চারপাশে দেখি, সব ভাঙছে, সব। পঞ্চাদা ঘাম মুছছে আর বলছে—’কী করব বল, একা তো!’ লিখছেন অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য

0
‘কুঠিডাঙ্গার চিরাচরিত প্রেস। কেরোসিন-কাঠের কোণা-খাওয়া টেবিল, পায়ায় দড়িবাঁধা, যেখানে সেখানে পেরেক মারা টুলে আসীন হয়ে কত বিচিত্র জ্ঞান-অপজ্ঞান-অভিজ্ঞতার সন্ধান পাওয়া যায়’। ইতিহাস এবং ব্যক্তিগত স্মৃতিগদ্যের ভেতর একজন কম্পোজিটর। এককালীন তুমুল বৈভবের সময় যখন ‘আমাদের দেশে কম্পোজিটর পেশাগত এবং অর্থকরী দিক থেকে বরাবরই নিচু পদ হলেও আদৌ নিচু কাজ নয়’, যখন শ্রমিক আভিজাত্যের চেয়েও শ্রমের আভিজাত্যের টানে প্রেসের কাজে ছুটে আসা মুখের পর মুখ এবং কালের যাত্রার ধ্বনি – টিমটিম অন্ধকারে নিভতে থাকা প্রেস, পারিবারিক লেগ্যাসি, এক একটা জ্যান্ত মুখ – ‘নতুন প্রযুক্তি, অনাবশ্যক দ্রুতির সঙ্গে শুধুমাত্র পুঞ্জি আর প্রবঞ্চনার জন্য বাহ্যত অকারণে প্রযুক্তির নিত্যি হাল হকিকৎ বদলে ফেলায় ক্ষতিগ্রস্ত’ হওয়া একটা প্রজন্ম।
রাত জেগে টেলিপ্রিন্টারে আসা খবরের অনুবাদক বাবাকে সারা দিনের খাটুনির পর শেষ রাতে প্রুফ তোলবার কাগজের রোল মাথায় নিয়ে এডিটিং ডেস্কের ওপর ঘুমোতে হতো। ছেলেমেয়েদের দেখলে মেজো জ্যাঠামশাইয়ের ‘প্রতিদিন একটু একটু করে বাংলা শিখছ তো?’-র আন্তরিকতার পাশাপাশি বড় জ্যেঠামশাইয়ের দরাজ গলা – ‘আমরা হলাম গিয়ে কাঙালের নাতিপুতি, আমাদের কোথাও আটকাবে না’। খাটের ওপর জলচৌকি ধরনের আসবাবের ওপর পাতা আসনে উপবিষ্ট গ্রামবার্তা প্রেসের কম্পোজিটর হরিনাথ মজুমদার। মায়েস্ত্রো। অবশ্য নিজস্ব ছোটছোট পৃথিবীতে মায়েস্ত্রো আরও অনেকে। চরিত্র। ভারতী প্রেসের হেড-কম্পোজিটর ছোড়দির মতো মুখ। যারা পারিবারিক প্রেস কেনার ‘স্বপ্নকন্ঠের কথা কাউকে বলে না, স্বপ্ন নিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসেও থাকে না’। লিপিমালা প্রেসের পঞ্চাদা, হেড কম্পোজিটর সুবলবাবু, সুলেখা প্রেসের ভূপালবাবু, পরমার্থ মঠের প্রেসের জাদু বাইন্ডার বুধোদা। ছোড়দিকে ভালবাসত পঞ্চাদা? ছোড়দি ভালোবাসত? ‘চাপ খুব বেশি হচ্ছে আজকাল? মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে’, পঞ্চাদার গলায় কম্পোজিটরের বিষাদ, ‘কী আর করব, একা তো।’
ইতিহাস। কাঙাল হরিনাথের পাশাপাশি লেটারপ্রেসের বিশ্বজনীন ক্রনোলজি। কলোনিয়াল ভারতবর্ষের শ্রমিক অসন্তোষ, ধর্মঘটের ইতিহাস, পেশাগত বিবর্তনের পাশাপাশি ব্রিটেনের কম্পোজিটর ও মুদ্রাকরদের ক্রম-গ্রহণযোগ্যতার টাইমলাইন। মুদ্রণশিল্পে ইসিডোর সিরিল ক্যাননের অগ্রগণ্য রিসার্চ এবং পেশার বিশ্লেষণের দিক নিয়ে সেইসমস্ত কথা – ‘Researching the politics of compositors required me also to investigate the history of the occupation.’
এই রাজনীতিকে বোঝার জন্য ডিটেলিং। জীবন। কম্পোজিটরদের হাতে সিসার বিষ তুলতে খাবার আগে কেরোসিন মাখা ‘হস্ত প্রক্ষালণ’, সিসার বিষ ঢাকতে কেরোসিনের গন্ধ মাখা অন্ন। চৌবাচ্চার গায়ে রাখা গোল-গোল সাবান, কাপড় কাচার সোডা, নারকেলের ছোবড়া আর থান ইটে ঘষে নেওয়া কড়ি হয়ে যাওয়া হাত। শুদ্ধ বানান-চর্চার খিদে। ‘The eye of a compositor will do more work than both his hands.’। লেটারপ্রেসের একটা পরিচিত সাদা কালো ছবি। টাইপ কেসের সামনে একটা টুলে বসে স্বল্প আলোয় মোটা কাচের চশমার ভেতর দশ বারো ঘন্টা টাইপ সাজিয়ে চলা প্রেত-পুরুষ। শরীরের বাইরে লম্বা হাতাওয়ালা সাদা গেঞ্জি, গেঞ্জির বাইরে ২০০৫-এ কম্পোজিটরদের শেষ সময়ে মাসিক আয় বড়জোর হাজার বারো-শ, সন্ধেয় অন্য প্রেসে কাজ না করলে যে টাকায় সংসার চালানো অসম্ভব।
কম্পোজিটর শব্দটি বিলুপ্ত হয়ে যায় না। ‘কাঙালের নাতিপুতি’র মতো টিকে থাকে, ‘পৃথিবী নামের গ্রহটার কোথাও না কোথাও এক অন্যতর অঙ্গীকারে জেগে থাকে’। ‘শুধু ওদের নিয়ে বলবার লোক কমে যাওয়াটাই সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের’। প্রাসঙ্গিক হয়ে যায় মেজো জ্যাঠামশাইয়ের ডায়েরিতে এমিল জোলার বিষণ্ণ ফোরকাস্ট – ‘Human being will not fulfil its true potential until the last stone falls from the last church on the last priest.’
আর তখনই কম্পোজিটর শব্দের ভাঙনের ভেতর আর কোনও দীর্ঘশ্বাস থাকে না। যখন চারপাশে দেখি, সব ভাঙছে, সব। আর লিপিমালা প্রেসের পঞ্চাদা সাইকেল ফেরত ঘাম মুছছে আর বলছে – ‘কী করব বল, একা তো!’
অনন্ত জানা-র ‘লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর: এক বিষাদান্ত পরম্পরা’। কালেক্টিবল, কালেক্টিবল …
………………………………………………………………..
বই : লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর: এক বিষাদান্ত পরম্পরা
লেখক : অনন্ত জানা
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
প্রকাশক : সুপ্রকাশ
কলেজস্ট্রীট বইপাড়ায় : সুপ্রকাশ, দেজ, দীপু ইত্যাদি।
বাংলাদেশে : ইন্দোবাংলা বুকশপ, বুকস অফ বেঙ্গল, বাতিঘর, কথাপ্রকাশ ইত্যাদি।

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *