অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ১৬। অনন্ত জানা

প্রতীচ্যে, বিশেষভাবে ইংলন্ডে আধুনিক অর্থে নগরায়নের প্রক্রিয়া গতি অর্জন করে অষ্টাদশ শতক শেষ থেকে, এবং শিল্পবিপ্লবের কালে তা দ্রুতি পায়। উনিশ শতকের আগেও সেখানে নগরায়ন ঘটেছে কিন্তু তা ধীর অথচ স্থিত গতিতে। শিল্পবিপ্লবের ফলে রাজধানীকেন্দ্রিক জীবিকাবন্টন এবং নতুন নতুন শিল্পশহর গড়ে ওঠার সুবাদে মানুষ বেশি-সংখ্যায় লন্ডন ও অন্যান্য শহরে ভিড় করতে শুরু করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার থেকে এই পরিযানের হার ছিল অনেক বেশি। শহরগুলির পশ্চাদ্্ভুমি এবং সংলগ্ন এলাকা বা শহরতলির বিস্তারের ফলে পল্লী ও রাস্তাঘাটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে― শহরগুলির বসতি এক সংকীর্ণ ও জটিল চেহারা গ্রহণ করে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে প্রকাশিত চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০)-এর অলিভার ট্যুইস্ট সেই সময়কার লন্ডনের ‘বাণিজ্যিক উপনিবেশ’-এর ভিতর মহলের যে ছবি (‘এখানে, পুরোনো লোহা এবং হাড়ের ভাণ্ডার, এবং পশমী জিনিসপত্র এবং লিনেনের টুকরোর ছাইয়ের স্তূপ, ময়লার গর্তে মরিচা-নোংরা এবং পচন’ অথবা ‘যদিও অলিভার তার নেতার দিকে নজর রাখার জন্য যথেষ্ট মনোযোগী ছিল, তবুও সে পথের দুপাশে তাড়াহুড়ো করে একবার তাকিয়ে থাকতে পারল না। আরও নোংরা বা আরও জঘন্য জায়গা যা সে কখনও দেখেনি। রাস্তাটি ছিল খুবই সরু এবং কর্দমাক্ত, এবং বাতাস ভরে গিয়েছিল কটু দুর্গন্ধে’ ॥ ভাবানুবাদ) তুলে ধরেছে তা বোঝা যায়। সেই সময় ব্রিটেনের শহরগুলিতে শিল্পশ্রমিকেরা যেভাবে বাস করতেন তার বিবরণ থেকেও ব্রিটিশ নগরায়নের একটা ছবি পাওয়া যায়। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫) তাঁর ‘১৮৪৪ সালে ইংলন্ডের শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা’ রচনায় স্পষ্ট করে জনিয়েছেন সেই ১৮৪০-এর দশকে দ্রুত নগরায়নের ফলে অস্বাস্থ্য, বসবাসের অনুপযুক্ত কুৎসিত অবস্থা ছাড়াও এই শহরগুলিতে অনিয়মিত আকারের জমি এবং বাসস্থানের মধ্যে সরু হাঁটার পথ ছিল। কোনও স্যানিটারি সুবিধা ছিল না। জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি ছিল। (১৮৮৭ সং)
এইরকম নগরায়নের ব্যবস্থায় প্রচুর পথ বা বিপথের সৃষ্টি হয়। সম্ভবত এবং পূর্বতন ও সাম্প্রতিকে আকারে বিস্তৃত, প্রকারে জনাকীর্ণ এবং সম্প্রসারিত শহর আর তার অগণন রাস্তার জন্য নামফলকের প্রয়োজন দেখা দেয়। দরকার হয় নব নব উৎপাদিত শিল্পদ্রব্য এবং অজস্র বিপণির জন্য জ্ঞাপনীর। ফলে পথলিপি ও সাইনবোর্ডের ব্যবহার নতুন মাত্রা লাভ করে। আমেরিকায় নগরায়নের মাত্রা আশি শতাংশের বেশি। সেখানকার নিউ ইয়র্কের মতো সুবৃহৎ শহরের রাস্তাঘাটের সংখ্যা ও তার জ্ঞাপনীর ব্যবহারও তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট পরিকল্পিত।
উপনিবেশের দেশ হিসেব আমাদের দেশেও অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের দ্বিতীয় পর্ব থেকে উনিশ নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে শহরের পল্লীগুলির রাস্তাঘাটের অবস্থার পরিবর্তন হয়। নিজেদের প্রয়োজনেই নগরায়নের ধারায় ভারতীয় মেট্রোপলিসগুলি ক্রমশ রূপ পেতে থাকে। বািণজ্য ও বন্দর নগরী এবং শিক্ষা ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে কলকাতার আত্মপ্রতিষ্ঠা, জীবিকার সন্ধানে বহুমানুষের কলকাতা আগমন, ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসেবে কলকাতার গুরুত্ব ও জনঘনত্বের ফলে কলকাতাতেও রাস্তাঘাটসমেত সাবেক পল্লীগুলির পরিচয়জ্ঞাপনীর প্রয়োজন দেখা দেয়। বস্তুত অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বঙ্গের পুরোনো নগরকেন্দ্রগুলি ছাড়াও ইউরোপীয় ধাঁচে মুখ্যত গঙ্গা-অববাহিকায় নগরায়নের গতি দ্রুতি লাভ করে। কলকাতার বহু আগেই বঙ্গের নগরকেন্দ্রগুলিতে দেখা দেয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনে গঠিত স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা লোকাল গভর্নমেন্ট এবং তার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাঘাটের পরিচয়জ্ঞাপনী বেশ সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপধারণ করে। এ ব্যাপারে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, কলকাতা, দিল্লি, নিউ ইয়র্ক বা অপরাপর বড়ো বড়ো শহরগুলির মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা ভৌগোলিক অবস্থানগত বাস্তবতার (নিউ ইয়র্ক বা লন্ডনের জনঘনত্বের তুলনায় কলকাতার জনঘনত্ব অনেক বেশি ; এবং ঐ দুই শহরের তুলনায় কলকাতায় রাস্তাঘাটের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কম) যথেষ্ট তরতম থাকলেও প্রয়োজন ও বাণিজ্যসাম্রাজ্যের প্রয়োজনের বিচারে পথলিপির ব্যবহার প্রায় একই লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত।
লারউড ও হটেন তাঁদের বইতে সেই ১৮৬৬ সালেই বিজ্ঞাপন হিসেবে ইউরোপীয় ক্ষেত্রে সাইনবোর্ডের ক্রম-গুরুত্বহীনতা লক্ষ্য করেছিলেন। তাঁরা লিখেছেন : ‘ইন দিজ মডার্ন ডেজ, দি সাইনবোর্ড ইজ এ ভেরি আনইম্পর্ট্যান্ট অবজেক্ট ; ইট ওয়াজ নট অলওয়েজ সো।’ এর কারণ হিসেবে তাঁরা যা লিখেছেন তাকে প্রাচ্য জীবনধারা ও বাজারের তুলনায় বিপরীত ভাষ্য বলে আমাদের মনে হতে পারে। সম্ভবত তখন এমন একটা সময় যখন মানুষ লিখতে পড়তে জানতো না, তখন নগরজীবনে আয়ত্তিগুলির জন্য সাইনবোর্ড অপরিহার্য ছিল। মনে হয় অনেকটা আমাদের দেশের ভোটের প্রতীক-চিহ্নের মতো ঝোপ, আঙুরগুচ্ছ, নানা-ধরনের বা নাগ’স্ হেড-এর সাইনেজ দেখেই পানশালার অবস্থান মালুম হতো সুরাসেবীদের কাছে। অচেনা বাড়ির পথ, চিহ্ন বা সংখ্যা না-থাকায় অবস্থিতিগুলির সাইনেজ থাকাটা আবশ্যিক ছিল। শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর প্রয়োজন কমতে থাকে। লারউড ও হটেন লেখেন যে, যখন বাসগৃহসহ, প্রতিটি আয়ত্তির সংখ্যা নির্ধারণের ব্যবস্থা চালু হলো এবং প্রতিটি রাস্তার শুরু এবং শেষে রাস্তার নাম লেখার ব্যবস্থা হলো, তখন সাধারণ সাইনবোর্ডের আর ইতিবাচক প্রয়োজনীয়তা থাকল না―এগুলোর আসল মূল্য হারিয়ে গেল এবং ‘এগুলো তাদের উপযোগিতার কারণে নয়, বরং আমাদের পূর্বপুরুষদের আলংকারিক রসবোধের উদাহরণ হিসেবে, অথবা প্রতিষ্ঠালব্ধ খ্যাতি এবং ব্যবসায়িক সাফল্যের বিজ্ঞাপন হিসেবে টিকে থাকল।’
সুমন দেখলেন লারউড ও হটেনের এই নির্ণয় এখন ভোগ্যপণ্যের অবাধ বিকিকিনি এবং মুনাফালাভের সীমাহীন প্রকল্পের কাছে পরাজিত হয়েছে। বিশেষ করে এখন শিল্পোৎদ্ভাবনের নিরিখে, প্রযুক্তি ক্রয়-বিক্রয়ের এবং তাকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে পিছিয়ে থাকা দেশগুলিতে মুনাফালালসায় গ্রাহকদের মধ্যে ভোগ্যপণ্যের লুব্ধজ্ঞাপনের জন্য পথলিপি ব্যবহারের দাপট সমস্ত সীমারেখা অতিক্রান্ত করে গেছে! বহু ক্ষেত্রে রাস্তাই অবলুপ্ত হতে বসেছে। লন্ডনের মহা-অগ্নিকাণ্ডের মতো পরিস্থিতি দুশো-আড়াইশো বছর পরে উদারতার নামে নগরজীবনকে আবার বিপন্ন করতে পারে― এনডেল, লারউড-হটেনের পূর্বানুমান এতটা দূরে পৌঁছতে পারেনি!
সুমন এ-ও দেখলেন যে, আমাদের মতো বহুভাষার দেশে পথলিপিকে, সাইনবোর্ডের জ্ঞাপনীকে কেমনভাবে এবং সাংস্কৃতিক অবনমন ও আগ্রাসনের উপাদান হিসেবে কতটাই ব্যবহার করা যেতে পারে―এমন সমস্যা বা সম্ভাবনার কথাও এনডেলের মতো অপরাপর লেখকেরা ভেবে দেখেননি।
কিন্তু পাশ্চাত্যের শিল্পোন্নত ও সাক্ষরতায় এগিয়ে থাকা শহরগুলির তুলনায় আমাদের প্রাচ্যের, ভারতবর্ষীয় বাস্তবতা বহুলাংশে ভিন্ন হলেও লারউড ও হটেন ঠিকই বলেছেন যে, বিশাল ‘লন্ডন ডিরেক্টরি’তে উল্লেখিত মহানগরীর শত শত রাস্তার নামের মধ্যে বহু নামই সেই এলাকার পুরোনো সরাইখানা, পানশালা ও পাবলিক হাউজের নামের থেকে নেওয়া হয়েছে। আমরাও ইতোপূর্বেই ভিন্ন প্রসঙ্গে এ-বিষয়টি উত্থাপন করলেও এখানেও একথা বলতে হবে―আমাদের কলকাতা বা অন্যান্য শহরেও পেশা, বৃত্তি, কৌলিক পরিচয় বা ব্যবসার কথা লগ্ন হয়ে থাকে পল্লী ও রাস্তাগুলির নামের (কলুটোলা স্ট্রীট, শাঁখারিটোলা, পটুয়াটোলা, পার্শিবাগান, কুমারটুলি, মলঙ্গা লেন ইত্যাদি) সঙ্গে। পরম্পরার এই সৌরভও কম পাওয়া নয়!
(ক্রমশ)