অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৩৫। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

কলকাতায় বিভিন্ন রাস্তায় (পার্ক স্টীট, কীড স্ট্রীট, বেহালা, হাতিবাগান, লাউডন স্ট্রীট, লেক গার্ডেনসের ডা. দেওধর রহমান রোডের পরিত্যক্ত ওয়ারহাউজের গুদাম, সেন্ট লরেন্স হাই স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেয়াল, লা মার্টিনিয়ার ফর গার্লস, লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজের প্রাচীর, লেনিন সরণির আদা জোন্স লি মেমোরিয়াল স্কুলের সম্মুখের দেয়াল, জাস্টিস চন্দ্রমাধব রোড, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, বালিগঞ্জের পঙ্কজ মল্লিক সরণি, হিন্দুস্থান পার্কের মারবেলা, রবীন্দ্রসদন মেট্রো, সাবওয়ে, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দুস্থান পার্ক এলাকা, বিশপ লেফ্রয় রোড, এ জে সি বোস রোড, কুমারটুলি, কলেজ স্ট্রীট, সদর স্ট্রীট, কলকাতা ট্রাম ডিপো, শরৎ বোস রোড, বালিগঞ্জ প্লেস, লেক টেরেস, গড়িয়াহাট, নিউ আলিপুর স্ট্রীট, টেরেটি বাজার, লাউডন স্চ্রীট, শোভাবাজার, শ্যামবাজার দেশবন্ধু পার্কের কাছে, শ্যামবাজার কফি হাউজের দেয়ালে, শ্য়ামবাজার অরবিন্দ সরণি,  মোমিনপুর, ডা. এম. ডি. ইসহাক রোড, পার্ক হোটেল, বাগুইহাটি জোড়ামন্দির সাবওয়ে,  রবীন্দ্রসদন মেট্রো, মির্জা গালিব স্ট্রীট, বো ব্যারাক অঞ্চল, সাদার্ণ এভিনিউ, নিউ টাউনের ম্যুরাল ফেস্ট, ডোভার লেন, মিন্টোপার্ক, কেয়াতলা লেন, দমদম বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোচ রোড, হাওড়া ব্রিজ…ও অন্যত্রও) সংখ্যা-প্রাচুর্যে বিস্ময়কর গ্রাফিতি, দেয়ালচিত্র, দেয়াললিপির দেখা মেলে। বিশেষ বিশেষ স্থানে অঙ্কিত হয় স্মারক-গ্রাফিতি ও গ্রাফিতি-পোর্ট্রেট, যেমন : সংবাদপত্রের অফিসের বিপরীত দিকে বিদ্যুৎ বক্সের গায়ে কবি সাংবাদিকদের ম্যুরাল-পোর্ট্রেট।

সেসবের মধ্যে অলংকরণ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক লিপি―সবই দেখা যায়। বিষয়ের মধ্যে আছে নকশা, পুরাণ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সামাজিক কার্যক্রমের বিজ্ঞাপন, আহ্বান, খেলা, উৎসব, টাইপোগ্রাফি, লোকচিত্রকলা (যেমন : আলপনা ও মোটিফ), দেয়াল সজ্জার উদ্দেশ্যে কাল্পনিক চিত্রাবলী, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সামাজিক বার্তা, নারী স্বাতন্ত্র্য, লিঙ্গভেদ ও পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতাসহ নানাবিধ সামাজিক বার্তা, বিভিন্ন সংক্রমক রোগ থেকে সাবধানতার বার্তা, নগরের সবুজায়ন, পাটুলি অঞ্চলে গুরুপদ বাছারের রাস্তার তিনশো ফুট জুড়ে করা আলপনা ইত্যাদি থাকলেও বাংলার দেয়াললিপির সংখ্যাগুরুই লেখা হয় বিভিন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ( সেখানে ছবি, কার্টুন, পদ্য, ছড়া, প্যারোডি, নিছক কটুক্তির পাশিপাশি সগৌরব অবস্থান) । তাছাড়া বিভিন্ন উৎসবের (মুখ্যত শারদোৎসব) সময় রাস্তাঘাট, দেয়ালে তীব্র ও প্রাণবন্ত রঙে নানাবিধ নকশা, ঐতিহ্যবাহী আলপনা (ইদানিং গুঁড়ো রঙ দিয়ে রঙ্গোলি) আঁকা হয়।

কলকাতার দেয়াল চিত্রের একটা বড়ো অংশ খেলাধূলাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। বিশ্বকাপ ক্রিকেট, বিশ্বকাপ ফুটবল, কলকাতার দলগুলোর ডার্বি ম্যাচ ইত্যাদি উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি উন্মাদনা দেখা যায় (অবশ্য ঘরের ডার্বি ম্যাচ অপেক্ষা সুদূরের স্পর্শাতীত আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল দেয়ালচিত্রে বেশি স্থান পায়)। বিশ্বকাপ চলাকালে কলকাতা ও শহরতলির বিস্তীর্ণ অঞ্চল একদা ভরে যেত বিশ্ব ফুটবলের তারকাদের চিত্রে। শারদোৎসবের সময় করা দেয়ালচিত্রণকে প্রচারমাধ্যম শহর সাজানোর উদ্যম হিসেবে দেখে থাকে। এই শহরে ফি বছর দেয়াল অলংকরণের প্রসারের কারণেই সম্ভবত গণনীয়মাত্রায় স্ট্রীট আর্ট উৎসব ও প্রদর্শনী আয়োজিত হয়, যেসব অঞ্চলে দেয়াল অলংকরণের বাহুল্য আছে সেসব অঞ্চলগুলিকে পর্যটন ক্ষেত্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে দর্শকদের আহ্বানসূচক প্রচার করা হয়।

নানা প্রতিবেদন, নিবন্ধ ও মুদ্রিত ভাষ্য এবং বৈদ্যুতীন ও অন্যান্য মাধ্যমে মুদ্রিত চিত্রাবলী থেকে কলকাতার স্ট্রীট আর্টের সঙ্গে যুক্ত স্বনাম ও অপর-নামধারী প্রভূত শিল্পী ও সংগঠক ও আলোচকদের নাম পাওয়া। প্রীতম দত্ত, মৈত্রেয়ী অধিকারী, বাউণ্ডুলে, স্রেক, শ্যাফ, স্যামস্যাম, ঋভু ওয়াংদি, হিরণ মিত্র, সনাতন দিন্দা, রেমজি ও রিপার, জ়াইফার, কে-ক্রু, ঋতম, মুদার পাথেরিয়া, রেমিলে বর্গি, শক, বনি চক্রবর্তী, শুভ কামিল্যা, স্নিকি, স্কাইজ়ার, ডিজ়ি, স্ট্রোকস, ব়্যান্টি, রেমস, ডিজে ভ্যালি, অসীম পাল, আলপনা শিল্পী রত্নাবলী ঘোষ, ইন্দ্রাক্ষী হালদার, গুরুপদ বাছার, সায়ন, সংস্থা হিসেবে ক্যারাভ্যান, রুবি, জেএমএস, সায়ন, মুসু (ট্যাগ থেকে নেওয়া নামগুলির পাঠে ও উল্লেখে  ভ্রান্তি থাকতে পারে) প্রমুখ এই নাম তালিকায় আছেন।

দেখতে গেলে কলকাতায় দেয়াল চিত্রণের সংখ্যা কম নয় এবং সংখ্যার দিক দিয়ে উৎসাহের ধারাবাহিকতারও কোনো অভাব আছে বলে মনে হয় না। কলকাতায় স্ট্রীট আর্টের ধারণা-অনুযায়ী পাশ্চাত্যের মতোই চিত্রকলার সঙ্গে যুক্ত আছেন রাস্তার গায়ক, বাদক, গানের দল বা ব্যান্ড, নাট্যসংস্থা ইত্যাদি। এঁদের সংখ্যাও সুপ্রচুর। একটি ভ্রমণ সংস্থা প্রকাশিত প্রতিবেদনে অন্যান্য মেট্রোপলিসের সঙ্গে কলকাতার গ্রাফিতি ও ম্যুরালের সংখ্যার তুলনা করা হয়েছে :

 

——————————————————————————————-

  শহর                                                      ম্যুরাল সংখ্যা                                                  গ্রাফিতি

কলকাতা                                                     ২০০+                                                         ২০০+

লন্ডন                                                          ১৫০+                                                          ৫০০+

বার্লিন                                                         ৫০০+                                                        ১০০০+

——————————————————————————————-

এই সংখ্যাতত্ত্বকে আদৌ নির্ভরযোগ্য বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। এই সংখ্যাগুরুত্ব সত্ত্বেও কেউ কেউ কলকাতার দেয়ালচিত্রকে যতটা অলংকরণ বলে মনে করেন ততটা প্রকৃত অর্থে গ্রাফিতি বলে মনে করতে কুণ্ঠিত বোধ করেন। কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যত্রও বিবিধ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আঁকা গ্রাফিতি দেখলে বোঝা যায় যে, কলকাতার গ্রাফিতি সম্পর্কে এই মনোভাব হয়তো সর্বত্র ঠিক নয়। প্রতিবাদ-আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেখানে ধারালো, ব্যঙ্গতিক্ত, বিদ্রূপবিদ্ধ, শ্লেষাম্ল গ্রাফিতি আঁকা হয়। কলকাতার পুরোনো বাড়ির দেয়ালে চকিতে দেখা মেলে সুকুমার রায়ের আবোল-তাবোলের চরিত্রগুল্কে (এই চরিত্রগুলি একুশে আইনের দেশের কদাচারী, শূন্যগর্ভ, আত্মকেন্দ্রিক ও অত্যাচারী, কাপুরুষ হামবাগদের প্রতি সর্বকালীন ব্যঙ্গ), এমন কী কলকাতার রাস্তায় ভেসে ওঠে ব্যাঙ্কসি বা টাইলারের মতো গ্রাফিতি-বিষয়। তথাপি গণআন্দোলনের অভিঘাতে কলকাতার রাস্তা, দেয়ালে অত্যাচারিতা মানবীর যন্ত্রণাবিদ্ধতার কন্টকবিদ্ধ শিল্প-অভিব্যক্তি অথবা ফুল হয়ে দিনে দিনে গ্রামগঞ্জের দরিদ্রের ঘর থেকে হারিয়ে যাওয়া বালিকাদের বেদনার প্রতীকী উপস্থাপনা শিল্পগৌরব হয়ে দেয়াল থেকে দ্রষ্টার হৃদয়ে বোধের আলো বিকীর্ণ করে।

গ্রাফিতি শিল্পীদের সচেতন অংশটি মনে করেন যে, মননের সক্রিয়তাই গ্রাফিতির প্রতিবাদী চরিত্র, মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচারের প্রতি ভয়হীন সমর্থন গতিশীলতা, প্রগতি-সচেতনতার প্রাণশক্তি। শিল্পী শানু লাহিড়ীর কন্যা দময়ন্তী এই বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন যে, ব্যাপক অর্থে ভারতের গ্রাফিতি শিল্প ব্যাঙ্কসির রাস্তার শিল্পের অন্তর্নিহিত উদ্ভাবনী বিদ্রোহী চেতনা অর্জনের কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারেনি। এমন-কী মুম্বাই, দিল্লি বা অপরাপর ভারতীয় শহরগুলির তুলনায় কলকাতার গ্রাফিতির দারিদ্র্যেও গতানুশোচনা জানিয়েছেন। মুম্বাই বা দিল্লির তো একজন টাইলার বা ডাকু (সম্প্রতি প্রয়াত) আছেন, কিন্তু কলকাতায় দেয়াললিখনের চাপেই সম্ভবত সাম্প্রতিক গ্রাফিতি তার অন্তর্নিহিত বিদ্রোহী তাৎপর্যে ততটা পৌছতে পারেনি। দময়ন্তী ও প্রতিবেদকের খেদ এই যে, একসময় ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতাই ছিল গ্রাফিতি ও স্ট্রীট আর্টের কেন্দ্রস্থল। (শমিক বাগ : প্রাগুক্ত) কিন্তু বঙ্গের গ্রাফিতি সেই আসন ধরে রাখতে পেরেছে বলে মনে হয় না।

 

গ্রাফিতি বনাম ক্ষমতার প্রকম্পিত প্রাচীর

অনেকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্রাফিতিগুলির মধ্যে রাজনৈতিক উস্কানি ও ব্যঙ্গাত্মক প্ররোচনা লক্ষ্য করছেন। তা তো হতেই পারে, একজন তুলিধারী শিল্পীর তো আগ্নেয়াস্ত্র নেই, পোষা প্রহরী নেই, অত্যাচারের জন্য বাহিনী নেই, জনগণের করের টাকায় বিরুদ্ধ মত দমন করার বহুবিধ পন্থা তাঁদের করায়ত্ত নয়। শিল্পী শুধুমাত্র শিল্প-মাধ্যমেই প্রতিবাদ করতে পারেন। আর সহিংসা, ক্ষমতার দাপাদাপির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যতই শিল্পিত হোক না কেন, তা কটু ও তিক্ত হতে বাধ্য।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রাফিতি হয় কোনো সামাজিক বা রাষ্ট্রনৈতিক আন্দোলনের সূত্রেই তার ডানা বিস্তার করে এসেছে, কিংবা নিজেই কোনো আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছে। শাসকেরা ব্যবসায়িক বা ক্ষমতার স্বার্থে চূড়ান্ত অনৈতিক রচনা, অর্ধসত্য বা মিথ্যাকে, ভুল ধারণাকে প্রশ্রয় দিতে পারে, কিংবা প্রশ্নাতীত অশ্লীলতাকে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আধুনিকতার সঙ্গে বিজড়িত করে ছাড় দিতে পারে কিন্তু গ্রাফিতির মতো ছন্নছাড়া, অকিঞ্চন প্রকাশ্য শিল্পকে সহ্য করতে পারে না। ক্ষমতাকে প্রশ্ন বা ব্যঙ্গ করা, প্রতিবাদের ইঙ্গিতপূর্ণ ধারালো শ্লেষপূর্ণ ছবি ও বয়ান শাসকের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। জনগণের ক্ষোভ, শোক, জীবনযাপনের বা সংসারনির্বাহের বিপন্নতা, অনাচারের ভয়াবহ স্রোতের বিরুদ্ধে গ্রাফিতিতে শক্তিশালী শিল্পে পরিণত হওয়ায় তা দ্রুত দেশের ভৌগোলিক সীমানা এবং বিশ্বমানুষের মানস ভূগোলের চৌহদ্দি পেরিয়ে যায়। শাসকের কোটি ডলারও অধিকাংশ পারিশ্রমিকহীন রাস্তার শিল্পকে দমিয়ে রাখতে পারে না―বিস্তৃত হয় দেশ থেকে দেশে, জাতিনির্বিশেষে মানুষের মধ্যে। শুধুমাত্র ব্ল্যাক লাইভস্্ ম্যাটার আন্দোলনের সময় বর্ণবাদের শিকার জর্জ ফ্লয়েড, ব্রেওনা টেইলর, ট্রেভন মার্টিন, আতাতিয়ানা জেফারসন, সান্ড্রা ব্ল্যান্ড, ফ্রেডি গ্রে, ওয়াল্টার স্কট, মাইকেল ব্রাউন, এরিক গার্নার প্রমুখের সম্মানে নির্মিত ম্যুরাল ও গ্রাফিতিগুলি মিনিয়াপলিস থেকে লন্ডন, টোকিও থেকে ম্যাঞ্চেস্টার, রিও থেকে কেপ টাউনের রাস্তা ও দেয়ালগুলিকে অলংকৃত করেছিল।

গ্রাফিতিকে কোনোকালেই শাসকেরা সহ্য করতে পারেনি। গ্রাফিতির সেন্সরবিহীন বার্তাকে অবৈধ, শাস্তিযোগ্য ও নিষিদ্ধ হিসেবে দেখেছে তারা, নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। এটার শুরু আধুনিক গ্রাফিতির অঙ্কুর উদ্গমের থেকেই। কথিত আছে অস্ট্রিয়ার সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস (১৭৬৮-১৮৩৫॥ অস্ট্রিয়ার সম্রাট হিসেবে রাজত্বকাল : ১৮০৪-১৮৩৫) নাকি জোসেফ কাইসেলারের গ্রাফিতি উৎকীর্ণ করার কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তা সত্ত্বেও কাইসেলারের খোদাই করা নাম সম্রাটের ডেস্কেই দেখা গিয়েছিল!

মনে রাখা দরকার : নিউ ইয়র্কে পাতালরেল সড়কের পাশের দেয়ালে আঁকাআঁকির মাধ্যমে স্ট্রিট আর্টের শুরু হয় আমেরিকায় আমেরিকান শিল্পীদের হাত ধরে। এই আন্দোলন দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, নিউ ইয়র্কে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রাফিতি বিস্ফোরণ ঘটে। ট্রেন, সাবওয়ে, গণপরিবহন ইত্যাদির গায়ে গ্রাফিতি আঁকা হয়। ১৯৮০-র দশক ও তার পরবর্তী সময়ে গ্রাফিতির প্রসার অব্যাহত ১৯৯০-এর দশকে গ্রাফিতি লেখক-শিল্পী এবং ভবনের ও দেয়ালের মালিক শহর-কর্তৃপক্ষের সংঘাত প্রায় ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ পরিণত হয়। মামলা-মোকদ্দমা, শিল্পীদের ধরার জন্য গোপন ক্যামেরা লাগানো, প্রহরার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বহুবিধ পদ্ধতি অবলম্বিত হতে থাকে।

১৯৮০-র দশকে ট্রেন, সাবওয়ে, অন্যান্য মাধ্যমগুলি ভিতরে-বাইরে ছিল তীব্রোজ্জ্বল রঙে ‘সম্পূর্ণরূপে আঁকা একটি ঘূর্ণায়মান শিল্পকর্ম’। ১৯৮৩ সাল নাগাদ নিউ ইয়র্ক শহরের মেট্রোপলিটন ট্রানজিট অথরিটি (এমটিএ) নানাবিধ আক্রমণাত্মক পদ্ধতি গ্রহণ করে। প্রায় ২৫% গাড়িতে গ্রাফিতিবিরোধী সাদা রঙ করে দেওয়া হয়। মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্টেশন অথরিটি বা এমটিএ সাবওয়ে ও অন্যান্য পরিবহন থেকে গ্রাফিতি অপসারণ এবং গ্রাফিতি লেখকদের ট্রেন ইয়ার্ডে প্রবেশ থেকে বিরত রাখার জন্য আরও আক্রমণাত্মক প্রচেষ্টা শুরু করে। ইয়ার্ডে বিশ্রামরত ট্রেনগুলির চারপাশে দ্বিগুণ উঁচু কাঁটাতারের দেয়াল তৈরি করা হয়। সাধারণ প্রহরা ছাড়াও জার্মান শেফার্ড শ্রেণীর শিকারী কুকুরের প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়। বস্তুত সেই সময় ট্রেনসহ শহরের গণপরিবহনে গ্রাফিতি অঙ্কন করে গ্রাফিতি শিল্পীরা এমন ‘একটি গণ পরিবহন ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল যা সম্পূর্ণরূপে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল এবং যা শহরটির ঠিক করার কোনও সম্ভাব্য উপায় ছিল না। অনেক দক্ষ লেখক তাদের সৃজনশীল প্রচেষ্টাকে একটি অবহেলিত, ভগ্নস্বাস্থ্যকর পরিবহন ব্যবস্থাকে সুন্দর করার প্রচেষ্টা হিসাবে দেখেছিলেন যা বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগহীনতা এবং বিলম্বিত রক্ষণাবেক্ষণের শিকার হয়েছিল।’ ‘গ্রাফিতি সাবওয়ে সিস্টেমের ভয়াবহ অবস্থা প্রদর্শন করার চেষ্টা করেছিল, এমন একটি ব্যবস্থা যার উপর নিউ ইয়র্কের বেশিরভাগ মানুষ নির্ভর করে। নিম্ন আয়ের অঞ্চলের ব্যক্তিরা পরিবহনের জন্য বিশেষ করে সাবওয়েতে নির্ভর করতেন। ধারণা করা হয়েছিল যে গ্রাফিতির মাধ্যমে এই সমস্যাগুলি প্রদর্শন’ করা যেতে পারে। কিন্তু কর্তৃপক্ষশ্রেণীর (বিশেষভাবে ব্যবসায়ীদের) কাছে গ্রাফিতি নগরক্ষয়ের সমার্থক হয়ে ওঠে এবং শহরের গ্রাফিতির বিরুদ্ধে অভিযান তীব্রতর করা হয়। তাতেও গ্রাফিতি শিল্পী ও লেখকদের পুরোপুরি দমন করা যায়নি।

একদিকে শিকারী কুকুরের প্রহরা সাবওয়ে ও রেলযাত্রীদের যাতায়াতকে সীমিত করে, অন্যদিকে চলমান সাবওয়ে গাড়ি ছিল গ্রাফিতি শিল্পীদের পছন্দের মাধ্যম। অবশেষে কর্তৃপক্ষ ডেভিড এল. গানকে ট্রানজিট অথরিটির সভাপতি হিসেবে নিয়োগ করেছিল, যিনি পূর্বে বোস্টন, ফিলাডেলফিয়া, ডিসি এবং টরন্টোতে ট্রেন পরিষ্কার করেছিলেন। নিউ ইয়র্ক সিটি সাবওয়ে পরিষ্কারের এই  অভিযানকে ‘সুইসাইড মিশন’  বলে অভিহিত করা হয়েছিল।

(ক্রমশ)

……………………………………

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply