অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৯। অনন্ত জানা

সাইনবোর্ড লিখন শিল্পের অধিকাংশ মানুষই স্বশিক্ষিত। শেখ জালালুদ্দিন স্কুলশিক্ষায় ইতি টানার পর ‘দলঘরওয়াড় বাজারে রহিম সাহেবের দোকানে আঁকা শেখার মাঝেই দড়ি বানানো, বই বাঁধাই এবং গ্যারেজ মেকানিক ইত্যাদি নানান কাজে’ নিয়োজিত থেকেেছন। শেষ পর্যন্ত সাইনবোর্ড আঁকাই তাঁর স্থায়ী পেশা হয়ে দাঁড়ায়। আমেদাবাদের সুপরিচিত সাইনবোর্ড লিখিয়ে হিসেবে শেখ জালালুদ্দিনের পরিচিতি হয় জে কে পেন্টার হিসেবে। রহিম সাহেবের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করলেও অর্ধ-শতাব্দীকাল লেখালেখির সূত্রে তাঁকে স্বশিক্ষিতই বলা যায়।
শেখ জালালুদ্দিনের বড়ো ছেলে প্রথমে বাবার দেখাদেখি সাইনবোর্ড আকা শুরু করলেও পরে অন্য পেশা গ্রহণ করেন।
কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাইনবোর্ড-আঁকিয়েরা হরফশিল্পী পিতার উত্তরাধিকার লাভ করেন। যেমন চন্দনগাছির পিন্টু বাহার।
পিন্টুর বাবা শান্তি বাহার ছিলেন চন্দনগাছির শহর এলাকার একমাত্র হরফ শিল্পী। স্থানীয় লোকেদের ডাকে শান্তি পেন্টার। দ্রুত দোকানপাট, ব্যবসাবাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে চন্দনগাছিকে মিউনিসিপ্যালিটি ঘোষণা করা হয়। তারপর জায়গাটা অধিকতর দ্রুতির সঙ্গে শহরে রূপ পায়। তখন প্রয়োজন-অনুযায়ী আরও জনাকয় পেন্টারের আবির্ভাব হয়। পিন্টু বাহার ছোটোবেলা থেকেই বাপের দোকানে এসে মন দিয়ে হরফ নির্মাণের কলাকৌশল, রংয়ের রহস্যময় মিশ্রণ, তুলির ব্যবহারিক কলাকৌশল, সাইনবোর্ডে শৈল্পিক মোটিফের প্রয়োগ ইত্যাদি লক্ষ্য করত। স্কুল থেকে ফেরার পথে খেলার মাঠে যাবার তাড়া উপেক্ষা করে খিদে-পেটেই বাবার কাজ দেখত ঘন্টার-পর-ঘন্টা। শান্তি পেন্টার চাননি তাঁর ছেলে তাঁর অমন অনিশ্চয়তাময় পেশায় আসুক। তিনি চাইতেন পিন্টু লেখাপড়া শিখে চাকরি করুক।
লেখাপড়া শিখেছিল পিন্টু। বি. কম. পাশ করেছিল সে। শান্তি পেন্টারের বয়স হয়েছিল, সঙ্গে ছিল ক্রনিক অ্যাজ়মা।
বাঁসের সিঁড়িতে, অর্থাৎ মইয়ে উঠলে পা কাঁপত তাঁর। হরফের রেখা-টানতে গিয়েও মনোযোগের ঘাটতি টের পেতে শুরু করেন শান্তি বাহার। পিন্টু আগে হতেই তুলি, রংয়ের কৌটো, তার্পিন তেল, তুঁতের-গদের-অ্যারারুটের-কাইবিচির-সিন্থেটিক আঠা, নানা ধরনের কাগজের মান-বিচার ও তাদের ব্যবহারের প্রকারভেদ নিয়ে চর্চা শুরু করে দিয়েছিল। দোকানের জন্য কিনে এনেছিল―ইংরেজি থেকে বাংলা, বাংলা থেকে ইংরেজি, বাংলা থেকে বাংলা ও ইংরেজি থেকে ইংরেজি―চারটি ডিকশনারি। পিন্টুর লক্ষ্য ছিল সাইনবোর্ড বা অন্যত্র―যা প্রকাশ্যে প্রদর্শনের জন্য তৈরি তাতে যেন বানান ভুল না থাকে। স্কুলের বাংলা মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গদোষে সে এই মত পোষণ করত যে, ভুল বানানের অবিরল ও নির্লজ্জ ব্যবহার একটি জাতির চরিত্র, স্বাতন্ত্র্যবোধ, রুচি ও সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করবার পক্ষে যথেষ্ট!
বাপকে মদত দিতে দিতে অবশেষে পিন্টু কবে যেন নিজেই পাকাপাকিভাবে তুলি হাতে তুলে নিয়েছিল। শান্তি পেন্টার বাধা দেননি, বরং ছেলের জন্য গর্ববোধ করেছিলেন।
অবিলম্বে পিন্টু সাইনবোর্ড, দেওয়াল, কাগজের পোস্টার, নেমপ্লেট ইত্যাদি সব কাজেই নতুন নতুন মাত্রা যোগ করে সমগ্র চন্দনগাছিতে একেবারে চমক লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু একটা জিনিস পিন্টু কখনও বদলায়নি। তা হলো বাবার ব্যবহৃত সিগনেচার মার্ক! শান্তি পেন্টার তাঁর সমস্ত কাজের নিচে ডানদিকের কোণায় বিশিষ্ট হাতের লেখা বা হ্যান্ড-
রাইটিং স্ক্রিপ্টে ‘**এস. বাহার**’ বলে নামসই করতেন। লেখাটা মনোগ্রাম বা এমব্লেম ধরনের ছিল। পিন্টু দোকানের যাবতীয় দাযিত্ব গ্রহণ করবার পর, এমন-কী শান্তি পেন্টার লেখালেখি থেকে সম্পূর্ণ অবসর নেওয়ার পরও পিন্টু বাহার সমস্ত কাজে বাবার নামের পুরোনো এমব্লেমই ব্যবহার করে চলেছে। বন্ধু-বান্ধব এ-নিয়ে প্রশ্ন তুললে সে হেসে বলে থাকে―‘আরে ভাই , বড়ো বড়ো কোম্পানির মতো ওটা আমাদের এই লিখন কোম্পানির লোগো।’
(ক্রমশ)
…………………………………….
(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)