অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ২০। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

চার : বঙ্গীয় পোস্টারকথা

প্রাথমিকভাবে পোস্টারের বিবিধ উপযোগিতামূলক ব্যবহার আমাদের এখানেও লক্ষ্য করা যায়। বাংলা পোস্টারের ইতিবৃত্তকে অনুসন্ধান করতে হলে প্রথমে কিছুদূর পর্যন্ত মুদ্রণশিল্পের মতিগতির অনুসরণ করতে হবে।

কলকাতার মুদ্রণ শিল্পে লিথোগ্রাফ যুক্ত হওয়ার পর হাতে লেখা পোস্টারের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হয়। উনিশ শতকে বহুবিধ পরিবর্তনের ধারাতে মুদ্রণশিল্পে দ্রুত পরিবর্তনের অঙ্গরূপেই কাঠখোদাই ও লিথোগ্রাফিক ছাপাই পদ্ধতি ব্যাপকভাবে গৃহীত হতে থাকে। একেবারে বৌদ্ধযুগে পুঁথিতে অঙ্কিত ছবি এবং বাংলা পঁুথির কাঠের পাটায় প্রচ্ছদ অলংকরণের ম্যানুয়াল পদ্ধতির সঙ্গে পুনরুৎপাদনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। বস্তুত লিথোগ্রাফের নাগাল পাওয়ার আগে বাংলায় ‘ধাতুপত্রে লাইন এনগ্রেভিং’ এবং কাঠখোদাই-ই ছিল কোনো শিল্পকর্ম একটু বেশি সংখ্যায় পুনরুৎপাদনের জনপ্রিয় ও সহজলভ্য উপায়। বটতলার সচিত্র গ্রন্থ ছাপার সূচনাতে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য প্রকাশিত অন্নদামঙ্গলের (১৮১৬) সংস্করণের ছবিগুলিও হাতে করে এই ধাতুপাত এনগ্রেভিং এবং দারুতক্ষণের দ্বারা ব্লক তৈরি করে ছাপা হয়েছিল। উনিশ শতকে বিলাত থেকে ধাতু ব্লকের আমদানি শুরু হয়ে গেলেও বটতলার ও সমসাময়িককালে ছাপা বাংলা বইয়ের ছবির অধিকাংশই ছাপা হতো কাঠের ব্লকে, পৌরাণিক বিষয় হলে পটুয়া রীতিতে, ধাতু-খোদাই ছবিও ছিল যথেষ্ট সংখ্যায়। পরবর্তীকালে বটতলায় কয়েকজন পেশাদার খোদাইকর ছিলেন বলে মনে হয়।

 

বটতলায় লিথো ছবি আসতে বেশ দেরি হয়েছিল। (সুকুমার সেন : ১৯৮৪) কিন্তু শিল্পী ও মুদ্রকদের   কাছে লিথোগ্রাফি যথেষ্ট প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হচ্ছিল এবং কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্ট (স্থাপনা : ১৮৫৪)  লিথোগ্রাফি শিক্ষা ও চর্চার একটা পরিসর ছিল।

১৮৭৮ সালে স্থাপিত কলকাতা আর্ট স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী অন্নদাপ্রসাদ বাগচী (১৮৪৯-১৯০৫) কৈশোরে কাঠখোদাইয়ের কাজ দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টে যোগ দেবার পর কাঠখোদাই, ধাতুতক্ষণ ও লিথোগ্রাফির কাজ শিখেছিলেন, গ্রাফিক আর্টের চর্চা করেছিলেন। অন্নদাপ্রসাদ তাঁর আর্ট স্কুলের ছাত্র চার ছাত্র নবকুমার বিশ্বাস, ফণীভূষণ সেন, কৃষ্ণচন্দ্র পাল এবং যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে স্টুিডওটি স্থাপন করেন। (কলকাতার নকশি-কথা : ২০২৩)

১৮৭৯ সালে অন্নদাপ্রসাদ আর্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তখন বাকি উল্লিখিত ছাত্ররাই আর্ট স্টুডিওর মালিক হন। আরও পরে নবকুমার বিশ্বাস একাই সমস্ত শেয়ার কিনে নেন। এই স্টুডিও নিখুঁত ও ব্যয়বহুল লিথোগ্রাফের চর্চায় একটি বড়ো স্থান দাবি করতে পারে।

সস্তার বাংলা পোস্টার কাঠের ব্লক কিংবা সস্তার লিথোগ্রাফেই ছাপা হতো। যেমন : সাদামাটা অনুষ্ঠানের পোস্টার, ভোটের সংখ্যাতীত পোস্টার, মফস্বলের প্রতি সপ্তাহে দেয়ালে দেয়ালে লটকানোর জন্য একরঙা বা দু-রঙা ছবিবিহীন হরফসর্বস্ব সিনেমার পোস্টার, সস্তার বড়ো বা ছোটোমাপের বিজ্ঞাপনী পোস্টার, গ্রামগঞ্জে যাত্রাপালার পোস্টার ইত্যাদি। বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রদর্শনের জন্য সিনেমা, যাত্রা, সার্কাস, ম্যাজিক শো-র জন্য রঙিন পোস্টার ছবি বা নকশাদার পোস্টারও প্রস্তুত করা হতো―সাধারণভাবে লিথোগ্রাফে বা ধাতুব্লকের সহায়তায়।

অফসেট প্রিন্টিং পোস্টার আসার আগে পর্যন্ত এভাবেই চলে এসেছে। ইউরোপের যেমন লিথোগ্রাফিক পোস্টার আয়ত্তের মধ্যে আসার পর সার্কাসের দল ও নাট্যশালাগুলির কাছে এর চাহিদা তুঙ্গে পৌঁছেছিল, আমাদের দেশেও সিনেমা, পেশাদার থিয়েটার, যাত্রাপালা, সার্কাস, মেলা-খেলার পোস্টারে এই পদ্ধতির ব্যাপক প্রয়োগ ঘটানো হয়েছিল।

বাংলা পোস্টারের আরেকটি বড়ো ভাণ্ডার অবশ্যই প্রার্থীর নাম ও প্রতীক চিহ্ন দিয়ে হাজারে হাজারে ছাপানো বিভিন্ন স্তরের ভোটের পোস্টার।

এই সূত্রেই এসে পড়ে বাংলার রাজনৈতিক পোস্টারের কথা।

রাজনৈতিক কর্মীরা তাঁদের দৈনন্দিন দাবিসম্বলিত বা কর্মসূচি ঘোষণার পোস্টার সাধারণভাবে কাগজের ওপর হাতে লিখে তৈরি করতেন। বামপন্থীদের সংগ্রহে অমন পোস্টার লিখিয়ে, রাস্তার শিল্পী শিবেন-যতীশ বা আলংকারিক ক্ষেত্রে সুমনরা সর্বত্রই ছিলেন। পোস্টার লেখায় বাজেট ছিল কম, উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা ছিল বেশি উপকরণের বাহুল্যে উদ্যোগে তখনও আলস্য-বিষ প্রবেশ করেনি।

পোস্টার লিখিয়ে কর্মীদের হাতেখড়ি হতো পুরোনো খবরের কাগজের ওপর লিখে। সাধারণভাবে রবিন ব্লু, কালো আর লাল রঙ এসব পোস্টারে ব্যবহার করা হতো. কিন্তু রঙের অভােব একরঙে, তেমন তেমন পরিস্থিতিতে তাড়াহুড়ো করে রাতারাতি পোস্টার লিখে ফেলতে হতে। তাতে নিশ্চতভাবেই পারিপাট্যের বিলক্ষণ অভাব ঘটতো, কিন্তু বোঝাপড়াটা এই ছিল যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মোটামুটি পাঠ করা যায় এমন পোস্টার লিখে দেয়ালস্থ করতে পারলেই  হলো অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে, শিল্প নয়, উপযোগিতা দিকটিই ছিল একমাত্র বিবেচ্য। যদি সঠিকভাবে বিবেচনা করা যায় তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, পুরোনো খবরের কাগজে লেখা দীন-হীনভাবে খারাপ হস্তাক্ষরে লেখা পোস্টারের একটা আলাদা জোর ছিল। দারিদ্র্যপীড়িত মহত্ত্বের, বিপ্লবীয়ানার একটা গোপন বার্তা বহন করতো খবরের কাগজের ওপরে লেখা পোস্টারগুলো! সবসময় দল বা সংগঠনগুলি সাদা কাগজের খরচা সত্যি সত্যিই জোগাতেও পারতেন না। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পোস্টারই হোক বা দেয়াল লেখা―সর্বত্র কালো বা রক্ত-লাল (দিশি আলতা দিয়ে) রঙ একটা সময় একশ্রেণীর লিখিয়ের কাছে ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছিল।                 ‘

সুমনের মনে আছে, বর্ধমান থেকে বাবা কলকাতায় বদলি হবার পর উত্তর কলকাতার পুরোনো গলির ভাড়া বাড়ির পাড়ায় খবরের কাগজে লেখা পোস্টারই বেশি দেখতেন। পাড়ারই নাড়ুদা আর নিমুদা  মাঝে মাঝেই নাড়ুদাদের বাড়ির সামনের প্রশস্ত চাতালে বসে পুরোনো খবরের কাগজের ওপর গোছা গোছা পোস্টার লিখে চলত। তুলি জুটতো না, কাঠির ডগায় জ্যেঠিমার পুরোনো শাড়ির নরম ন্যাকড়া জড়িয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে সরু মোটা তুলি তৈরি করে তাই দিয়ে ঝড়ের গতিতে পোস্টার লেখা চলতে থাকে।

প্রথম থেকেই হাফ প্যান্টের সুমন চাতালের সামনে দাঁড়িয়ে বহু সময় কাজ দেখতো। শেষ পর্যন্ত নাড়ুদাদের প্রশ্রয়ে দুটো-চারটে কাগজ আর কয়েক তুলি রঙের শ্রাদ্ধ করে দিন-কয়েকের মধ্যেই সুমন শিখি নিয়েছিলেন পোস্টার লেখার কায়দা। কিন্তু তখন তাঁর হাতের লেখা ছিল কাঁচা ও কদর্য। কিন্তু তাতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। নিজের হাতে লেখা পোস্টার পাড়ার ঘোষবাড়ির দেয়ালে দেখে সেদিনের বালকের মনে যে-আনন্দ হয়েছিল তা আজও ভুলতে পারেননি সুমন। নিমুদা বুঝিয়েছিল যে, হাতের লেখার সঙ্গে পোস্টার লেখার তেমন কোনো সম্বন্ধ নেই। পোস্টারের হরফগুলো আসলে অক্ষরের ছবি। সেকথা বোধগম্য হতে হতে নাড়ুদা, নিমুদা তাদের গুরু বিমলকাকার কাছ থেকে পোস্টারের লেখাগুলোর অর্থ, উদ্দেশ্য-বিধেয় সবই বুঝতে পেরেছিল বালকটি।

হয়তো সেই তার সর্বনাশের শুরু, তার অ্যাম্বিশনহীন জীবনে ব্যর্থতার সূত্রপাত।

আজ শিবেন আর যতীশকে এই বেগার-ঠেলা শিল্পদায় পালন করতে বাধা দেবেন তিনি!

বরং তিনি দেখলেন এরা ঘুমোতে যখন দেবেই না তখন আর কী করা!

তিনিও ওদের সঙ্গে পোস্টার রচনার কাজে যোগ দিলেন।

রঙে-রেখায়, বিষয়ানুগ নকশা ও পরিকল্পনায়, ভাষ্য ও বয়ানে তাঁর সুপরিসর ঘরটিতে যেন এক শিল্প-প্রকল্পের সূচনা হলো। পোস্টার-সম্পর্কে পশ্চিমী দুনিয়ার তাত্ত্বিকদের প্রাথমিক ধারণার সঙ্গে সুমনের সুপরিসর ঘরটিতে চর্চিত পোস্টারের উদ্দেশ্য-বিধেয় বহুলাংশে ভিন্নমাত্রার।

পোস্টার লিখতে লিখতে সুমন এটা বুঝেছিলেন যে, পোস্টারের লক্ষিত-পরিসর বা টার্গেট স্পেস অনেক বড়ো, কেননা তা আমজনতার বোঝার জন্য উৎপাদিত এবং শিক্ষার মান, অর্থের স্বাচ্ছল্য, সামাজিক অবস্থানের বিশিষ্টতা নির্বিশেষে জনগণের দরবারে উপস্থাপিত। সুতরাং পোস্টারের লক্ষ্য  হওয়া উচিত তথ্যের স্পষ্টতা এবং সারল্য। রাজনৈতিক পোস্টারে তার সঙ্গে অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হলো আবেগের অভিমান ও সরব সমর্থন-কামনা। পরে   ম্যাকনাইট কাউফারের লেখায় তাঁর এই উপলব্ধির সমর্থন পেয়েছিলেন সুমন। কাউফার ঠিকই বলেছিলেন―পোস্টার অন্যান্য শিল্পকর্মের তুলনায় অনেক বেশি কঠোরতা দাবি করে। রাজনৈতিকই হোক বা বিজ্ঞাপনের জন্য রচিত পোস্টারই হোক পোস্টারের নকশায় সমস্ত প্রয়োজনীয় বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং নকশাটি এমন হতে হবে, যা জনসাধারণের কাছে আবেদনে সমস্ত অস্পষ্টতা পরিহার করবে। পোস্টারের সঙ্গে তার উপভোক্তাদের সম্বন্ধ-ব্যাখ্যায় কাউফার একটি ভালো পোস্টারকে  একটি মাছ ধরার বড়শির সঙ্গে তুলনা করেছেন, যে-বড়শি তার নির্দিষ্ট মাছটিকে জানে এবং সঠিকভাবে গেঁথে তুলতে পারে।

(ক্রমশ)

…………………….

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply