অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ১৪। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে

……………………………………………

সাইনেজ, প্রতীক এবং জ্ঞাপনীচিহ্নের ব্যবহারিক প্রয়োগের ঐতিহ্যগত অনুক্রমিক অনবছিন্নতার সূত্রে এবং নগরজীবনের বিস্তৃতি, সমুদ্র-বাণিজ্যের অভিযাত্রা, ক্রমাগত নতুন নতুন ভূবিশ্বের পরিচয় উন্মোচনের ফলে বিশ্বব্যাপী বিপণনের প্রসারণ এতটাই ব্যাপকতা লাভ করে যে, বিপণি কিংবা যাবতীয় পণ্যের জন্য অথবা সবধরনের ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য সাইন এবং তদ্্সূত্রে সাইনবোর্ডের ব্যবহার আবশ্যিক বলে বিবেচিত হতে থাকে। বিশেষভাবে ইউরোপের উপনিবেশকুশল ও বাণিজ্যসফল দেশগুলিতে।

খুব প্রাথমিক যুগেই সম্ভবত কর আদায়ের সুবিধার জন্য বহু ক্ষত্রে সাইনবোর্ড লাগানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল [‘ট্যাভার্নকিপারস্ মাস্ট পুট আপ সাইনবোর্ডস্্ অ্যাণ্ড এ বুশ (পানশালার সর্বজনমান্য প্রতীক)… নোবডি শ্যাল বি অ্যালাউড টু ওপেন এ ট্যাভার্ন ইন দি সেইড সিটি অ্যাণ্ড ইটস্ সুপার্বস্ উইদাউট এ সাইন অ্যাণ্ড এ বুশ’]। স্বাভাবিক সাইনবোর্ড না-লাগানোর জন্য ১৩৯৩ সালে চেলসিয়ার একজন মদ্যব্যবসায়ীকে  শাস্তি দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। কেমব্রিজেও এ-সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন বেশ কঠোর ছিল। (লারউড ও হট্টেন : প্রাগুক্ত গ্রন্থ)

ইংলণ্ডে প্রথম চার্লস (১৬০০-১৬৪৯) সিংহাসনে আরোহনের পরে পানশালা ছাড়াও লন্ডনের আপামর ব্যবসায়ী ও নাগরিকদের পরিচয়জ্ঞাপক ও নির্দেশক সাইনবোর্ড ঝোলানোর মঞ্জুরি প্রদান করেন। এই শহরের নাগরিকদের এবং তাদের যে কোনও ব্যক্তির জন্য, শহর ও শহরতলির রাস্তা, সড়ক এবং গলিতে, তাদের বাড়ি এবং দোকানে লাগানো, একই ধরনের সাইনবোর্ড এবং পোস্ট খোলা এবং ঝুলানো বৈধ হবে, যাতে এই ধরনের নাগরিকদের বাসস্থান, শিল্প, বা পেশা, তার উত্তরাধিকারীদের কোনোরকম হয়রানি বা বাধা ছাড়াই আরও ভালোভাবে সনাক্ত করা যায়।

ফ্রান্সে পানশালা ও সরাইখানার মালিকরা ইংল্যান্ডের মতোই রাষ্ট্রীয় নিয়মের অধীনে ছিলেন; কারণ সেখানেও, ১৫৬৭ সালের এক আদেশ অনুসারে, সমস্ত সরাইখানার মালিকদের ম্যাজিস্ট্রেটদের তাদের ‘নাম এবং ঠিকানা’ এবং তাদের ‘প্রভাব ও লক্ষণ’ সম্পর্কে অবহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তৃতীয় হেনরি (১৫৫১-১৫৮৯) ১৫৭৭ সালের মার্চের একটি ঘোষণা-অনুসারে, সমস্ত সরাইখানার মালিকদের তাদের বাড়ির সবচেয়ে স্পষ্ট অংশে একটি চিহ্ন স্থাপন করার আদেশ দেন―যাতে প্রত্যেকে, এমনকি যারা পড়তে পারে না, তারাও পানাগারের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকে। চতুর্দশ লুই (১৬৩৮-১৭১৫) বা লুই দ্য গ্রেট, ১৬৯৩ সালে জারি করা একটি আদেশ অনুসারে, প্যারিস তথা ফ্রান্সের সাইনবোর্ড প্রতিস্থাপনের নির্দেশ দেন এবং জানান যে, অতঃপর সরাইখানা মালিকেরা সাইনবোর্ড এবং বিক্রয়যোগ্য পণ্যের দামের তালিকা উল্লেখ না করে সরাইখানা চালাতে পারবেন না। নিয়ম না মানলে এই আইনে লাইসেন্স রদ করা ও সরাইখানা বন্ধ করে দেবার সংস্থান ছিল।

সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে লন্ডনের মতো বৃহৎ ও জনবহুল নগরের সমস্ত পথঘাট ব্যবসায়িক বিপণি, বিবিধ প্রতিষ্ঠান  এবং ব্যক্তিগত প্রয়োজনে লাগানো সাইনবোর্ড, প্রতীকী-জ্ঞাপন ও পরিচয়লিপিতে ভরে যায়। এর একটা বড়ো অংশই ছিল পানশালা এবং সরাইখানা। বস্তুত সাইনবোর্ড ও বিজ্ঞাপনের আধিক্যের ফলে শহরের রাস্তাঘাট ঢেকে যায়, আকাশ যায় দৃষ্টিসীমার অন্তরালে। সে যেন সাক্ষাৎ এ-কালের কবির অনার্ত আক্ষেপ―‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি / তোমার জন্য গলির কোণে / ভাবি আমার মুখ দেখাব / মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। (শঙ্খ ঘোষ : মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, ১৯৮৪)

লন্ডনের মহা অগ্নিকাণ্ডের ঘটে ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে। এক বেকারির চুল্লি থেকে আগুন ছড়ায়। বেকারিটা ছিল বিখ্যাত লন্ডন ব্রিজের কাছেই। ২ সেপ্টেম্বর আগুন লাগে। ৬ সেপ্টেম্বর অগ্নি তার রোষ সংবরণ করে। এই বিধ্বংসী আগুনে প্রায় সাড়ে তেরো হাজার বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়, গৃহহারা হন লক্ষাধিক মানুষ। ওল্ড সেন্ট পল্’স্ ক্যাথেড্রালসহ সাতাশিটি চার্চও ধ্বংস হয়। যেমন আদালত, জেল, বেসামরিক প্রশাসনিক ভবন, শহরের অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সরকারী হিসাবেই এক ডজ়নেরও বেশিজনের প্রাণহানি হয়েছিল। অনুমান সমগ্র লন্ডন শহরের ৮০ শতাংশেরও বেশি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অগ্নিকাণ্ডে সম্ভবত কাঠের তৈরি সংখ্যাতীত সাইনবোর্ড চমৎকার দাহ্য পদার্থ হিসেবে কাজ করেছিল। ফলে অগ্নিকাণ্ড পরবর্তীকালে লণ্ডন শহরের পুনর্নির্মাণের পর রাস্তায় কাঠের সাইনবোর্ডের পরিবর্তে, পাথরে খোদাই করা এবং সাধারণত অক্ষরগুলি রঙ করা বা সোনালি রঙ করা সাইনবোর্ড ব্যবহার করা হতো, যা বাড়ির সামনে এবং প্রথম তলার জানালার নিচে রাখা হতো কিন্তু আগুনের আয়ত্তসীমার বাইরে থাকা লন্ডনের রাস্তাগুলির সাইনবোর্ড তার পুরোনো চালই বজায় রেখে চলতে থাকে। সেখানে আগেকার মতোই কয়েক ইঞ্চি দূরে দূরে কাঠের পাটাতনের ওপর লেখা সাইনবোর্ড শোভা পেতে থাকে। ফলস্বরূপ, সরু রাস্তায়, ঘিঞ্জি এলাকায় পেন্টহাউস এবং সাইনবোর্ডের কারণে লন্ডনের রাস্তায় ভাগ্যহীন পথচারীদের কাছ থেকে আকাশের দৃশ্যমানতা, বাতাসের ক্রীড়াকুশলতা এবং পথসন্ধানের আলো প্রায় আটকে যায়। সেখানে পথচারীদের পাওনা―বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বা পেন্টহাউজগুলি থেকে উড়ে আসা ফুলের টব, কিংবা প্রতিটি বাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে আসা ঝরনা-স্নানের জলধারা এবং মরচে-লাগা কব্জায় জলস্রোতের ঝুলন্ত চিহ্নগুলি।

এই অসহ্য পরিস্থিতি থেকে লন্ডনের পথচারীদের কিছুটা মুক্তি দিয়েছিলেন রাজা দ্বিতীয় চার্লস (১৬৩০-১৬৮৫)। তাঁর ইংলন্ড শাসনের সপ্তম বছরে, অর্থাৎ ১৬৬৭ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডন শহরের পুনর্নির্মাণের জন্য আইনটি পাস হয়েছিল। এতে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে ভবিষ্যতে আগুনের ঝুঁকির বিরুদ্ধে সমস্ত নতুন ভবন ইট বা পাথর দিয়ে তৈরি করতে হবে। এই আইনে আদেশ দেওয়া হয়েছিল যে, কোনো রাস্তায় আড়াআড়ি কোনোরকম সাইনবোর্ড লাগানো চলবে না। তবে বাড়ির বারান্দায় বা বাড়ির পাশে কোনো সুবিধাজনক জায়গায় সাইনবোর্ড লাগানো যেতে পারে।

সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্যারিসবাসীরাও এই ভয়াবহতার শিকার হচ্ছিলেন। কাষ্ঠসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, বনরক্ষা ও বনায়নের লক্ষ্যে ১৬৬৯ খ্রীস্টাব্দে জারি-করা ফ্রান্সের রাজকীয় অধ্যাদেশের (পূর্বোক্ত ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই) দ্বারা রাস্তার যত্রতত্র দানবিক সাইনেজ ও সাইনবোর্ড লাগানোয় নিষিদ্ধকরণ করে জারি করা অর্ডিন্যান্সের বিলক্ষণ সম্বন্ধ অনুমান করা যায় [ইন ১৬৬৯, এ ব়য়্যাল অর্ডার ওয়াজ ইস্যুড টু প্রহিবিট িদজ মনস্টারাস সাইনস্্, অ্যাণ্ড দি প্র্যাকটিস অব অ্যাডভান্সিং দেম টু ফার ইনটু দি স্ট্রীটস্্, “হুইচ েমড দি থাব়্যাফেয়ারস্্ ক্লোজ ইন ডে-টাইম, অ্যাণ্ড প্রিভেন্টেড দি লাইটস্ অব দি ল্যাম্পস্্ ফ্রম স্প্রেডিং প্রপারলি অ্যাট নাইট”। (লারউড ও হট্টেন)] লন্ডনেও প্রায় একই সময়ে কিছুটা অনুরূপ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। স্পষ্টতই তখন ব্যবহৃত সাইনবোর্ডগুলির আমাদের পোস্টারের মতো, একটি আকর্ষণ ছিল, তবে অতিরিক্তভাবে যানবাহনের জন্য একটি বড়ো ঝামেলা এবং প্রকৃতপক্ষে জনসাধারণের জন্য একটি বিপদ ছিল।

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই সমস্যা আরও তীব্র হয় বলে মনে হয়। ফ্রান্সের পঞ্চদশ লুই (১৭১০-১৭৭৪) তাঁর রাজত্বকালে (১৭১৫?-১৭৭৪) সাইনবোর্ডের উৎপাত হ্রাস করার জন্য ১৭৬১ সালে একটি আদেশ জারি করেন। এতে সাইনবোর্ডগুলিকে কেবলমাত্র দেওয়ালের সঙ্গে সমতলভাবে ঝোলানোর অনুমতি প্রদান করা হয়। (ই. ম্যাকনাইট কাউফার : ১৯২৪)

মধ্য ও উত্তর-মধ্যযুগের থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত ইউরোপীয় ধারায় মাদকতাময় চলনরীতির উপস্থিতির ফলে পানাগার, বিয়ার-জাতীয় পানীয় তৈরিতে দক্ষ পরিবারগুলির উদ্যোগ, অজস্র সরাইখানায় প্রতীকী জ্ঞাপনী তথা সাইনের প্রদর্শনের বৈচিত্র্য এবং তৎসহ পণ্য বিপণনের মাধ্যম হিসেবে আকর্ষণীয় বিষয় আর তার ইঙ্গিতপূর্ণ উপস্থাপনায় লিখন ও সাইনের ব্যবহার সর্বকালে অন্যতর অধ্যয়নের বিষয় হতে পারে। যেমন : পানশালার জন্য বুশ বা ঝোপ ছাড়াও আঙুরগুচ্ছ, নাগ’স্ হেড, অ্যালে পোল ইত্যাদি প্রতীক―ধার্মিক, অর্থশালী, ক্ষমতাবান ও অভিজাত পরিবারের চিহ্ন হিসেবে লুট্রেল সাল্টার। অ্যালে পোল

বা অ্যালে স্টেক ছিল ইউরোপে ব্যবহৃত এমন একটি প্রাথমিক চিহ্ন, যার দ্বারা বোঝানো হতো―একটি পরিবার নতুনভাবে অ্যালে বা বিয়ারের একটি নতুন পাতন বা নতুন ব্যাচ তৈরি করেছে। সে-সময় সমস্ত বিয়ার তৈরি হতো ঘরোয়া ক্ষেত্রে। কিন্তু যে-সকল বাড়ি বা পরিবার উৎকৃষ্ট মানের বিয়ারের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিল, তাঁরা নিজেদের ‘অ্যালে হাউজ’-এ গ্রামের মানুষজন, পথচারী বা পর্যটকদের বিয়ার পানের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারে।

নাগস্ হেড ছিল একটি ঘোড়ার মুখ ( কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘোড়ার লোহার নালসহ), গ্রেট ব্রিটেনের পাব বা পানশালাগুলির একটি জনপ্রিয় নাম বা অভিধা।

অপরদিকে ক্রশ চিহ্নের আড়ালে  থাকা লুট্রেল সাল্টার হলো লিঙ্কনশায়ারের ইরনহ্যামের জমিদার স্যার জিওফ্রে লুট্রেল (১২৭৬-১৩৪৫) দ্বারা কমিশনড্ একটি আলোকময় সাল্টার (বাইবেলের প্রার্থনাসংগীতের গ্রন্থ), যা ১৩২০ সাল থেকে ১৩৪০ সালের সময়সীমার মধ্যে ইংলন্ডের বেনামী লেখক ও শিল্পীদের দ্বারা পার্চমেন্টে লিখিত ও চিত্রিত হয়েছিল। এই পাণ্ডুলিপি ছিল লুট্রেল পরিবারের মর্যাদা, আভিজাত্য, সম্পদ এবং রুচির পরিচয়। পরে সংশ্লিষ্ট প্রতীকটি সম্ভবত সার্বিকভাবে ধার্মিক ও রুচিলালিত গ্রামীণ আদর্শ জীবনযাত্রাবোধের পরিচয় হয়ে ওঠে।

সেই সময়ের প্রতীকী চিত্রগুলি সাধারণভাবে বাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে থাকা দন্ডের সঙ্গে পতাকা বা একপক্ষবিশিষ্ট ব্যানারের মতো ঝুলন্ত অবস্থায় প্রদর্শিত হতো।

(ক্রমশ)

………………………………….

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, ই-সূত্র থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *