অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৮। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

শেখ জালালুদ্দিন কামারুদ্দিন, যতীশ-শিবেন এবং সুমন

দেওয়ালে লেখা থেকে কাগজের পোস্টার―এই গঞ্জের এমনতর কাজের সব কিছুই এতকাল ধরে যতীশ আর শিবেনই করে এসেছে। কিন্তু সে-সবই বিনা পয়সায় বেগারস্বরূপ। এমন কী পাড়ার কাকিমা, বৌদিরা তাঁদের  ইস্কুলে-পড়া বাচ্চাদের ওয়ার্ক এডুকেশনের খাতা, সদরে বিটি পড়া ভাইপো-ভাইঝিদের লেসন প্ল্যানের খাতা, প্র্যাকটিস-টিচিংয়ের পোস্টার―সেসবও বিনি মাগনায়। অ্যামেচারের হদ্দমুদ্দ যাকে বলে। বিনিময়ে প্রাপ্য শুধু হাসি। প্রথম প্রথম দেওয়াল লেখার মুন্সিয়ানা দেখে নেতারা পিঠ চাপড়াতেন, প্রশংসাও করতেন। ইদানিং সেটুকু করাকেও তাঁরা বাহুল্য বলে মনে করেন।

এই দুজনের স্থায়ী কোনো পেশা না-থাকায় দুবেলা বাড়ির বাইরে দু-কাপ চায়ের পয়সা জোটাতে দুই শিল্পী (যাদের বাপ-জ্যাঠা-কাকারা, এমন-কী আড়ালে-আবডালে সহযোগী কর্মীরাও শিল্পীর বদলে ঝুল্্পি বা কুলপি বলে থাকেন) একেবারে জেরবার। তবে যতীশ আর শিবেনের ক্ষেত্রে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর উদাহরণ নিতান্তই খাপ খায় না। কেননা তাদের দুজনেরই ঘরে খাবার নেই। যতীশের বাপের মৃত্যুর পর তাদের বিঘে দশেক জমির প্রায় সবটাই দাদারা বাঁটোয়ারা করে নিয়ে নেবার পর তার ভাগে নিচু ডোবা জমি বর্তেছে বিঘা-দুয়েক। মা তাঁর ছোটো ছেলে যতীশকে নিয়ে বাস্তু জমির এককোণের ভাঙা ঘরটাতে বসত করেন। তার ভাগের দু-বিঘায় ধান বা গম যা হয় তাতে চাষের খরচ ওঠে না। তাছাড়া অমন জমি চাষ করার পুঁজিও মা-ব্যাটার নেই। সে-জমি তাই ভাগে দেওয়া আছে। যতীশের নিজস্ব কোনো স্থায়ী পেশা ছিল না। চারপাশের দশটা গ্রামে ছেড়ে পালা মুরগির ডিম কিনে এনে গঞ্জের বাজারে বিক্রি করা, পুজোর মরশুমে সদরে গিয়ে কাপড়ের দোকানে কাজ করা, ধান উঠবার সময় চালকলে দৈনিক মজুরিতে জোগাড় দেওয়ার কাজ, গঞ্জের পূবের মাঠে মিন্টু পাটিদারের গুল কারখানায় লেবারের কাজ, লোকের বাড়িতে বাগানের কাজ―ইত্যাদি যখন যা জোটে আর কী! মা এখনও অসংখ্য পুকুর বা ডোবার ধারে, মাঠেঘাটে গজিয়ে থাকা বেওয়ারিশ শাকপাতা তুলে বাজারে ‘বিক্কিরি’ করে, মুড়ি ভেজে, অপরের ধানসিদ্ধ করে দু-মুঠো জোগান―তাই দুবেলা ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হয় যতীশের।

শিবেনের অবস্থা আরও সরেস। বন্ধুর সঙ্গে সদর থেকে পল্লী-এলাকার হাট পর্যন্ত সর্বত্র দৌড়েও ছুটকো কাজ ছাড়া আর কিছু জোটে না তার। দাদাদের সংসারে টাকা দিতে পারে না বলে দুবেলা যে খাবার জোটে তাতে পেট ভরে না, কিন্তু প্রত্যহ অভিমানী বেদনার মেঘ জমা হয় শিবেনের শিল্পী-চিত্তাত্মার মর্মদেশে।

তবু হরফে প্রাণসঞ্চারের টানে বার বার তাদের ফিরে আসতে হয় লিপিকর্মের অদ্ভুত স্বপ্ন-নেশায়।

সুমনের সান্নিধ্যে, সাইনবোর্ড লেখা এবং প্রচার-জ্ঞান শিল্পের সংস্পর্শে এই প্রথমবার দুই বন্ধু বুঝতে পারল যে, তাদের এই শিল্পকর্মের মূল্য যাচাইয়ে বিনামূল্যে সুবিধা লাভকারী বুদ্ধিমানদের চাটুপূর্ণ স্তুতিবাদ ছাড়াও অন্যতর মাপকাঠি আছে। এবং সেই মাপকাঠি খুবই বাস্তব। তার পোশাকী নাম টাকা! আর ডাকনাম জীবিকা!

এই প্রথমবার যতীশ আর শিবেন তাদের কাজের জন্য নিয়মিত অর্থ লাভ করে, জীবিকার্জনের নিশ্চয়তা পেয়ে বিশেষ চরিতার্থতার বোধে উদ্দীপ্তি অর্জন করল।

আমাদের অপেশাদারিত্বের কর্কশ নখরাঘাতে যতীশ-শিবেনের মতো শতেক লিপিশিল্পী বাংলা তথা ভারতের গ্রাম-শহর-গঞ্জ-বসত এলাকায় প্রতিদিন রক্তাক্ত হয়ে এসেছে! এঁদের কারও নাম শিবুরাম, কারও নাম নিধু লস্কর, কারও নাম শেখ জালালুদ্দিন কামারুদ্দিন, কারও নাম আশিক হুসেইন, কারও নাম ভালি মহম্মদ মীর কুরেশি, কারও নাম অববিন্দভাই পারমার, কারও নাম ফটিক দাস, কারও নাম বিপুল সেনরায়, পিন্টু বাহার―আবার কেউ সাক্ষাৎ আমাদের সুমন। এঁদের কারও বাড়ি পুরুলিয়ায়, কারও চন্দননগরে, কারও বাস দমদম নাগেরবাজারে, কারও চন্দনগাছির শহর এলাকায়, কারও দেশ খুলনা বা বরিশালে, কারও বা আমেদাবাদে, আর কেউ-বা আমাদের সুমনের মতো গৃহহারা, সবজায়গায় বহিরাগত, সর্বত্র অনুপ্রবেশকারী। এঁরা নামে ভিন্ন, বসবাসে ভিন্ন, কাজেও ভিন্ন। কিন্তু সময়ের আঘাতে সকলে সমানভাবে আহত ও রুধিরলিপ্ত!

যেমন শেখ জালালুদ্দিন কামারুদ্দিন।

আমেদাবাদবাসী সাইনবোর্ড লিখিয়ে জালালুদ্দিন কামারুদ্দিন।

আমেদাবাদের ঘীকান্ত অঞ্চল বস্ত্রশিল্প, গহনা, চামড়ার কাজ, হাতির দাঁতের শিল্পসামগ্রী, পিতলের কাজের জন্য খ্যাত। ঘীকান্তে আরেকটি জিনিস পাওয়া যায়, তা হলো কাঁচি―দর্জির কাঁচি। এখানে কাঁচি বিপণনের জন্য আলাদা পট্টি বা পাড়া আছে। ঘীকান্তে একই রকমের সারি সারি কাঁচির দোকান দেখা যায়। কিন্তু এখানকার অধিকাংশ দোকানই জালালুদ্দিনের আঁকা সাইনবোর্ডের সুবাদে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করেছে। ‘জালালুদ্দিন সাহেবের সাইনবোর্ডের কৃপায় প্রতিটা বিপণী স্বকীয়তায় অনন্য।’ (অথর্ব বনকুন্দ্রে : ২০২৪)

―‘ম্যাঁয়নে কভি দো বোর্ড এক জ্যায়সা নহিঁ বনায়া।’ অর্থাৎ আমি জীবনে কোনওদিন একরকম দেখতে দুটো বোর্ড বানাইনি’ ―জানিয়েছেন শেখ জালালুদ্দিন কামারুদ্দিন।

শুধু কাঁচি পট্টিতে নয় ঘীকান্তসহ সমগ্র আমেদাবাদেই শেখ জালালুদ্দিনের আঁকা প্রচুর বোর্ড নজরে আসবে।  বোর্ড ছাড়াও দোকানের শাটার আর দিওয়ার বা দেওয়ালেও তাঁর তুলির কাজ দৃশ্যমান।

মাত্র বিশ বছর বয়সে হরফ শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করে বিগত পঞ্চাশ-বাহান্ন বছর ধরে তিনি এই কাজ করে চলেছেন। মাত্র সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও সাইনবোর্ড আঁকতে আঁকতে তিনি একাধিক ভাষা এবং তার বর্ণমালা আয়ত্ত করেছেন। গুজরাতি, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি ও আরবি―এই পাঁচটি ভাষার বর্ণমালায় জালালুদ্দিন বোর্ড লেখেন।

বস্তুত যে-কোনো বড়ো বা মাঝারি শহরে একাধিক ভাষার হরফ লিখতে পারাটা জরুরি। এটা ঠিকই যে, হরফ লেখাটা বহুলাংশে ছবি আঁকারই মতো। অর্থাৎ হরফের চেহারা দেখে লিখন-শিল্পী সেই হরফের প্রতিলিপি অঙ্কন করেন, কিন্তু সেটুকু জ্ঞানই যথেষ্ট নয়।

বোর্ড লিখবার কাজে সফলতা অর্জন করতে হলে একাধিক স্থানীয় ভাষায় ও আঞ্চলিক শব্দবন্ধে মোটামুটি জ্ঞান থাকাটা খুবই দরকার।

সাইনবোর্ড লেখার শুরুর সময়ে, তখনও যতীশ-শিবেন তাঁর সঙ্গে এসে ভেড়েনি―এক ভদ্রলোক এসে একটা বিজ্ঞাপন লিখতে দিয়ে গেলেন। ছোটোমাপের টিনের টুকরোর ওপর লিখতে হবে। প্রায় পঁচিশটা বোর্ডের অর্ডার। শুরুর সময়ে বড়ো কাজের বরাতই  বলতে হবে।

বেশ খোশমেজাজেই ছিলেন সুমন। বাদল মুন্সি শক্ত ও দামি টিনের শিট কেটে বানিয়ে দিল ছোটো ছোটো আয়তকার বোর্ড। সেগুলোর জমিতে হালকা ঘিয়ে রং ফলিয়ে শুকোতে দিয়ে গেল।  রাত্রিবেলা গোপাল বাড়ুজ্যের আড্ডা থেকে ফিরে বোর্ডগুলোতো হাত দিয়ে দেখলেন রং শুকিয়ে গেছে।

সুমন ভাবলেন―রাতেই দুটো-একটা লিখে ট্রায়াল দিয়ে রাখবেন।

ড্রয়ার থেকে ভদ্রলোকের ম্যাটার লিখে দেওয়া ভাঁজ করা কাগজটা খুলেই চক্ষু চড়কগাছ! সকালে ম্যাটারের আয়তন দেখা  ছাড়া অতটা মন দিয়ে লেখাটা দেখেননি। ভদ্রলোকের হাতের লেখা অত্যন্ত খারাপ। সেখানে লেখা চাষের জমিতে, কিংবা ঘরের কোণে / উইমেকা ধ্বংস করতে দিন / উইমেকা-বিনাশ

সুমন ভাবলেন  উইমেকাটা আবার কী বস্তু? উইপোকা লিখতে গিয়ে উইমেকাটা লেখা হলো নাকি! কিন্তু দু-জায়গায় একই ভুল! বোর্ডে লেখা উঠলো মাথায়―এমন সংশয় নিয়ে তো আর লেখা চলে না।

কিন্তু এত রাতে কাকে শুধান? মুস্কিলআসান গোপাল বাড়ুজ্যেকে? তখনও মোবাইল ফোনের মহামারী দেখা দেয়নি। বাড়ির মালিক, অর্থাৎ গোপাল বাড়ুজ্যের শালাকে ডাক দেবেন নাকি! কিন্তু প্রতিদিনের মতো আজও ওদের ঘরের সব আলো বহু আগেই  নিভে গেছে।

সুতরাং সারা রাত কাটল অস্বস্তিতে।

সক্কালেই  শালাবাবুকে পেলেন কলতলায়।

কাগজটা দেখাতেই শালাবাবু বীরেন ভটচাজ্ হেসে বললেন―‘হাতের লেখাটা আমার থেকেও খারাপ হলেও এ তো লিখেছে ঠিকই।’

―‘উইমেকা মানে কী?’

বীরেন ভটচাজ্ মুখে কিছু বললেন না, তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন পেছনের বাগানে। তর্জনি দিয়ে একটা বড়ো উইঢিপির দেখিয়ে বললেন―‘ঐ যে উইমেকা। আপনাদের কলকেতার ভাষায় কী বলে যেন―।’

―‘উইঢিপি।’ বললেন সুমন। বুঝলেন ক্লায়েন্ট ভদ্রলোক নিশ্চয়ই উইঢিপি ধ্বংস করার কোনো ওষুধ বানিয়ে উইমেকা-বিনাশ নাম দিয়েছেন এবং  তার বিপণনের স্বার্থে আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন।

যতীশ আর শিবেনকে পেয়ে এই সমস্যা দূর হয়েছিল। শিখেওছিলেন অনেক কিছু।

(ক্রমশ)

…………………………………….

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *