অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ২৬। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

আট : দেয়ালে দেয়ালে হয়ে ওঠা কবিতার অগ্নিশিখা : মুছে যায় দেয়ালের সীমারেখা

সুকান্ত ছড়াচ্ছলে লিখেছিলেন : ‘দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে / লিখি কথা। / আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার / স্বাধীনতা॥’ ( দেয়ালিকা : এক, পূর্বাভাস) দেয়ালে ‘মনের খেয়াল’-এর কথা মুদ্রণের সভ্যতার উষাকালীন ইচ্ছার ক্রমান্বয়ী বিমূর্ত উন্মোচনে অন্য এক শিল্পাঞ্চল আলোকিত হয়।

মুর্তজা বশীর দেয়ালকে তাঁর শিল্পের বিষয়গত উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ‘দেয়াল’ সিরিজে ‘৯১ বা ৯২’ টি চিত্র সৃজন করেছিলেন। এই সিরিজেই ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’-র তাত্ত্বিক দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেয়াল তো তাঁর কাছে নিছক দেয়াল নয়―‘সংকটাপন্ন হৃদয়ের সরণি।’

এই সরণিতেই বিশ্বজুড়ে ফুটে ওঠে সংক্ষুব্ধ, বেদনাহত, প্রহত কবিতার অগ্নিশিখা।

সে তো নিছক দেয়াললিখন নয়, হরফের বিন্যাসে যাচনা নয়―উজ্জীবনের বার্তালিপি―গ্রাফিতি―দেয়ালের শিল্প―প্রকাশ্য অথচ কৌশলী ঘোযণার সাহস―রাস্তার প্রকীর্ণ শিল্পকথা!

গ্রাফিতি হলো দেয়ালের গায়ে সরাসরি কিংবা কাগজ বা অন্য কিছুর মধ্যস্থতায় জনসাধারণের অভিমত ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, ছবি ও বয়ানের উপস্থিতি।

ইতালীয় শব্দ ‘গ্রাফাটিয়াটো’ থেকে এসেছে গ্রাফিতি―যার অর্থ খচিত। ইউরোপ আমেরিকার বহু জনপদের দেওয়ালগুলি গ্রাফিতিতে নক্ষত্রখচিত আকাশেরই মতো। এমন-কী ইতালির ফাঁকা প্রান্তরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা রেলওয়ে কালভার্টের দেয়ালও গ্রাফিতিতে সমাকীর্ণ।

গ্রাফিতির বিষয়গত ব্যঞ্জনাময় সম্পৃক্তি এবং আকরণগত বৈচিত্র্য লক্ষ্য করলেই সাধারণ ওয়ালিংয়ের সঙ্গে এর বর্ণনাতীত পার্থক্য বোঝা যায়।

প্রাচীন ও মধ্যযুগে প্রস্তর কিংবা প্রাকার গাত্রে আত্মঘোষণার বাসনাজনিত রেখাঙ্কনসমূহকে বাদ দিলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই সচেতন গ্রাফিতি সৃজনের শুরু বলে মনে করা যায়। পূর্বোক্ত গ্রীক হরফ ওমেগার ঢঙে পরিকল্পিত ‘কিলরয় এখানে ছিলেন’ বহুল ও সর্বত্র উৎকীর্ণ করা হলেও তাকে ঈষৎ নির্দেশক ও নিষেধাজ্ঞার মতো ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রাফিতি বলতে যে ভাবব্যঞ্জক প্রাবল্য বোঝায় তার শুরু ঐ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ে ঘটে চলা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আন্দোলন, অস্থিরতাজনিত সংক্ষোভের কালে। এবং গ্রাফিতির বিশ্বব্যাপী বিস্তার ১৯৬০-এর দশক থেকে দেয়াল-শিল্পে এক অন্যতর অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

গ্রাফিতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেয়াল-মালিকের বিনা অনুমতিতে, মালিকের অগোচরে লেখক-শিল্পী বা লিখনপক্ষের পরিচয় গোপন রেখে অঙ্কিত হয়। গ্রাফিতির উপস্থাপনা, বক্তব্য এবং প্রকাশ বিষয়ে প্রায় সবক্ষেত্রেই এক গোপন কার্যক্রমের ব্যঞ্জনা আছে।

গ্রাফিতিকে ‘কাউন্টারকালচার’ বা প্রতিসংস্কৃতি হিসেবে (কখনও কখনও ‘সাবকালচার’ বা উপসংস্কৃতি হিসেবেও) দেখা হয়। অর্থাৎ যা গতানুগতিক, প্রতিষ্ঠিত এবং কর্তৃত্ব-গ্রাসী সামাজিক ভাবধারা বা সংস্কৃতির কবল থেকে মুক্তকামী ও বিপরীতগামী।

কাউন্টারকালচারকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ধারা বা দৃষ্টিভঙ্গির সম্মুখীন হতে হয়। সমাজবিজ্ঞানগত অকাদেমিক বিবেচনায়―‘পাল্টা সংস্কৃতি’ শব্দটি এমন একটি সামাজিক আন্দোলনকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয় যা একটি নির্দিষ্ট সমাজ বা সংস্কৃতির প্রভাবশালী মূল্যবোধ, রীতিনীতি এবং বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে। এটি এমন একটি আন্দোলন যা পরিধি থেকে উদ্ভূত হয়, প্রায়শই বিদ্যমান সংস্কৃতির অনুভূত অসুস্থতা বা অবিচারের প্রতিক্রিয়ায়। পাল্টা সংস্কৃতি আন্দোলনগুলি তাদের উগ্র বা অপ্রচলিত প্রকৃতি দ্বারা চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের লক্ষ্য হল জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা এবং অস্তিত্বের একটি নতুন, বিকল্প উপায় তৈরি করা।’ (ক্যালিফোর্নিয়া লার্নিং রিসোর্স নেটওয়ার্ক)

বহুক্ষেত্রে তাই প্রতিষ্ঠিত বা প্রচলিত সংস্কৃতির নানা অভিব্যক্তিক (সংগীত, নৃত্য, সাহিত্য, চিত্রশিল্প, প্রদর্শনশিল্প, বিভিন্ন স্তরের শিল্পচর্চাকারীদের যাপনশৈলী ইত্যাদি) অঙ্গগুলির ভাব ও আঙ্গিকগত পরিবর্তনের উদাহরণ দিয়ে কাউন্টার কালচারকে বুঝতে চাওয়া হয়। কিন্তু একথা বলাই বাহুল্য যে শুধুমাত্র এই ধরনের বিপরীতগামিতার মধ্য দিয়েই প্রচলিত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠার বিকল্প বা  বিপরীত ভাবধারার অর্জন বা কাউন্টারকালচারের অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করা যায় না। তার নাগাল পেতে গেলে সব ধরনের সমাজে চলতে থাকা সংস্কৃতির দ্বান্দ্বিকসূত্রটিকে আবিষ্কার করাতে হয়। বস্তুবাদী দৃষ্টিতে : ‘কাউন্টার কালচার, এ ফর্ম অব স্পিরিচ্যুয়াল প্রটেস্ট এগেনস্ট বুর্জায়া কালচার বাই ইয়ং পিপ্্ল ইন দি ওয়েস্ট ইন ১৯৬০স্ অ্যান্ড ১৯৭০স্। ইট সিগনিফায়েস আউটরাইট রিজেকশন অব দি সোসাল ভ্যালুজ, মরাল নর্মস্ অ্যান্ড দি আইডিয়ালস অব কমজিউমার সোসাইটি, অব দি স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড স্টিরিওটাইপস অব মাস কালচার, দি ওয়ে অব লাইফ বেসড অন দি  ডেজায়ার ফর রেসপন্সিবিলিটি, সোসাল প্রেস্টিজ অ্যান্ড মেটিরিয়াল ওয়েল-বিইং।’ ( ফ্রোলভ : ১৯৬৭ /১৯৮৪) ‘আধুনিক বুর্জোয়া সমাজে আধ্যাত্মিক পরিবেশের বিপরীতে একটি সংস্কৃতি তৈরির প্রচেষ্টা হিসেবে প্রতি-সংস্কৃতিকে বিবেচনা করা যেতে পারে।’ এই আন্দোলনের প্রতিটি  পর্যায়ে একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার, রাজনীতি সচেতনতার, পররাজ্য গ্রাসের হিংস্রতার বিরুদ্ধতার, তথাকথিত মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার অধিকার হরণ করে শৃঙ্খলার নামে প্রতিপদে শৃঙ্খল রচনার বিরুদ্ধে এবং সামাজিক জড়ত্বের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহের একটা রোমান্টিক সুর ছিল।

ভবঘুরেপনা, মুক্ত জীবনের জন্য জীবনযাপনের প্রচলিত রীতিগুলিকে প্রত্যাখ্যান, রক-পপ-হপের উচ্চকিত কলরোল ইত্যাকার সব কিছুর মধ্যেও এই আন্দোলনের সর্বোত্তম অভিব্যক্তি ঘটেছিল সম্ভবত দেয়াল বিপ্লবের মতো গ্রাফিতির বিকাশ ও বিস্ফোরণে। এই সময়ে দেশে দেশে ঘটে যাওয়া গণতন্ত্রবাদী কিংবা প্রতিবাদী আন্দোলনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সহযোগী ছিল গ্রাফিতির জ্বালাময় দ্যুতি। গ্রাফিতি বাঁধনছেঁড়ার আন্দোলনের সহযোগী হলেও তা অযথা কোলাহল থেকে নিজের শিল্পস্বাতন্ত্র্য রক্ষাই শুধু করেনি, ক্ষেত্রবিশেষে সাধারণজনের ক্ষোভকে সঠিক পথের দিশা দেখাতেও চেয়েছে।

গ্রাফিতির বয়ান, বিবৃতি বা বক্তব্য কিংবা শৈলী প্রচলিত ধারণা-নিঃসৃত সুভাষিতবলী এবং সিদ্ধান্তের বিপরীত প্রতিক্রয়া তৈরি করে। গ্রাফিতির উপাদন মুখ্যত অসহনীয় অবক্ষয়-অসঙ্গতি-রাজনৈতিক অরাজক স্বেচ্ছাচারের বিরোধিতা এবং তা থেকে ‘অনার্ত উত্তরণ’-এর আকাঙ্ক্ষা। ফলত গ্রাফিতি ক্ষমতাকে, প্রচলিত ব্যবস্থা বা তন্ত্রকে প্রশ্ন করে, তার বিরোধিতা করে, তাকে ব্যঙ্গ করে, ক্ষমতা ও ক্ষমতাবানের সীমাহীন উৎপীড়নের অধিকারকে অস্বীকার করে, তাচ্ছিল্য করে। গ্রাফিতি ইশারায়, ইঙ্গিতে, মেধার সুতীক্ষ্ম ফলায় বিদ্ধ করে সমাজের ক্রমক্ষীয়মান বুদ্ধবৃত্তিহীন সারমেয়-স্বভাবকে, রাষ্ট্রীয়―রাজনৈতিক বা ধর্মীয় আড়কাঠিদের সামাজিক মুরুব্বিয়ানাকে! উন্মুক্ত দেয়ালের গ্রাফিতিক ক্যানভাসে ফুটে ওঠা যে-কোনো গ্রাফিতির অন্দরে এক বা একাধিক রহস্যময় ঘূর্ণাবেগ আছে, যার আঘাতে দ্রষ্টার নিজস্ব স্থবির অবস্থান প্রকম্পিত হয়―ভূকম্প পরবর্তী কম্পন সমাজের অনেকটা এলাকা জুড়ে চলতে থাকে।

ছয়ের দশকে ভিয়েৎনাম যুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী মুখটিকে এই দেয়ালশিল্প বেআব্রু করে দিয়েছিল। সেই সঙ্গে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও শান্তির সপক্ষে বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করেছিল। ভিয়েৎনামের দেয়ালগুলি তখন গ্রাফিতির জোয়ারে প্রস্ফুটিত জীবন্ত ক্যানভাসে পরিণত হয়েছিল। শুধু দেয়াল নয় শিরস্ত্রাণ, হেলেমেট বা টুপিতে করা গ্রাফিতি, লেখা ‘ওয়ার ইজ হেল’ (যুদ্ধ হলো জাহান্নাম) কিংবা ‘পিস অর পিস’ (শান্তি অথবা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন) ইত্যাদি।

এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপ-লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে লিপিতে-চিত্রে-রঙে-ধূসরতায় ভিয়েৎনামের প্রতি সমর্থন ও সহমর্মিতার যে বাতাবরণ সৃষ্টি হয় তার দ্বিতীয় উদাহরণ খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বামপন্থী ও মানবতাকামী দেয়াল শিল্পীরা তুলিতে ও স্টেনসিল ছাপাইয়ে ভিয়েতনামে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন প্রচেষ্টা, ক্ষীণতনু ও বজ্রকঠিন হো চি মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের জনগণের প্রতিরোধ এবং বিশ্বজনমতের তীব্র সংঘাতের ইতিবৃত্তে আমাদের দেয়ালগুলিও ভরিয়ে দিয়েছিলেন।

ভিয়েতনামে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সেই বিশ্বব্যাপী একাত্মতার দৃঢ়তাকে পুঁজিবাদী দুনিয়া, তাদের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ উচ্ছিষ্টভোগী প্রচারমাধ্যম আর বিভ্রান্ত জনপিণ্ডের একাংশ আজও বিস্মৃত হতে পারেনি ;  প্রায় সাত দশক পরে এখনও তাদের ভিয়েতনাম-গ্রাফিতির প্রত্যাঘাতের জ্বালাজনিত ইতরতার উপশম হয়নি।গ্রাফিতি শিল্পীরা শিল্পাতিক্রমী সামাজিক ও রাজনৈতিক শিল্পযুদ্ধের নক্ষত্র-যোদ্ধা। ঠিক যেমনটি দেখা গিয়েছিল ফ্রান্সে বিগত শতকের আটষট্টির ছাত্রবিপ্লব বা পরবর্তী সময়ের দেশে দেশে সংঘটিত প্রতিবাদী আন্দোলনসমূহে। এই উনিশ শো ষাটের দশককেই ম্যাকেঞ্জি ওয়ার্ক (জন্ম : ১৯৬১) সবচেয়ে বহুমুখী যুগ বলে বর্ণনা করেছেন। [‘দেয়ার ইজ এ সিক্সটিজ টু স্যুট এভরি টেস্ট। ইটস্্ এ ট্রুুলি ভার্সেটাইল এরা।’―(দি বিচ বিনিথ দি স্ট্রীট : ২০১১)] এই দশক স্মরণীয় অনেক ঘটনাতেই আন্দোলিত হয়েছিল। এর মধ্যেও সমাজ-রাজনীতি-রাষ্ট্রের ভূমিকা, শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতি ইত্যাদি সব দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ১৯৬৮-তে ফ্রান্সের ছাত্র আন্দোলন। এই আন্দোলনে গ্রাফিতির ভূমিকাকে অনুধাবন করতে হলে এই আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় গ্রহণ করা প্রয়োজন।

 

(ক্রমশ)

…………………………..

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply