অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ১২। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

সুমনের তাক লেগে গেল, ―গোপাল বাড়ুজ্যের সাইনবোর্ড লেখার আগে পর্যন্ত এই গঞ্জও কি সেই অব্যবহিত সামাজিক সম্পর্কের মায়া নিয়ে এতকাল সেই সামাজিক যূথতার পূর্বাধিকারকে বহন করে চলেছিল!

সাইনবোর্ডের ইতিহাস বড়ো সোজা ব্যাপার নয়।  আমাদের পূর্বোক্ত জ্যাকব লারউড ও জন ক্যামডেন হট্টেন (হটেন?) সাইনবোর্ডের ইতিহাস নিয়ে সেই ১৮৬৬ সালেই (ভূমিকা রচনার তারিখ অনুসারে) একটা আস্ত বই লিখে ফেলেছিলেন। এই বইতে সাইনবোর্ডের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে সাইনবোর্ড ব্যবহারের নানাদিক নিয়ে আলোচনা আছে। তাঁদের এই বই আর ইতিহাসের নানাবিধ প্রমাণ ও পারিপার্শ্বিক অনুিমত-তথ্য থেকে আমরা সাইন ও সাইনবোর্ড ব্যবহারের একটি সম্ভাব্য আনুমািনক অতি-সংক্ষিপ্ত রূপরেখা প্রস্তুত করতে পারি। মনে হয় প্রাচ্যের মতোই প্রাচীন মিশরে সাধারণ নিয়মানুসারে লেখা বা ছবির সাহায়্যে পণ্যের গুণাগুণ বা বিপণির মালিকের পরিচয় বিজ্ঞাপিত হতো না। বিক্রয়যোগ্য পণ্যের প্রদর্শনই ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণের পক্ষে যথেষ্ট ছিল।

তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বা উপলক্ষে বাণিজ্যের প্রকৃতি বোঝানোর জন্য পাথরের ওপর লিপি ও প্রতীকের সাহায্যে উদ্দিষ্ট পণ্যটিকে বোঝানো হতো। এ থেকে লারউড ও হট্টেনের নিরূপণ―মিশরীয়রাই বাণিজ্যক্ষেত্রে প্রথম সাইনবোর্ডের সুবিধা উপলব্ধি করেছিল (―‘হোয়েন্স উই মে অ্যাসিউম দ্যাট দিস এনশিয়েন্ট নেশন ওয়াজ দি ফার্স্ট টু অ্যাপ্রিশিয়েট দ্যাট মাইট বি ডিরাইভড্ ফ্রম সাইনবোর্ডস’) কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগে গ্রীস, মিশরের সাইনবোর্ড ও সাইন ব্যবহারের তথ্য বা উদাহরণগুলিকে খুব সুনির্দিষ্ট বলা চলে না। রোমানদের ক্ষেত্রে প্রতীক-হিসেবে সাইন এবং সাইনবোর্ড ব্যবহারের কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যেতে পারে। লারউড ও হট্টেন জানাচ্ছেন : ‘উইথ দি রোমানস ওনলি উই বিগিন টু হ্যাভ ডিস্টিঙ্কট্ ডাটা। ইন দি ইটার্ন্যাল সিটি, সাম স্ট্রীটস, অ্যাজ ইন আওয়ার মিডিয়েভ্যাল টাউনস, ডিরাইভড দেয়ার নেমস ফ্রম সাইনস। সাচ ফর ইনস্ট্যান্স, ওয়াজ দি ভিকাস উরসি পিলইয়েটি (?), (দি স্ট্রীট অব “দি বিয়ার উইথ দি হ্যাট অন”) ইন দি এস্কিলাইজ (?)। রোমান চিহ্নগুলির সুনির্দিষ্টতার উদাহরণ হতে পারে পম্পেই ও হেরকুলেনিয়াম নগরীর ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রাপ্ত সাইন ও সাইনবোর্ডগুলি। নগর বিপণিগুলির উন্মুক্ত বহির্দেশে বা পার্শ্ববর্তী স্তম্ভে বা বিপণিতে বিক্রয়জাত পণ্যের পরিচয় হিসেবে চিহ্নায়িত করার জন্য সেগুলি লাগানো থাকত। এর কয়েকটি হাতে আঁকা হলেও তখনকার রীতি অনুসারে এগুলির অধিকাংশই পাথর বা টেরাকোটা রিলিভো দিয়ে তৈরি বলে মনে হয়। এমন চিহ্ন ব্যবহারের কিছু নমুনার উল্লেখ করেছেন লারউড ও হট্টেন, যেমন : একটি অশ্বেতর একটি কল চালাচ্ছে, সম্ভবত একটি রুটি কারখানার চিহ্ন, একটি ছাগলের রেখাচিত্র―ডেয়ারি বা দুগ্ধ-বিপণির পরিচয়, একজন পম্পেইয়ান পাবলিক হাউজকিপারের দরজায় দুটি ক্রীতদাসের ছবি, আর-একজন মদ-ব্যবসায়ীর ছবি―যে আঙুর টিপে রস বের করছিল, সুগন্ধী-দ্রব্যের দোকানে নানাবিধ সুগন্ধী পণ্যের ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপের চিত্র―চারজন লোক ফুলদানিসহ একটি বাক্স বহন করেছে, একজন স্কুলশিক্ষকের দরজার কাছে একজন ছাত্রের বেত্রাঘাত প্রাপ্তি―ইত্যাদি। সম্ভবত রোমানরা বিশেষ বিশেষ ব্যবসাকেন্দ্রে, বিভিন্ন বৃত্তির কারিগরেরা তাদের বাসস্থানের বহির্দেশে বা নিকটবর্তী স্থানে পেশাগত চিহ্ন ব্যবহার করত ( যেমন ছুতারেরা তাদের ছেনি, একটি করাত, চিকিৎসকের কাপিং গ্লাস (রক্তমোক্ষক কাচ), চর্মকারের জুতো ও পাদুকা, একজন সম্ভ্রান্ত মহিলার পরিচারিকা বা দাসীর হাতে আয়না ও চিরুনি, অন্যের হাতে উলের ঝুঁটি তৈরির সরঞ্জাম, একজন জরিপকারী বা কানুনগোর কাছে জমি পরিমাপক―ইত্যাদি) আর বিক্রেতারা তাদের বিক্রেয় পণ্যের। অর্থাৎ সম্ভবত প্রায় প্রতিটি লিখনে পেশা ও ব্যবসারই নিজস্ব ও প্রয়োগযোগ্য হাতিয়ারের প্রতীকী ব্যবহার ছিল।

এমন-কী নামের সঙ্গে উচ্চারণের ধাঁচ মিলিয়ে ককনি শ্লেষাত্মক সাইন অঙ্কনের রীতি প্রচলিত ছিল। মৃত ব্যক্তিদের সৌধেও তার নজির খুঁজে পাওয়া যায়। নামের উচ্চরণের ধ্বন্যাত্মক সাদৃশ্যকে অবলম্বন করে  প্রতীকী চিহ্ন অঙ্কনের রীতি ছিল। যেমন : কার্থেজের খ্রিশ্চান কবি ব্লোসিয়াস এমিলিয়াস ড্রাকন্টিয়াস (আনু. ৪৫৫-আনু. ৫০৫ খ্রিস্টাব্দ)-এর সমাধি। কার্থেজ ছিল আফ্রিকার উত্তর উপকূলে। ভ্যাণ্ডালদের দ্বারা দেশটি অবরুদ্ধ হওয়ার পর রাষ্ট্রনৈতিক বিপর্যয়ের বিপন্নতা থেকে শান্তির সন্ধানে তিনি রোমান ইতালিতে চলে যান। তাঁর রচনাগুলিতে প্রকাশের প্রাণশক্তি, রোমান ধ্রুপদী সাহিত্য ও বাইবেল সম্পর্কে অসাধারণ জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। ড্রাকন্টিয়াসের সমাধিতে ড্রাগনের প্রতীকী উপস্থিতি পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত সাইনবোর্ডের ইতিহাসকার লারউড ও হট্টেন লেখেন :

‘ঈভন দ্যাট ককনি কাস্টম অব পানিং অন দি নেম, েসা কমন অন সাইনবোর্ডস্্, ফাইণ্ডস্্ ইটস্্ প্রিসিডেন্ট ইন দোজ ম্যানসনস্্ অব দি ডেড। ওয়িং টু দিস ফ্যান্সি, দি গ্রেভ অব ড্রাকন্টিয়াস বোর এ ড্রাগন।’ (তদেব) অর্থাৎ এই কল্পনার কারণে, ড্রাকন্টিয়াসের সমাধিতে একটি ড্রাগন ছিল ; সম্ভবত ‘ড্রাকন্টিয়াস’ শব্দের উচ্চারণ-সাদৃশ্যে ড্রাগন!

রোমানদের সুস্পষ্ট বাণিজ্য-চিহ্নের এই ব্যাপকতার কারণ ছিল।

সেকালে পম্পেই এবং হেরকুলেনিয়াম নগর দুটিই ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম ইতালির কাম্পানিয়া অঞ্চলের দুটি বৃহৎ বাণিজ্যকেন্দ্র। পম্পেই নগর ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম বৃহৎ শিল্প বন্দর। রোমান ও গ্রীক বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র ছিল এই শহর। ক্রমশ এই নগরই হয়ে উঠেছিল সমকালীন রোমের বিত্ত, বৈভব ও নাগর-সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র। অর্থে, আভিজাত্যে, বিলাসে-ব্যসনে, বিনোদনে, অবারিত ভোগ-প্রমোদে পম্পেইয়ের জুড়িদার ছিল প্রতিবেশী হেরকুলেনিয়াম নগর। বিনোদন ও ভোগসন্ধানী প্রচুর পর্যটক স্রোতের মতো এই নগরদুটিতে ভিড় জমাতেন। প্রথমে তীব্র ভূকম্পনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঠিক সতেরো বছর পরে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে নগরদুটি ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়। এডওয়ার্ড বুলওয়ার-লিটন (১৮০৩-১৮৭৩)-এর ‘লাস্ট ডেজ অব পম্পেই’ উপন্যাসে (১৮৩৪) জনতারণ্য-আক্রান্ত এই বাণিজ্য নগরীর কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। এই সঙ্গে রুশশিল্পী কার্ল ব্রিউলভের আঁকা বিখ্যাত ‘দ্য লাস্ট ডে অফ পম্পেই’ চিত্রটি দ্রষ্টব্য। এই ছবিটি (চিত্র রচনার কাল ১৮৩০-১৮৩৩)-তেও ধ্বংসোন্মুখ পম্পেই নগরীর পথপার্শ্বের অট্টালিকার প্রবেশ পথে সম্ভাব্য চিহ্নিত-জ্ঞাপনী দেখা যাচ্ছে। বলাই বাহুল্য পম্পেই নগরীর ধ্বংসস্তূপ পুনরুদ্ধারের সময় এমন বহুতর দেওয়ালচিত্র, তোরণচিত্র, তোরণলিপি, গৃহ বা মিলনস্থলসজ্জার ক্ষেত্রে, ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্য-বিপণি, ক্রয়-বিক্রয়ের অন্তরাপনগুলির জন্য ব্যবহৃত চিহ্ন ও জ্ঞাপনী দৃষ্ট হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার ব্যাপক ব্যবহার সাম্প্রতিককালেও আমাদের বিস্মিত করে।

এর সঙ্গেই উল্লেখ্য ইতালিয়ান চিত্রকর লুইজি রোসিনি (১৭৯০-১৮৫৭)-কৃত ‘ভায়া ডি সেপোলক্রি ইন পম্পেই’ (১৮৩০) রচনাটি। এখানে হর্ম্য-তোরণের শীর্ষে সাইনেজ কিংবা লিখন (?) দেখা যাচ্ছে বলে বোধ হচ্ছে।

দেখতে গেলে বাণিজ্য ছাড়াও প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সমাধি ও সৌধলিপিগুলি সাইন-রাইটিং-এর যথেষ্ট পুরোনো উদাহরণ। কিন্তু সমাধি-লিপি বা এপিটাফ বিষয় এবং উপস্থাপনার দিক দিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ হলেও তাকে সাইন অথবা সাইনবোর্ডর সগোত্রীয় বলা যায় না। সমাধি ও সৌধলিপিকে তক্ষণের কাজ বলা যায়―পাথর বা নির্মাণের অঙ্গে তক্ষণের কাজ। এর বিষয় ও ধরন নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে। কিন্তু সেখানে লিপিশিল্পীদের কোনো উল্লেখ বা হদিশ পাওয়া যায় না। মুখ্যত তক্ষণের কাজ হলেও বিশেষভাবে সৌধলিপি (শিলালিপি ও তাম্রশাসনসহ) হয়তো সাইনবোর্ডের দূরাগত আদি রূপ। লক্ষণীয় সৌধ বা মন্দির লিপিগুলি অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভাব্য নিরক্ষর সৌধ-নির্মাতাদের হাতেই অক্ষরের ছাঁদ অনুযায়ী লিখিত হতো। কিন্তু খুব সীমিত ক্ষেত্রেই নির্মাতাদের কারও পরিচয় জানা যেতো। মুখ্যত পম্পেই ও হেরকুলেনিয়াম নগরদুটির উদাহরণের ব্যাপকতা থেকে এই সিদ্ধান্ত করেছেন : ‘আমরা এইভাবে উপসংহারে আসতে পারি যে, আমাদের পূর্বপুরুষরা রোমানদের কাছ থেকে সাইনবোর্ড গ্রহণ করেছিলেন। ‘যদিও এমনটা মনে করা যেতে পারে যে, পম্পেইয়ের মতো নগরগুলি ছাড়া সেকালের সমগ্র রোমে এত বেশি দোকান ছিল না যে আলাদা করার জন্য একটি ছবির প্রয়োজন ছিল।’ যেমন : খোলা দোকানের সামনের অংশে যে ব্যবসা চলছে তা নির্দেশ করার জন্য কোনও প্রতীকের প্রয়োজন ছিল না, তবে রাস্তার পাশে সরাইখানা এবং শহরেও, নিঃসন্দেহে তাদের জন্য, ওয়াইন বিক্রির ইঙ্গিত দেওয়ার জন্য চিরসবুজ রোমান গুল্ম ছিল; এবং নিঃসন্দেহে বিভিন্ন শ্রেণীর পথযাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু ডিভাইস গ্রহণ করা হতো, যেমন : খ্রিস্টান গ্রাহকদের জন্য ক্রুশ এবং পৌত্তলিকদের জন্য সূর্য বা চাঁদ। কিন্তু তারপরও, যতক্ষণ সভ্যতা কেবলমাত্র তথাকথিত মুনাফা-গর্বে উন্মত্ত হয়ে ওঠেনি এবং যতদিন প্রতিযোগিতা ছিল তুচ্ছ, ততদিন পর্যন্ত অনুচ্চকিত, সহজ  লক্ষণগুলিই কাজে লেগেছিল। কিছু বস্তু, যার বাণিজ্য করা হতো, তার চিহ্নই ছিল যথেষ্ট―কাটলারের জন্য একটি ছুরি, হোসিয়ারের জন্য পা-ঢাকা একটি স্টকিং বা মোজা, দস্তানা-নির্মাতার জন্য একটি হাত, দর্জির জন্য এক জোড়া কাঁচি, মদ্যবিক্রেতার জন্য একগুচ্ছ আঙ্গুর, স্যাক্সন-ডেন বা ব্রিটিশদের রীতিনীতির সঙ্গে কাপ খাইয়ে নিতে বিভিন্ন ধরনের প্রতীক বা মানদন্ড…ইত্যাদি। এগুলি ছিল জনসাধারণের প্রয়োজনীয়তার সম্পূর্ণ উত্তর। এমন-কী শহরের পথপার্শ্বস্থ সরাইখানা বা পানশালার অবস্থান এবং মদিরা বিক্রয় নির্দেশ করার ক্ষেত্রেও রোমানরা এগিয়ে ছিলেন। সেখানে ব্যবহার করা হতো চিরহরিৎ রোমান গুল্মের ছবি, কোথাও-বা আঙুর গুচ্ছের স্কেচ ( ‘দেয়ার ওয়াজ দি রোমান বুশ অব এভারগ্রিনস টু ইণ্ডিকেট দি সেল অব ওয়াইন’)।

(ক্রমশ)

…………………………………..

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, ই-সূত্র থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply