কাশীর অলি-গলি : ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি। পর্ব ৩। শোভন সরকার

0
গত পর্বে: অবসরপ্রাপ্ত সেই শিক্ষিকার কাছে জানলাম কালভৈরবের উৎপত্তির কথা, কাপালিকদের কথা। উঠে এল শৈব ও বৈষ্ণবদের ধর্মীয় রাজনীতির প্রসঙ্গ, মচ্ছোদরীর ইতিহাস।

ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি একাই থাকেন?’

‘বলতে পারো। রান্নার লোক আছে একজন, সবিতা। আর প্রত্যেক সপ্তাহে ছেলে আসে লখনৌ থেকে, ওখানেই চাকরি।’

‘একা লাগেনা?’

‘ঠিক ততটা নয় তোমরা যতটা ভাবছ। যেমন এই দেখো না, আজকে তোমাদের সাথে দেখা হয়ে গেল, কালভৈরবের গল্প শুনতে চাইছ, ওসব একা লাগা-টাগা টিকে থাকে কী করে বল?’ 

হেসে বললেন ভদ্রমহিলা। তবে তাঁর হাসিতে কোথাও একটা মলিনতা মাখা কি? নাকি আমি বেশি ভেবে নিচ্ছি? সাদা শাড়ি দেখে মনে হয় উনি বিধবা। জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হয়। মনে পড়ল কাশীর সঙ্গে বাঙালি বিধবাদের কত পুরোনো সম্পর্ক। বাংলা সাহিত্যের কত বিধবা চরিত্র প্রথা অনুযায়ী কাশীতে এসে বসবাস করেছে, নিজেদের ছাপ রেখে গেছে! আবার বিভূতিভূষণের দ্রবময়ী বা রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনীর মত অন্যধারার বিধবাও দেখি যাঁরা প্রচলিত সংস্কারকে ভেঙে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন নিজেদের মত করে। কাশীতে এসে যাঁর সঙ্গে দেখা হল, তিনি এই স্বল্প পরিচয়ে এখনও আমাদের কাছে অবোধ্য, অধরা। তবে আমার জানার ইচ্ছে হচ্ছে তাঁর গল্প। জানতে চাইলে নিশ্চয়ই বলবেন। থাক না হয় আজ। উনার কালভৈরবের গল্প এখনও বাকি। অন্য একদিন না হয় আবার আসব। আসবই। শুনব উনার কথা, কাশীর বিধবাদের কথা। 

আমার ভাবনার কুয়াশা মিলিয়ে গেল উনার স্বরে, ‘এবার তোমাদের প্রশ্নের উত্তর দিই? কালভৈরবই প্রথমে কেন? দেখ, কাশীর ধর্মবিশ্বাসী মানুষের উপর কালভৈরবের গুরুত্ব প্রবল। পুরাণে বলা হচ্ছে শিব কাশীর সমস্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব তাঁর হাতেই সঁপে দিয়েছেন। কাশীর আইন-শৃঙ্খলার সব দায়িত্ব কালভৈরব দণ্ডপাণির সাহায্যে পালন করেন। এজন্য এখানে সবাই তাঁকে বলে কাশীর কোতোয়াল। মন্দিরের কাছেই বিশ্বেশ্বরগঞ্জে রয়েছে কোতোয়ালী এলাকা, সেখানে থানার মূল আসনে কালভৈরবের প্রতীক, থানার দারোগা বসেন পাশে। এখানে সবাই বিশ্বাস করে যে কোন আধিকারিক এখানে বদলি হয়ে বা নতুন এসে যদি কালভৈরবের কাছে নিজেকে সমর্পণ না করে, তাঁর অনুমতি প্রার্থনা না করে, তবে তার সমস্ত কাজ বিঘ্নিত হয়। এই জন্যই বিশ্বাস করা হয় যে কাশীতে এসে প্রথমে যদি কালভৈরবের অনুমতি না নেওয়া হয়, তবে কাশীবাস বা বিশ্বনাথ দর্শনের ফল লাভ হয়না। উনার অনুমতি সাপেক্ষেই কোন ব্যক্তি কাশীতে থাকতে পারে, নইলে অনতিকালেই তাকে কাশী থেকে বিতাড়িত হতে হয়। কালভৈরবের উপস্থিতিতে মৃত্যু বা কালের প্রবেশ কাশীতে নিষিদ্ধ। চিত্রগুপ্ত এখানে তাঁর হিসেবের খাতা রাখেননা, কারণ এখানে তাঁর কোন অধিকারই নেই। কাশীর মানুষের ভরণ, পাপ-পুণ্যের বিচার, ভৈরবী যাতনায় শাস্তিবিধান — এই সমস্ত কিছুর দায়িত্ব এই কালভৈরবের উপরেই ন্যস্ত। ’

এই প্রসঙ্গে রিচার্ড লেনয় তাঁর বইতে ‘ইনানশিওড্রমিয়া’ (Enantiodromia) বলে এক পরিভাষার (মূল ধারণা গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাসের) কথা উল্লেখ করছেন। সহজ কথায় এই পরিভাষা বলে যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শক্তির বিপরীত শক্তি আবির্ভূত হয়, এবং আবশ্যিকভাবে এর একটা মেটামর্ফোসিস বা রূপান্তরণ হয়, সাম্যের প্রতিষ্ঠা হয়। ব্যাপারটা অনেকটা যেন চীনের তাওবাদের ‘ইন ও ইয়াং’-এর রূপভেদ। লেনয় সাহেবের মতে এই ক্ষেত্রে কালভৈরবের আবির্ভাব হয় এক ভীষণ কাজের মাধ্যমে, একজন ধ্বংসকারী হিসেবে। কিন্তু সময়ান্তরে পাপমোচনের পর সেই কালভৈরবের ভাবমূর্তি রূপান্তরিত হয়, তাঁকেই দেওয়া হয় কাশীর ত্রাতা, রক্ষাকর্তার দায়িত্ব। 

‘আমি কিন্তু এখানে মিথ মেকিং-এর একটা প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি, দিদা’, শেখর বলল। 

‘দেখ, সেটা অসম্ভব নয়। তোমরা শিক্ষিত, পড়াশোনা করছ। এটা নিশ্চয়ই জানবে যে মিথ বা গল্পই মানুষকে জুড়ে রাখে। তাই সমাজবিজ্ঞানে মিথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। সমাজ বিবর্তনের সাথে সাথে যখন মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল, মিথ মেকিং-ই সেখানে ত্রাতার ভূমিকা পালন করল। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। বহু পারস্পরিক অজানা অচেনা মানুষ একত্রিত হয়ে একই কাজ করতে পারে, একে অন্যের জন্য জীবন দিতে পারে। কীভাবে সেটা সম্ভব? সম্ভব হয় কোন এক সর্বজনীন মিথের উপর তাদের বিশ্বাসের দৌলতে। তা সে যতই বিমূর্ত বা অ্যাবস্ট্রাক্ট ধারণা হোক না কেন, তার চেয়ে চরম বা সত্য বলে তাদের কাছে কিছুই নয়। আর সত্য তো আপেক্ষিক, তাইনা?’

আমার মনে পড়ে গেল স্কুলের বইতে পড়া শিবরাম চক্রবর্তীর ‘দেবতার জন্ম’ গল্পটি। আবার একই রকমভাবে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘দেবী’ গল্প। দুই ক্ষেত্রেই সেই মিথ মেকিং-এর প্রচেষ্টা। 

ভদ্রমহিলা বলতে থাকেন, ‘কাশীতে কালভৈরবের উপস্থিতি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রযুক্তি হিসেবে কাজ করে। মানে সোজা কথায়, কোন এক ধর্মবিশেষের কাছে কাশীর আঞ্চলিক সংস্কৃতি বা সমাজের পরিকাঠামোর এক পরিচালন শক্তির প্রতীক এই কালভৈরব। একটা সময় পর তাই কালভৈরব শুধুমাত্র এক মিথের বাইরে বেরিয়ে এসে স্থানিক সত্যে পরিণত হয়েছে। ‘প্লাসিবো এফেক্ট’ এর মত ব্যাপারটা — সেই যে বলে ‘বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহুদূর’, ঠিক সেটাই। কালভৈরবের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে বহু মানুষের ‘কালেক্টিভ মেমোরি’ বা সঙ্ঘবদ্ধ স্মৃতি, আত্মপরিচয়ের নিশ্চয়তা, এবং কাল বা সময়ের অন্তরালে হারিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতীকি লড়াই। তাছাড়া আমার মনে হয়, মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাই হল বিশ্বাস করা, মান্য করা। কোন কিছু অমান্য বা অবিশ্বাস করতে গেলে মানুষকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, ভাবতে হয়। আর আমরা তো কোন কিছু পেতে গেলে সহজতম পথটাই বেছে নিই, তাইনা?’ 

এবার উনার কথা আমার মাথার উপর দিয়ে যাওয়া শুরু করল। এত খটমট কথা উনি বলছেন যে সেই সব আমার বুদ্ধির পরিসীমার বাইরে রয়ে গেল। ভাগ্যিস শেখর এবার অন্য একটা প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা দিদা, আপনি ‘ভৈরবী যাতনা’ বলে একটা কথা বললেন। সেটা ঠিক কী?’ 

‘সেও এক মজার ব্যাপার। কাশীতে যাদের মৃত্যু হয়, তাদের উপর যমরাজার কোন হাত নেই। যমের প্রবেশাধিকার কাশীতে নিষিদ্ধ সেটা আগের কথায় বুঝেই গেছ। তাহলে কাশীতে যারা অন্যায় করে তাদের শাস্তি হয়না? হয়। কালভৈরবই সেই দায়িত্ব পালন করেন। ‘কাশ্যাম্‌ মরণম্‌ মুক্তিঃ’ অর্থাৎ কাশীতে মৃত্যু হলে আত্মার মুক্তি হয়। কিন্তু জীবিতকালে কৃত পাপের কারণে মুক্তির পূর্বে আত্মার শোধনের প্রয়োজন। কর্মফলের কনসেপ্টটা ঠিক এখানেই গুরুত্বপূর্ণ। কর্ম করলে তার ফল তো ভোগ করতেই হবে — এরকম এক বিশ্বাস আছে। কর্মফল হিসেবে কাশীতে মৃত মানুষদের কালভৈরবের হাতেই অত্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য ঘনীভূত শাস্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয় — অসহনীয় যন্ত্রণা কিন্তু সামান্যতম সময় ধরে।’

‘ফ্রাঙ্ক হার্বার্টের ‘ডিউন’ বইয়ের গম জাবার টেস্ট-এর মত ব্যাপারটা মনে হচ্ছে। মানুষ খাঁটি কীনা সেটা প্রমাণ করার ব্যবস্থা। সামান্য সময়ের জন্য প্রবল যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এই টেস্ট-এ। আবার দেখুন বিবেকানন্দের বলা সেই গল্প যেখানে নারদ জল আনতে গিয়ে বহু বছর মায়ায় ভুলে রয়ে যায়। কিন্তু যখন মায়া থেকে মুক্ত হয়, সে খেয়াল করে কেবল কয়েক মুহুর্ত মাত্র পেরিয়েছে, যেন এই স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছে,’ আমি বললাম। 

‘ঠিকই, বলতে পার সেরকমই, তবে তীব্রতর রূপে। কালভৈরবের এই বিশেষ শাস্তিকেই ‘ভৈরবী যাতনা’ বলা হচ্ছে।’ 

‘তাহলে কি দিদা কাশীতে মৃত্যু হলে সরাসরি স্বর্গপ্রাপ্তি — এই ধারণাও একটা মিথ?’ শেখল বলল।

‘ঠিক তা নয়। এই নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। যেমন ধর একটা মত বলছে যে কাশীর ‘কেদার খণ্ডে’ অতি পাপীরও মৃত্যু হলে তাকে কোন শাস্তিই পেতে হয়না। বাকিদের ভৈরবী যাতনা ভোগ করতে হয়।’ 

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেদার খণ্ড আবার কী?’

ভদ্রমহিলা এবার হেসে উঠলেন। উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘আজকে আর নয়। এ কি এক দিনে বলে শেষ করার ব্যাপার! তাছাড়া রাত হয়ে আসছে। খাবার আগে। গল্প না হয় অন্য আরও একদিন করা যাবে।’

তখনই শেখর আর আমি চোখের ইশারায় প্ল্যান করে ফেললাম যে শিগগিরিই আবার এখানে আসতে হবে। কী ভাগ্যেই আজ রাস্তা হারিয়েছিলাম!

(ক্রমশ)

পরবর্তী পর্ব

Disclaimer
The views and opinions expressed in this series are solely those of the author and do not represent the views, policies, or positions of any organisation, institution or society of any kind or the government. The content of this series is written in the author’s personal capacity and does not reflect any official information or stance.

Author

Leave a Reply