’ হয়ে উঠা, তৎকালীন ইংল্যান্ডের শোষণ-শাসন ব্যবস্থা—যদিবা তার একটি টাইমলাইন, আরেকদিকে রোমাঞ্চকর এক রুদ্ধশ্বাস অ্যাডভেঞ্চার এমা মিলারের নেতৃত্বে। সেখানে তার সহযোগী হয়ে থাকবেন ফাদার সাইমন আর এলিন। ষড়যন্ত্র, কন্ট্র‍্যাক্ট কিলার, ট্রেজার হান্টিং, পাজল সলভিং এর মাঝে ধাঁধার মতো একদিকে পরতে পরতে খুলবে রহস্যের জট, আরেকদিকে আঠারো শতকের ঔপনিবেশিক ইতিহাস,  শোষণ-শাসনের অন্ধকার ইতিহাস। দুই মিলিয়ে উপন্যাসটি হয়ে উঠে এক অভূতপূর্ণ আখ্যান। আর ‘সামুদ্রিক শয়তান’ ব্ল্যাকবিয়র্ডের পাশাপাশি আমাদের মনে গভীর দাগ কেটে যাবেন রেবেল পিটার, ব্রোকেনটুথ, আফ্রেয়া, আইয়ানা, থমাস, এবং ফাদার সাইমনও।

গোটা উপন্যাস বিষয় বৈচিত্র্যে ভরপুর। ঘটনাবহুল। কিন্তু কোথাও গিয়ে পাঠক হিসেবে আমাদের তাল কাটে না।

উপন্যাসটির আরেক উল্লেখযোগ্য দিক তার প্রচ্ছদ এবং ভেতরের অলংকরণ। বইটির দুদিকের পুস্তানিতে ব্যবহৃত হয়েছে তৎকালীন আটলান্টিকের ত্রি-মুখী বাণিজ্যপথের একটি ম্যাপ। যা নিঃসন্দেহে বইটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ুয়াদের যেমন এই উপন্যাস ভালো লাগবে, অ্যাডভেঞ্চার-রহস্য-রোমাঞ্চপ্রেমীদেরও বইটি ততোটাই ভালো লাগবে। ৩৯৭ পৃষ্ঠার বইটির এতো ঘটনাবহুলতার মাঝেও গতি কোথাও স্লথ হয়নি। বরং প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই এক অমোঘ টানে বইটি আমাদের বেঁধে ফেলে। আঠারো শতকের আটলান্টিক জীবন্ত হয়ে উঠে পাঠকের সামনে। আর এমা মিলারের মতো আমরাও ব্ল্যাকবিয়র্ডের ফ্লাগশিপ উদ্ধারে ডুব দেই গহীন সমুদ্রে। কালো পাথরের দ্বীপে। আর নিমগ্ন হয়ে আওড়াতে থাকি —

‘… Where I am nobody knows

Only the spoil Moon sitting on the hill

Speaks when I have nothing to say

Hiding the hunger that never goes

Only the Devil and I together will fill

The rest, we dream in the bright day.’

 

……………………………………………………….

বইয়ের নাম : নষ্ট চাঁদের আলো
লেখক : অলোক সান্যাল
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী, অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৫৯০ টাকা
প্রকাশক : সুপ্রকাশ

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *