অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ২৪। অনন্ত জানা
সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২) নিজের ছবির পোস্টার বিষয়ে বরাবরই সতর্ক থেকেছেন এবং নিজেই নিজের সিনেমার পোস্টার তৈরি করেছেন। তাঁর সুবিধা ছিল এই যে, তিনি নিজে ছিলেন একজন সুদক্ষ শিল্পী ও গ্রাফিক ডিজাইনের সিদ্ধপুরুষ। পথের পাঁচালী (১৯৫৫), চারুলতা (১৯৬৪), দেবী (১৯৬০), মহানগর (১৯৬৩), মহাপুরুষ (১৯৬৫), গণশত্রু (১৯৯০), নায়ক (১৯৬৬), প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৬৯), সোনার কেল্লা (১৯৭৪), ঘরে-বাইরে (১৯৮৪) ইত্যাদি। অন্যান্য ছবির পোস্টারগুলিও কম উল্লেখযোগ্য নয়। সত্যজিতের করা পোস্টারগুলিকে আমরা তাঁর তৈরি সিনেমা দেখার ভূমিকা বলতে পারি। পোস্টারে ব্যবহৃত ছবি (আঁকা বা ফটোগ্রাফ) আর নামাঙ্কনের হরফ বা ক্যালিগ্রাফি―সবই একে অপরের অনুগামী―অভিন্ন ডিসকোর্সের অংশী। কিন্তু সুমন বরাবরই লক্ষ্য করেছেন―পোস্টার নিভৃতির শিল্প নয়। পোস্টারে কোনোমতেই উপযোগিতার প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারিগরের পক্ষে তো নয়ই, পেশাদার পোস্টার আঁকিয়ের পক্ষেও নয়, সেটা একান্তভাবে বাণিজ্যিক―এমন-কী আর্ট ন্যুভো আন্দোলনে আলোকিত আলফোনেস মুচার পক্ষেও নয়!

কিন্তু নতুন সময়ের সিনেমার পোস্টারের রসনিষ্পন্নতার লক্ষ্যটি একটু ভিন্নতর। এই জাতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে লক্ষিত-দর্শক (টার্গেট অডিয়েন্স) বদলে যাওয়ায় পোস্টারের আবেদনও বদলে গিয়েছে। যেমন : পথের পাঁচালীর মূল পোস্টারে ডিজাইনার সত্যজিৎ রায় বাধ্যবাধকতাহেতু প্রযোজক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নাম, পরিবেশক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের নাম এবং শুধুমাত্র লেখক বিভূতিভূষণের নাম, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক হিসেবে নিজের নাম এবং সংগীত পরিচালক হিসেবে রবিশঙ্করের নামোল্লেখ করেছিলেন। অথচ পোস্টারটিতে অপু-দুর্গা-সর্বজয়ার ফটোগ্রাফজাত ছবি ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এমনটা ভাবা যেতেই পারে যে, কোনো নামজাদা পেশাদার শিল্পী না-থাকায় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম দেওয়া হয়নি, চরিত্রাভিনেতাদের কোনোরকম বাজারপরিচিতিও ছিল না। কিন্তু এই ছবিতে কানু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৫-১৯৮৩) ও তুলসী চক্রবর্তী (১৮৯৯-১৯৬১)-র মতো সে-সময়ের কুশলী মঞ্চ ও চলচ্চিত্র অভিনেতা ছিলেন। পথের পাঁচালী তৈরি হওয়ার আগেই প্রথমজন প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশটি এবং দ্বিতীয় জন খান-ত্রিশেক ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছিলেন।
কিন্তু প্রশ্ন এই যে, পোস্টারটিতে কেন আল্পনাকাঠামোর অনুসরণে লক্ষ্মীর পা-এর ছাপ এবং দুটি মাছের অলংকরণ ব্যবহৃত হলো? এ-নিয়ে সুমনের ধন্দ আছে যথেষ্টই।

স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের আঁকা বলেই ধন্দ কাটতে চায় না।
পথের পাঁচালী উপন্যাস ও চলচিত্রায়নে কোথাও এমন শান্তি ও সমৃদ্ধির কোনো অবকাশ বা তজ্জনিত এমন অলংকরণের কোনো সুযোগ ছিল বলে মনে হয় না। সংসারযাত্রা নির্বাহে হরিহরের বিপন্নতা, ইন্দির ঠাকুরণের মৃত্যু, দুর্গার নিষ্ক্রমণ, ভিটে-মাটি হতে উচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনা এই গ্রামীণ পরিবারের পরাজয়ের বৃত্তটিকে সম্পূর্ণতা দিয়েছে। হরিহরের পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় এবং শূন্য ও পরিত্যক্ত ভিটেয় সরীসৃপের প্রবেশ ঘটার মতো একটি অসম্ভব চিত্ররূপক সৃজন করেন সত্যজিৎ, সেখানে স্বপ্নভুবনের দিগন্তেও ছিল না ছায়া সুনিবিড় কোনো গ্রামের শান্তির কোনো নীড়ে সমৃদ্ধির বালার্ক দেখা দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত! ক্ষুধার উদ্্যাপন ছাড়া এখানে কোনো জ্যোৎস্নাপ্লাবিত নিকানো কোজাগর নেই―তবে এখানে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন কেন? কেনই-বা অলংকৃত মৎস্যের উপস্থিতি?
আরেকটু বিস্তৃত প্রেক্ষিতে দেখতে গেলে ভারতীয় তথা সামগ্রিকভাবে মানব সংস্কৃতিতে মৎস্যের বহুকৌণিক বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করা হয়। জল উপাদানের সঙ্গে মাছের প্রাণধারণের সম্বন্ধ মানবজীবনকেই বিম্বিত করে। জল― জীবন, শুদ্ধিকরণ, পরিচ্ছন্নতা, গভীরতা, অবচেতনা, আবেগ, নিরাময় ইত্যাদির স্বীকৃত প্রতীক। সেই সঙ্গে জলজীবী মৎস্যকে মেধাবী-বিবেচনাবোধ, প্রজ্ঞা, সৃজনশীলতা, চিরন্তনতার প্রতীক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। জলজীবী প্রাণী হিসেবে মাছ―অবিরল আন্দোলন, চাঞ্চল্য, অনুভূতি, সচেতনতা, বুদ্ধমত্তা ইত্যাদিরও প্রতীক। জলজীবনের কারণে মাছসহ জলজ প্রাণবিশ্ব উর্বরতা, মুক্তি, জন্ম ও পুনর্জন্মের ধারণাকে দ্যোতিত করে। প্রতীকীকতার নিরিখে মাছ এবং জলের সম্বন্ধ পবিত্র নারীত্ব, মাতৃত্ব আর নিজগতভাবে সন্তান-নিরপেক্ষ নির্লিপ্তির মহিমা লাভ করেছে। টোটেম-ধারণায় মাছের প্রতীকায়িত অনুষঙ্গগুলি ‘অভিযোজিত এবং স্বজ্ঞাত ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব করে’―যাঁরা সকল প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করতে প্রয়াসী। (গার্থ সি. ক্লিফোর্ড : ২০২১) মনে হয় না―নিছক লোকচিত্রকলার অলংকরণের জন্য পোস্টারে এই মোটিফগুলি যুক্ত হয়েছে! এটা হতে পারে যে, ক্ষুদ্র গ্রামীণ জীবন থেকে অপুর বৃহত্তর পৃথিবীর পথে যাত্রাজনিত মুক্তির উদ্্যাপনের ইশারা স্বরূপ লক্ষ্মীর পদচিহ্ন এবং মাছের উপস্থিতির সম্ভাব্যতাকে চিহ্নিত করেছেন সত্যজিৎ। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে―পথের পাঁচালীর এই পোস্টারে লোকচিত্রকলার ঢঙে একটি হাস্যপ্রভা-বিকীর্ণ সূর্যের স্কেচও আছে। যদিও এই ছবিতে অপু আর দুর্গার রেলগাড়ি দেখার কৌতূহলোদ্দীপ্ত উজ্জীবনের পরেই ইন্দির ঠাকুরুণের নিষ্ক্রমণ, হরিহর ঘরে ফিরবার আগেই দুর্গার বিসর্জন এবং অপুদের গ্রামত্যাগের ফলে পথের পাঁচালী ছবিতে পুঞ্জীভূত হয়ে থাকা নিষ্পন্নতাকালের বিষাদ কিছুতেই কাটতে চায় না। তবু হয়তো কোথাও এমন একটা অন্তর্বার্তা থেকে যায় যে, জীবন এক অনিঃশেষ সম্পদ―বিচ্ছেদ সত্ত্বেও নতুনের সংযোজিত অভিভাবন আর স্বাতন্ত্র্যের দিকনির্দেশনার রসায়ন যতক্ষণ জীবনে আছে―ততক্ষণ জীবনপ্রবাহ চলতেই থাকে।
পথের পাঁচালীর বছর-তিনেক পরে সত্যজিৎ নির্মাণ করেছিলেন পরশ পাথর (১৯৫৮) ছবিটি। সেখানে তুলসী চক্রবর্তীকে যথাযথভাবে ছবিটির মুখ্য চরিত্রে নির্বাচন করা হয়েছিল। পরশ পাথর ছবির যে পোস্টারটি সাধারণভাবে দেখা যায়, সেখানে পোস্টার জুড়ে মুখ্য ভূমিকাভিনেতার ছবি ব্যবহার করা হলেও কোথাও তাঁর নাম নেই। এটা ঠিক যে, এইসব সিনেমাগুলি তারকানির্ভর নয়। দেবী চলচ্চিত্রের পোস্টারে শর্মিলা ঠাকুরের ছবি থাকলেও, নাম নেই। শর্মিলা তখনও স্টার হয়ে ওঠেননি (তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি ছিল সত্যজিৎ পরিচালিত অপুর সংসার)। কিন্তু মহাপুরুষ ছবিটি স্টারনির্ভর না-হওয়া সত্ত্বেও পোস্টারে প্রায় সকল অভিনেতা-অভিনেত্রীর নামোল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে চারুলতা ছবির মূল পোস্টারে মুখ্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সকলের নামোল্লেখ করা হয়েছে একেবারে কাহিনী-ক্রম মেনে―প্রথমে নাম-ভূমিকাভনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়, তারপর যথাক্রমে শৈলেন মুখার্জী এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম।

এই ধরনের বিচিত্র পোস্টারীয় ঘটনা আছে। যেমন : তপন সিংহ পরিচালিত সফল ছবি ‘কাবুলিওয়ালা’-র প্রাইম পোস্টারে কাবুলিওয়ালার ভূমিকাভিনেতা ছবি বিশ্বাসের নাম নেই। কিন্তু ছবি বিশ্বাস তখন দর্শকাকর্ষণে সক্ষম ছিলেন। পোস্টারে গুরুত্ব পেয়েছেন সংগীত পরিচালক রবিশঙ্কর। অন্যদিকে সত্যজিতের ‘জলসাঘর’ ছবির পোস্টারে ছবি বিশ্বাসের নাম যতটা গুরুত্ব পেয়েছে তার থেকে সংগীত পরিচালক বিলায়েৎ খাঁ-র সঙ্গে সুরারোপে সালামৎ খাঁ, আখতারি বাঈ ( ফৈজাবাদী), বিসমিল্লা খাঁ, রোশন কুমারী, ওয়াহেদ খাঁ-র নামোল্লখ দেখলেই এই ছবিতে পরিচালকের ফোকাল পয়েন্টটি বোঝা যায়। পূর্বোল্লেখিত নিজের ছবির পোস্টারে চ্যাপলিনের ছবি বা সিনেমার নামের তুলনায় চ্যাপলিনের নামে চারগুণ ফন্ট ব্যবহারের কারণও প্রায় সমধর্মী। সমস্ত বিশ্বজুড়ে সিনেমা পোস্টারে এমন অনেক আপাত ধন্দ এবং মীমাংসিত অপপ্রত্যয়ের সন্ধান মেলে। সুতরাং উদাহরণ বৃদ্ধি না-করাই সঙ্গত।
(ক্রমশ)
…………………………..
(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)
