অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৩৬। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে ‘ক্লিন ট্রেন আন্দোলন’ বাস্তবায়ন কার্যকরভাবে সাবওয়ে গ্রাফিতি যুগের সমাপ্তি চিহ্নিত করে, কারণ এমটিএ সফলভাবে তার ট্রেন থেকে প্রায় সমস্ত গ্রাফিতি অপসারণ করে। যদিও এই অভিযানের ফলে সাবওয়েতে গ্রাফিতি হ্রাস পায়, এটি সম্পূর্ণরূপে গ্রাফিতি নির্মূল করতে পারেনি। শিল্পীরা কেবল তাদের মনোযোগ অন্যান্য পাবলিক স্পেস, যেমন ছাদ, দেয়াল এবং মালবাহী ট্রেনের দিকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। সাবওয়ে ক্যানভাস হারিয়ে যাওয়ার ফলে অনেক গ্রাফিতি লেখক নতুন শৈল্পিক পথ অন্বেষণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যার ফলে রাস্তার শিল্প এবং অন্যান্য ধরনের শহুরে অভিব্যক্তির বিকাশ ঘটে।

রাস্তার শিল্পের শৈল্পিক-মনন এবং সৌন্দর্য সৃষ্টির স্বভাব-প্রকৃতি সত্ত্বেও, শহরের স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলি (কর্পোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটি বা সিটি কাউন্সিল) গ্রাফিতিকে ধ্বংসাত্মক হিসাবে চিহ্নিত করেছিল এবং গ্রাফিতিশিল্পের প্রসারজনিত সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি চালু করেছিল। বিশেষ করে ফিলাডেলফিয়া এবং নিউ ইয়র্কের মতো শহরে গ্রাফিতিকে নৈরাজ্যের, বিশৃঙ্খলার এবং ক্ষতিকারক নোংরা শিল্প আখ্যা দিয়ে গ্রাফিতির বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। শহর কর্তৃপক্ষ (নিউ ইয়র্ক সিটি কাউন্সিল)  টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে, গ্রাফিতিগুলিকে মুছে ফেলার জন্য বিরাট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এমন-কী গ্রাফিতি অঙ্কনের সরঞ্জাম (অনুমতি ছাড়া কোনো দেয়ালে ছবি আঁকাসহ অ্যারোসল স্প্রে পেইন্ট ক্যান, চওড়া টিপযুক্ত অমোচনীয় মার্কার বা এচিং অ্যাসিড) বিক্রি বা বিক্রির জন্য প্রদর্শন কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা বহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি, শিল্পীকে গ্রেপ্তার ও হেনস্থা ইত্যাদি করতেও রাষ্ট্র দ্বিধা করেনি।

গ্রাফিতি নিষিদ্ধ শিল্প―এমন এক পূর্বনির্ধারিত শাসকীয় ধারণা থেকে গ্রাফিতি-শিল্পীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের  মাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় : ২০০৩ সালে ১,২৩৭ জন থেকে ২০০৪ সালে ১,৪৪৬ জন, ২০০৫ সালে ২,৫৮৫ জন এবং গত বছর ২,৯৬২ জন। এই বছরের প্রথম ছয় মাসে ১,৫৮৩ জন গ্রাফিতি গ্রেপ্তার হয়েছে। গ্রাফিতি সম্পর্কিত অভিযোগের সংখ্যাও ৩১১ জনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৪ সালে ২,৬৬১ জন, ২০০৫ সালে ৪,৮৬১ জন এবং ২০০৬ সালে ৭,৪০৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

নিউ ইয়র্ক সিটি কাউন্সিল-প্রদত্ত হিসেবে দেখা যায় যে, ২০০২ সাল থেকে, নিউ ইয়র্ক সিটি ৭৭ মিলিয়ন বর্গফুটেরও বেশি গ্রাফিতি অপসারণ করেছে। কোনো কোনো বছরে নগর-কর্তৃপক্ষীয় সংস্থাগুলি গ্রাফিতি পরিষ্কার করার জন্য রঙ, শ্রম এবং সরঞ্জামের জন্য প্রায় ১৩.৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।

শাসকের গ্রাফিতি-ভীতি এতটাই যে, গ্রাফিতি শিল্পীর ব্যক্তিগত গোপনতা ভেঙে রাস্তার শিল্পী ও পপ আইকন শেফার্ড ফেইরি (জন্ম : ১৯৭০) যখন, সম্ভবত ২০০৮ সালে ভাবি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পোস্টার আঁকেন তখন তিনি অভিনন্দিত হন, কিন্তু মানবতার বিপর্যয় সম্পর্কে সদা সচেতন ও প্রতিবাদী ফেইরি এর মাত্র তিন সপ্তাহ পরেই বোস্টনের ইনস্টিটিউট অফ কনটেম্পোরারি আর্টসে তার একক প্রদর্শনীর উদ্বোধনের পথে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। ফেইরিকে বারংবার নানা ধরনের আইনি ঝামেলা ও প্রশাসনিক বিধিনিষেধ এবং হেনস্থার শিকার হতে হয়। তথাপি ফেইরি ইরাক যুদ্ধের প্রতিবাদ করেছিলেন, অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রীটকে সমর্থন করেছিলেন, পুিলশের হাতে নিহত আফ্রিকান-আমেরিকান কিশোর ট্রেভন মার্টিনের প্রতিকৃতি ও নেলসন ম্যাণ্ডেলার বহুতল ম্যুরাল তৈরি করেছিলেন।

কেইথ অ্যালেন হ্যারিং (১৯৫৮-১৯৯০) প্রথমদিকের সবচেয়ে উদ্যমী ও প্রতিভাবান গ্রাফিতি আর্টিস্টদের একজন। এজন্য তাকে ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে অনেক। সম্পত্তি ধ্বংস, পরিবেশ দূষিতকরণসহ নানা অভিযোগে বেশ কয়েকবার পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করেছে, কিন্তু গ্রাফিতির মায়া তাকে ছাড়তে পারেনি কখনও। (সাদমান শাকিব : ২০২০) আধুনিক সময়ে স্ট্রীট আর্টের আন্দোলন শুধু আমেরিকায় আটকে থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বে। হ্যারিংকে কখনও শুধু শিল্পী বলে সম্বোধন করা হয় না, সব সময়েই তাঁর পরিচয় উল্লেখ করা হয় শিল্পী ও সোসাল অ্যাক্টিভিস্ট বা সমাজকর্মী হিসেবে। তার প্রমাণ হ্যারিং-কর্তৃক নির্মিত ‘ক্র্যাক ইজ ওয়্যাক’ নামের ম্যুরালটি। ১৯৮৬ সালে নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনের পূর্বে হারলেম রিভার ড্রাইভের কাছে ক্র্যাক কোকেন নামক মাদক ব্যবহারের বিরুদ্ধে এই ম্যুরালটি নির্মিত হয়। ১৯৮০-র দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহরগুলিেত দরিদ্র ও শ্রমজীবী এলাকায় ক্র্যাক কোকেনের ব্যবহার আশঙ্কাজনক সামাজিক বিপন্নতা হয়ে দেখা দেয়। শিল্পী ও সমাজকর্মী হিসেবে হ্যারিং সক্রিয়ভাবে এর প্রতিবাদ করেন। এমন এক সমাজচেতন গ্রাফিতি শিল্পীও রাষ্ট্রীয় হয়রানি থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেননি!

ফিউচুরা ২০০০ ছদ্মনামে লিওনার্ড হিলটন ম্যাকগার (জন্ম : ১৯৫৫) িনউ ইয়র্ক গ্রাফিতিকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে অতি অল্প বয়সেই ফিউচুরা ২০০০ নিউ ইয়র্ক সাবওয়েতে বেআইনি গ্রাফিতিতে হাত পাকান।  কেইথ হ্যারিং ছাড়াও সমকালীন মার্কিন গ্রাফিতি শিল্পী জিন-মিশেল বাসকিয়াত, রিচার্ড হ্যাম্বলটন (১৯৫৭-২০১৭. কানাডিয়ান শিল্পী), কেনি স্কার্ফ (জন্ম : ১৯৫৮) প্রমুখের সঙ্গেই গ্রাফিতি শিল্পী হিসেবে তাঁর উত্থান ঘটে। ফিউচুরাকে বিমূর্ত গ্রাফিতির দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম সেরা প্রবক্তা ও শিল্পী হিসেবে গণ্য করা যায়।

এই সময়েই ‘দি ম্যুরাল কিংস’ নামে পরিচিত ট্যাট ক্রু-ও নিউ ইয়র্ক গ্রাফিতির এক উল্লেখযোগ্য নাম। ট্যাট ক্রু দক্ষিণ ব্রঙ্কসের একটি কিংবদন্তি গ্রাফিতি দল বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা অবৈধ গ্রাফিতি দল হিসেবেই কাজ শুরু করেছিল। এছাড়াও টাকি ১৮৩, জুলিও ২০৪, পূর্বোল্লেখিত ট্রেসি ১৬৮, স্টে হাই ১৪৯ প্রমুখ গ্রাফিতি শিল্পীরা নিউ ইয়র্ক গ্রাফিতি সম্প্রদায়ের  মধ্যে খ্যাতি পান। সকলেই নিষিদ্ধ দেয়াল শিল্পী হিসেবে নিজেদের দেয়াল ও রাস্তার শিল্প শুরু করেছিলেন। পরে এদের অনেকেই বাণিজ্যিক সফলতা ও একই সঙ্গে গ্যালারি ও মিউজিয়াম-আশ্রিত শিল্পী হিসেবে কিংবা অনুমোদিত নানা কর্তৃপক্ষের কাজ হতে বৈধ বরাত পেয়ে শিল্পরচনা করে স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। কিন্ত সম্ভবত ফেইরি, হ্যারিং প্রমুখ রাষ্ট্রীয় হয়রানি, বিরুদ্ধতা, অভিযোগের সম্মুখীন হওয়া থেকে কখনও রেহাই পাননি। ১৯৮০-র দশকে নামক বিখ্যাত গ্রাফিতি শিল্পী থ্রিডি [আসল নাম : রবার্ট ডেল নাজা (জন্ম ১৯৬৫)] আমেরিকা থেকে ইংলন্ডে ফিরে ব্রিস্টলে ঘাঁটি গাড়েন। এছাড়া ইংকি, নিক ওয়াকার (জন্ম : ১৯৬৯) প্রমুখও ছিলেন।

আমেরিকায় গ্রাফিতি শিল্পীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ও মুনাফা-নায়কদের জাতক্রোধের কারণ শুধুমাত্র গ্রাফিতির প্রতিষ্ঠানবিরোধী চরিত্র নয়। গ্রাফিতির রাজনৈতিক চরিত্রের কারণেও বটে! দেয়ালে দেয়ালে খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, বর্ণবাদ বিরোধিতাকে বিশ্বপুঁজিবাদের কেন্দ্র আমেরিকার ক্ষমতাবানদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। টেক্সাসের রাস্তায় একেবারে কাস্তে-হাতুড়িসহ শ্রমিকের দাবি বা সমাজতন্ত্রী বিপ্লবের ডাককে সর্বদা কমিউনিজমসহ বামপন্থার ভূত দেখা আমেরিকার পক্ষেসহ্য করা মুশকিল।

১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি ব্রিটেনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় স্বভাবতই গ্রাফিতির ভেদশক্তি ও প্রসার ক্ষমতা বেড়ে যায়। ইংলন্ড প্রবাসী রুহুল মাহফুজ জয় লেখেন যে, অর্থনৈতিক মন্দাজনিত নৈরাজ্য গ্রাফিতি শিল্পকে উস্কে দেয়, সমগ্র ব্রিস্টলের দেয়ালগুিল গ্রাফিতি আর্টে ভরে ওঠে। মানুষের মধ্যে অস্থিরতা ছড়ানোর অভিযোগে ১৯৮৯ সালে পুলিশ ও প্রশাসন গ্রাফিতি শিল্পীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়, ‘অপারেশন অ্যান্ডারসন’ নামের এই অভিযানে থ্রিডি, ইংকিসহ প্রচুর গ্রাফিতি শিল্পীর ডেরায় পুলিশ হানা দেয়। শিল্পীদের গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারে প্রায় পঞ্চাশ জন (?) গ্রাফিতি শিল্পীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পরে ব্রিস্টলের গ্রাফিতি জগতে ব্যাঙ্কসির স্বমহিমায় আবির্ভাবের পরে সম্ভবত মুখ্যত ব্যাঙ্কসির কারণেই ব্রিস্টলকে ইংলন্ডের গ্রাফিতি-রাজধানী বলা হতে থাকে। এখানকার স্ট্রীট আর্ট ফেস্টিভ্যাল তো সুবিখ্যাত। ব্রিস্টলের প্রধান স্থানের দেয়ালগুলি দক্ষ রাস্তার শিল্পীদের বিখ্যাত ও দৃষ্টিনন্দন ম্যুরালে পরিপূর্ণ (এঁদের মধ্যে আছেন : জোডি, নোমাড ক্ল্যান, ফিল্থ অ্যান্ড এন৪টি৪, এল৭এম, অ্যান্ড্রু বার্নস কোলউইল, ইনসেন৫১, ওডিথ, আন্নাটোমিক্স, রক্স অ্যান্ড লস্টে, ভয়ডার, গাই ডেন্নিং, নুনো ভাইগাস অ্যান্ড টাইমন টে লাট, অ্যাঙ্গাস, কারো পেপে, লুই মাসাই, জো পাওয়ার, স্নাব, চায়না গার্ল, পিয়েট রডরিগেজ, হানা অ্যাডামাসজ়েক, জেরোম ডাভেনপোর্ট, টিম মার্শ।

কিন্তু শাসক ও তাদের তল্পিবাহকদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাননি ব্যাঙ্কসির মতো শিল্পের মূলধারাতেও সর্বজনস্বীকৃত সুবিখ্যাত ব্রিটিশ গ্রাফিতি শিল্পীও।

ব্যাঙ্কসি ও তাঁর সহযোগীরা ২০০৫ সালের আগস্টে, ইজরায়েলের প্যালেস্টাইন নীতির বিরুদ্ধে গ্রাফিতি অঙ্কনের জন্য প্যালেস্টাইন সফরের সময় ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের পৃথকীকরণ প্রাচীর (প্যালেস্টাইন থেকে নিজেদের অধিকৃত এলাকাকে আলাদা করার জন্য ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষ ৪৫০ মাইল লম্বা এই প্রাচীরটি গায়ের জোরে নির্মাণ করেছিল। রাষ্ট্রসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এই নির্মাণকাজকে অবৈধ ঘোষণা করা সত্ত্বেও ইজরায়েল প্রাচীর নির্মাণে বিরত হয়নি)-এর গায়ে ৭টি বৃহৎ ম্যুরাল এঁকেছিলেন। ম্যুরালটি অঙ্কনের সময় ইজরায়েলি বাহিনী ভয় দেখাবার জন্য শূন্যে গুলি চালায়। ব্যাঙ্কসিসহ শিল্পীদলটির দিকে বন্দুক নিশানা করে ভীতিপ্রদর্শন করে।  এই বাধা সম্পর্কে অকুতোভয় ব্যাঙ্কসির অনুভূতি ছিল : ইজরায়েল ‘ফিলিস্তিনকে বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত করেছে।’

নিজের ওয়েবসাইট ‘ব্যাঙ্কসি এক্সপ্লেইনড’-এ বাধাদানের বিষয়টিকে কটাক্ষ করে ব্যাঙ্কসি এই প্রশ্ন তোলেন যে, যেখানে প্রাচীরটির নির্মাণ নিজেই আন্তর্জাতিক নিয়মে অবৈধ, সেখানে তার গায়ে গ্রাফিতির নির্মাণ কীভাবে বা কতটাই বা বেআইনি হতে পারে?

আর্থিকভাবে সফল ব্যাঙ্কসির শিল্পকর্ম কিন্তু আদৌ নিছক সৌন্দর্য-উদ্দীপক অথবা সময়-বিচ্ছিন্ন শৈল্পিকতার পরিপোষক নয়। ব্যাঙ্কসির রচনা প্রবলভাবে যুদ্ধবিরোধী, ফ্যাসিবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, কর্তৃত্ববাদবিরোধী বয়ানে সমাকীর্ণ। মানবতাবাদবিরোধী যে-কোনো অবস্থান তাঁর রচনায় আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। সর্বোপরি ব্যাঙ্কসি দ্ব্যর্থহীনভাবে বিশ্বপুঁজিবাদ ও তার দোসর কর্পোরেট শোষণ ও কর্পোরেট সংস্কৃতির সমালোচনা করেছেন। পঁুজিবাদ-পোষিত ভোগবাদ, ভোগবাদী সংস্কৃতির বিপদের দিকগুলি, ভণ্ডামি, লোভ, হতাশা, গতানুগতিকতা, একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতা, নৈরাশ্য ইত্যাদির শরশয্যা রচনা করেছে ব্যাঙ্কসির চিত্রকলা এবং গ্রাফিতি। ব্যাঙ্কসি তাঁর চিত্রকলায় তীব্রভাবে ভোগবাদী সংস্কৃতির নিন্দা করেছেন।

অনেকেই ব্যাঙ্কসির রচনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেখেছেন যে, তাঁর সৃষ্টিতে ‘সবচেয়ে পুনরাবৃত্ত বিষয়গুলির মধ্যে একটি হলো যুদ্ধবিরোধী বার্তা।’ প্যালেস্টাইনের পৃথকীকরণ প্রাচীরে যুদ্ধকে ব্যঙ্গ করে বানানো সাতটি গ্রাফিতি ছাড়াও এ-বিষয়ে ব্যাঙ্কসির গ্রাফিতি ‘দি ফ্লাওয়ার  থ্রোয়ার’, ‘নো’ (গ্রাফিতি-গার্ল উইথ বম্ব), ফ্রি হাগ ইত্যাদি অজস্র রচনায় স্পষ্টভাবে শান্তিবার্তার প্রচারণা আছে― ‘দি ফ্লাওয়ার  থ্রোয়ার’-এ একজন বিক্ষোভকারী বোমা বা মোলোটভ ককটেলের পরিবর্তে ফুলের ছঁুড়ছে, গ্রাফিতি গার্লের বোমা জড়িয়ে থাকা, কিংবা বন্দুকধারী সৈন্যকে ফ্রি হাগ করতে চাওয়া বালকের ছবি। ব্যাঙ্কসি পুঁজিবাদের সঙ্কটমোচন প্রক্রিয়ার স্বার্থে ঘনিয়ে তোলা যুদ্ধবাদকে সরাসরি এই বলে আক্রমণ করেছেন যে, নিয়ম বা আইনভঙ্গকারীরা আদৌ জগতের সবচেয়ে বড়ো অপরাধী নয়। বরং নিয়ম অনুসরণকারীদের দ্বারাই বেশি অপরাধ সংঘটিত হয়। এই আদেশ অনুসরণকারীরাই বোমাবর্ষণ করে অগণিত গ্রাম (এবং জনপদ) ধ্বংস করে বেশি অপরাধ করে (‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো অপরাধগুলো নিয়ম ভাঙার মাধ্যমে সংঘটিত হয় না, বরং নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমেই হয়। বোমা ফেলার এবং গ্রাম ধ্বংস করার নির্দেশ মেনে চলা মানুষই এই ধরনের অপরাধ করে’)। রুহুল মাহফুজ জয় অনুমান করেছেন যে, ব্যাঙ্কসিই প্রথম আর্টিস্ট যিনি আমেরিকা-ব্রিটেনের ইরাক যুদ্ধকে ‘রঙ ওয়ার’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ব্যাঙ্কসি অক্লান্তভাবে যুদ্ধবাজদের ব্যঙ্গ করে এসেছেন, সেই সঙ্গে দিয়ে আসছেন শান্তির বার্তা। জয় ব্যাঙ্কসির সূত্রেই যুদ্ধবিরোধিতায় গ্রাফিতির ভূমিকাকে চার্লি চ্যাপলিনের কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ‘চ্যাপলিনের সিনেমা মানেই তো ডার্ক হিউমারে ভরা পলিটিক্যাল বার্তা।’  গ্রাফিতির কাজও একই ধাঁচের। সেই হিসাবে জয় চ্যাপলিনের সিনেমাকে সিনেমাটিক গ্রাফিতি বলতে চেয়েছেন। (রুহুল মাহফুজ জয় : ২০২১)

চাই কি, ব্যাঙ্কসি খোলাখুলি পুঁজিবাদের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে― ‘আমরা বিশ্বের পরিবর্তন করার জন্য কিছুই করতে পারি না যতক্ষণ না পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়।’ ব্যাঙ্কসি ভোগবাদকে বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখেছেন, তাই এই বলে ব্যঙ্গও করেছেন যে, এর মধ্যে (অর্থাৎ পুঁজিবাদ যতক্ষণ ধ্বংস না হয়, সেই অবসরে) আমাদের সকলের উচিত শপিং বা কেনাকাটায় ব্যস্ত থেকে নিজেদের সন্তুষ্ট করা ও সান্ত্বনা দেওয়া (‘ইন দি মিনটাইম উই শ্যুড অল গো শপিং টু কনসোল আওয়ার সেলভস্’)। উক্তিনিচয়ের মধ্যে এমন উক্তিও পাওয়া যায়, যেখানে ভোগবাদের মহামারি ছাড়াও, ব্যাঙ্কসি লক্ষ্য করেন যে, অর্থ আর ক্ষমতাই আধুনিক পুঁজিবাদের পরাশক্তির বিশেষাধিকার, এবং তাদের তথাকথিত শুভশক্তির প্রতীকগুলি সমস্ত রকমের অশান্তির উস্কানিদাতা।

(ক্রমশ)

……………………………………

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply