অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ১৫। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

১৭৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে লন্ডনের পানশালাগুলি গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়। কেননা সম্ভবত ঐদিনই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রণীত ‘দি স্পিরিট ডিউটিজ অ্যাক্ট ১৭৩৫’ চালু হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দশকগুলিতে জিন (শস্য-থেকে পাতিত স্পিরিটের জন্য একটি সাধারণ শব্দ) পানের পরিমাণ অত্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় অপরাধপ্রবণতা, অসুস্থতাসহ নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। বস্তুত জিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যেই মদের ওপর চড়াহারে কর চাপানো হয়। এই নয়া আইনে প্রতি গ্যালনে খুচরা বিক্রয়ের উপর ২০ শিলিং হারে কর আরোপ করা হয়েছিল এবং লাইসেন্সধারীদের জিন বিক্রির জন্য বার্ষিক ৫০ পাউন্ড লাইসেন্স নিতে হয়েছিল, যা বর্তমানে প্রায় ৮,০০০ পাউন্ডের সমান। কিন্তু প্রথম থেকেই এই আইন ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হতে থাকে। এইসময় অপরিকল্পিত সাইনবোর্ডের উৎপাত কিছুটা কমেছিল বলে মনে হয়।

 

 

কিন্তু সমস্যার হ্রাসবৃদ্ধির পরিমাণ জানা না গেলেও, এই আইনের ফলে নাগরিকদের ক্ষোভ ও মদ্যকারদের কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

এই আইন প্রণয়নের পনেরো বছর পর ব্রিটিশ চিত্রকর উইলিয়াম হোগার্থ ‘জিন লেন’ ও আমাদের পূর্বোক্ত ‘বিয়ার স্ট্রীট’ নামে দুটি ছবি প্রস্তুত করেন। আমরা চিত্রকলা বা ইতিহাস বিশেষজ্ঞ নই। ভ্রান্তির সম্ভাবনা সত্ত্বেও আমাদের ধারণা―ছবি দুটিকে সরলার্থে পরস্পর বিপরীত বলে মনে করা যেতে পারে। হোগার্থ ‘জিন লেন’ ছবিতে জিন পানে আসক্ত নগরজীবনের অসংবৃত নাগর-ক্রিয়ার অবিরল বীভৎসাকে চিত্রিত করেছেন। বিদেশী জিনের প্রভাবে

মত্ত জনসমাজের নিষ্ঠুরতা, শিশুহত্যা, একই চত্বরে একাধিক সাইন ঝোলানো পানশালা, উচ্ছৃঙ্খলার সঙ্গে চারদিকে ধ্বংসের ছবি। অপরদিকে ‘বিয়ার স্ট্রীট’-এর বাসিন্দাদের  কিছুটা সুস্থ এবং সুবিন্যস্ত জীবনের প্রতিভূ হিসেবে এঁকেছেন হোগার্থ। স্থানীয় ও ঘরোয়াভাবে তৈরি ছোটো বিয়ার এবং অ্যালসেবিত তথাকথিত সুখী লোকেরা ‘বিয়ার স্ট্রীট’-এর বাসিন্দা। ‘জিন লেন’-এর উন্মত্ত বৈনাশিকতা আর ‘বিয়ার স্ট্রীট’-এ স্থূল লোকেদের মতোই মোটা দাগের জীবনযাপন (মাছের বাজার!)। বিনাশ ও তথাকথিত উজ্জীবনের বৈপরীত্যের মধ্যে সম্ভবত একটিই মিল, আর তা হলো মদালস জীবনের স্থূলতা, অন্তঃসারশূন্যতা। ইতোপূর্বেই আমরা বলেছি যে, শেষোক্ত চিত্রে সাইন অঙ্কনরত নির্মেদ শিল্পীর উপস্থিতির সূত্রে সাইনবোর্ড আঁকিয়ে হিসেবে শিল্পী হোগার্থের আত্মবোধের একটু বাড়তি অথচ জরুরি ভূমিকা থেকে যায়।

বস্তুত  শুধু সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের ইংলন্ড, ফ্রান্স বা ইউরোপ নয়, কলোনী ভারতেও বাজারের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞাপনীর বাড়াবাড়ি রকমের ব্যবহার হতে থাকে। সাইনবোর্ডের ঘনঘটার ক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতকের লন্ডন অথবা ব্রিটিশ ভারতের নগরকেন্দ্রগুলির বা বিশ শতকের প্রথমার্ধের রাজপথগুলির বিশেষ কোনো ফারাক খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

আমরা আগেই দেখেছি যে, শুধু ভারতে নয়, সমগ্র প্রাচ্যেই সাধারণভাবে ব্যবসাকেন্দ্রগুলিতে বিপণি পরিচয়ের তেমন প্রয়োজন হতো না, কেননা জনভুক্ত ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই অক্ষর পরিচয়ের বিশেষ ধার ধারত না। তারও ওপর পণ্য-অনুযায়ী বিক্রয়-এলাকা এবং ক্রেতা-বিক্রেতাদের পছন্দ এতই সুনির্দিষ্ট এবং তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধ এতই অব্যবহিত ছিল যে সাইনবোর্ড বা সাইনেজ-ব্যবহার করার প্রশ্নই ছিল না। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের এবং তার পরেরও কলকাতার ছবি ও স্কেচগুলিতে ক্রেতা-বিক্রেতায় ভিড়াক্রান্ত বাজারে বিপণির সংখ্যা অগণন হলেও  সেখানে বিপণির স্থায়ী কাঠামোর সংখ্যা কম এবং তা জ্ঞাপনীবিরল। সেকালের বিকিকিনির পদ্ধতির ধরনটি বোঝা যায় সেকালের গ্রন্থে। হুতোম তাঁর নকশায় লেখেন : ‘যে সকল মহাত্মারা ছেলে-বেলা কলকেতার চীনে বাজারে ‘‘কম স্যার! গুড সপ স্যার! টেক্ টেক্ টেক্ নটেক্ নটেক্ একবার তো সী!’’ বলে সমস্ত দিন চীৎকার করে থাকেন, যে মহাত্মারা…।’ (হুতোম প্যাঁচার নকশা : ১৮৬৪) হুতোম বিচিত্র অর্থে ও বিচিত্রতর ব্যঞ্জনায় বাজার শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

কিন্তু সম্ভবত এই সময়কালেই ইংরেজদের বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠানগুলি বা মার্চেন্ট হৌসের শিরোদেশে ইংরেজি ভাষায় পরিচয়-জ্ঞাপনী লাগানো শুরু হয়ে গেছে। বস্তুত বাঙালির ব্যবসার ধারাবাহিকতার শুরু হয় আরও কিছু পরে― একেবারে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে বা বিংশ শতাব্দীর সূচনায়। ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ আখ্যায়িকায় ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লেখেন : ‘বাঙালিরা কারবার জানেনা, কেবল চাকরী জানে, এই একটা দুর্নাম ছিল ; এখন সেই দুর্নামমোচনের অভিলাষে বাঙালী সন্তানেরা এক একটা কারবারের নামে এক একটা দোকান খুলে বোসছেন, দোকানে দোকানে এক এক সাইনবোর্ড ঝুলছে। সব সাইনবোর্ডে প্রায় দোকানদারের নামের সঙ্গে ‘‘এণ্ড কোং’’ জোড়া। (উদ্ধৃত এবং বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন আত্মজিৎ মুখোপাধ্যায় : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ : ইনস্ক্রিপ্ট.মি) বাঙালিরা কোম্পানীবদ্ধ হয়ে কাজ কোত্তে জানেন, ঐ এণ্ড কোং শব্দ তারি পরিচয় দেয়, ফলে কিন্তু কি সেটি নির্ণয় করা দুর্ঘট। অক্ষরেই কেবল এণ্ড কোং, এণ্ড কোং, এণ্ড কোং!’

কী কী কারবারে বাঙালির মধ্যে বাণিজ্যে বসতে… জেগে উঠেছিল তা-ও জানিয়েছেন ভুবনচন্দ্র : ‘কতদিকে কত প্রকারে  ইংরেজী সভ্যতার নিদর্শন দৃষ্ট হয়, সংখ্যা করা যায় না। দেশের পূর্ব্ব গৌরবের উদ্ধারবাসনায় কেহ কেহ অগ্রসর। মধ্যে কয়েক বৎসর  আয়ুর্ব্বেদমতে চিকিৎসা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে এসেছিল, এখন আবার কতকগুলি লোক, ―বৈদ্যই হউন আর অন্য জাতিই হউন, আয়ুর্ব্বেদকে জাগিয়ে তুলবার চেষ্টা করছেন, রাস্তায় রাস্তায় বড় বড়  সাইনবোর্ডে ‘‘আয়ুর্ব্বেদীয় ঔষধালয়’’ অগণিত।’ (তদেব)

এসব ইতিহাস ঘাঁটতে ঘাঁটতে সুমন ১৯৪০-এর দশকের কলকাতার একটি ছবি পেলেন। হ্যারিসন স্ট্রীট (বড়োবাজার) ও স্ট্র্যান্ড রোডের সংযোগস্থলের এই ছবিটিতে ভুবনচন্দ্রের কথার সারবত্তা বুঝতে পারলেন সুমন। ছবিতে ঐ দুই রাস্তার সংযোগস্থলের স্থাপনার অঙ্গে, তার আশপাশের অট্টালিকায়, এবং রাস্তায় ঢাকা আয়ুর্ব্বেদীয় ফার্ম্মাসী, বেঙ্গল শটী ফুড, অজস্র আয়ুর্বেদিক সংস্থার, চিকিৎসাগ্রন্থের, ভীমরস সালসা, দুলালের তালমিছরি, গোবিন্দ সুধা, কুমারেশ, হোমিওপ্যাথিক ঔষধ পুস্তক, হেমকান্তি সুরভিত কেশতৈল, সান বিস্কুট ও বার্লি, হ্যানিম্যান পাবলিশিং কোং ইত্যাকার ওযুধ-বই-প্রসাধনীর সাইনবোর্ড!

সাইনবোর্ড শিল্পের আর-একটি প্রেক্ষিতের দিকেও সুমনের নজর পড়ে। তা হলো স্ট্রীটনেম সাইন বা পথপরিচায়ক পথলিপি। মুখ্যত নগরজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই লিপিচিত্র কলকাতায় থাকতে চোখের সামনে আকছাড় দেখেছেন। অনেকসময় চমকিতও হয়েছেন। কিন্তু তার স্বাতন্ত্র্য অনুধাবন করতে পারেননি। অনতি-বাল্যে স্মরণকালে যখন গঞ্জ থেকে তাঁর বাবা বদলি হলেন, তখন বর্ধমানের মতো মফস্বলী শহর ছুঁয়ে তাদের পরিবার একেবারে মহানগরে! ততদিনে সুমন কৈশোর ছুঁয়েছেন।

নতুন ক্লাস, নতুন স্কুল। মায়ের সঙ্গে বই-খাতা কিনতে বেরিয়েছেন।

ডাক্তার হলেও হাসপাতাল বা সরকারি ডিসপেন্সারিতে চাকরির অতিরিক্ত উপার্জনে বাবার অনীহার কারণে মাকে খুব সন্তর্পণে সংসার চালাতে হতো। বরাবরই দিস্তা ধরে সাদা আর রুল-টানা লেখার কাগজ কিনে ক্রচেটের সুতো আর গুণসূঁচ দিয়ে সেলাই করে তাতে ব্রাউন পেপারের মলাট দিয়ে দিতেন মা।

দেয়াল থেকে প্রায়-ঝুলন্ত ছুটকো দোকান থেকে কাগজ কিনে ছাপার জন্য বড়ো বড়ো  কাগজের একসার দোকানের মাঝের রাস্তা দিয়ে সুমনকে নিয়ে একটি তস্য গলিপথে প্রবেশ করলেন মা। সেটার প্রথম বাড়িটার পলেস্তারা-খসা বিবর্ণ দেয়ালে সরু একফালি ব্লু এনামেল বোর্ডে সাদায় লেখা রাস্তার নাম পড়ে চমকে গেছিলেন সেদিনের সদ্য-কিশোর সুমন। এই নাম তো তিনি তাঁর বাল্যাবধি গজানো সাহিত্যপ্রীতির সুবাদে সেই রাস্তার নাম তো তিনি কতই পড়েছেন গল্পে! সুমন দেখলেন গলির শেষবাড়িটার গায়েও অমন পরিচয়জ্ঞাপক প্লেট লাগানো। আরও পরে মহল্লার আশপাশে এমন অনেক স্ট্রীটনেম-সাইন দেখেছেন, পুরোনো পাড়াগুলির বাড়ির নম্বরও অনেক ক্ষেত্রে এনামেল কাস্টিংয়ে লেখা থাকত।

এই নামলিপি মুখ্যত নগরায়নের দান।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *