কাগজের নৌকো। পর্ব ২০। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর
নটরাজ হোটেলে পয়সা মিটিয়ে পথে নেমে দেখি, হনহন করে হেঁটে চলেছে দুলাল, দুলাল বিশ্বাস, কাঁধে একটা বড়ো ঝোলা, শান্তিপুরে হেলা বটতলায় বাড়ি, খুব যোগাযোগ না থাকলেও পরিচয়ের ক্ষীণ সুতোটি তখনও ছিন্ন হয় নাই, গলা তুলে ডাকলাম, ‘দুলাল, অ্যাই দুলাল!’
ডাক শুনে আমাকে দেখে অবাকই হল বেশ, কাছে এগিয়ে এসে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল, ‘আরে! তুমি এখানে?’
আমিও হাসলাম, ‘আমি তো আজকাল এখানেই থাকি রে! তুই হন্তদন্ত হয়ে কোথায় চললি?’
‘আরে, এখানে একজন আমার কাস্টমার আছে!’, কাঁধের ভারী ঝোলাটি দেখিয়ে বলল, ‘ফুটপাতে পুরনো বই বিক্রি করে, তা আমি তাকে বই সাপ্লাই দিই। এরকম আরও কিছু বাঁধা দোকান আছে, ক’টা টাকা হয়!’
বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পুরনো বই সাপ্লাই দিস? আর তোর সেই সেলসের চাকরি?’
মেঘছায়াতলে ম্লান হাসি ফুটে উঠল দুলালের মুখে, ‘সে চাকরিও আছে! তবে তাতে কী আর সংসার চলে, জানো তো সবই! ছেলে বড়ো হচ্ছে, ইস্কুল, মাস্টারের খরচ, যেভাবে পারি দুটো পয়সা রোজগারের চেষ্টা না করলে আর চলে না!’
দুলাল বিশ্বাস-মলিন পোশাক, ক্লান্ত মুখে জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটি, সহসা বাতাসে দুলে ওঠা জগতের টানে মনে পড়ল স্মৃতিপটচিত্রের মতো কত কথা, একবার বছর চারেক আগে দুলালকে সঙ্গে নিয়ে জয়রামবাটি গেছিলাম, এমনি ঘুরতে, দিন দুয়েক বোধহয় রাত্রিবাসও হয়েছিল, কত যে আখ্যান মানুষের-ভবহাটে টলোমলো পায়ে তারা বারবার আমার কাছেই শুধু ঘুরে ফিরে আসে।
বছর চারেক আগের কথা, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, একটি নির্জন পথে হাঁটছি আমি আর দুলাল। জয়রামবাটির মাতৃমন্দির আমোদর খাল পার হয়ে প্রায় এক মাইল চলে এসেছি, দুপাশে কার্তিকের কুয়াশাফোটা জগত, মন্দ মন্দ বাতাসে নূতন ধানের তিরতির সুবাস ভাসছে, পশ্চিমাকাশে অস্ত আলোর অলঙ্কার-সেদিকে পানে চেয়ে দুলাল মলিন গলায় বলল, ‘আর ভাল্ লাগে না বুজলা!’
অনেকদিন আগে কলকাতার মেসে আলাপ হয়েছিল, নদীয়ার ছেলে, আমার থেকে বয়সে চার-পাঁচবছরের ছোট, ভারি নরম স্বভাব, ওই কাঁচা বয়সে বাড়ি ছেড়ে হইহই মেসেই আমরা ভেবেছিলাম জীবন কেটে যাবে-কিন্তু তা তো হওয়ার নয়, অল্প বয়সের মায়াঞ্জন বেলা বাড়লেই খর রক্তচক্ষু হয়ে ওঠে! অন্য সবার সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এলেও কী জানি কেন দুলাল আর আমার সম্পর্কটি আলগা সুতোর মতো রয়ে গেল, এ বড়ো বিচিত্র নিয়ম, ভবহাটে কোন্ সম্পর্ক যে থাকবে আর কোনটি মুছে যাবে তা বোঝা ভারি মুশকিল।
পয়সাকড়ির দিক থেকে তেমন কিছু করে উঠতে পারেনি, খুবই সাধারণ একটি চাকরি-নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসার, দুটি ছেলেমেয়েও হয়েছে, চোখের নিচে গাঢ় কাজলপারা কালি, গতকাল ফোন করে এসব সাত-পাঁচ অভাবের কথা বলছিল, আমিই বা কী করব, পয়সাকড়ির সাধ্য তেমন নাই, তা বললাম, ‘চল্ দুটো দিন আমার সঙ্গে ঘুরে আসবি!’
দুলাল এককথায় রাজি, কোথায় যাব অবধি জিজ্ঞাসা করল না, আসলে মানুষ সমস্যা থেকে দূরে বেড়াতে যেতে বড়ো ভালোবাসে!
দু-একটি তারা ফুটে উঠছে আকাশে, এখন শুক্লপক্ষ, অল্প সময়ের মধ্যেই পরমা প্রকৃতির করুণার মতো চন্দ্রদেব পুব আকাশে উদিত হবেন-তবে দুলালের এসব দিকে তেমন মন নাই, সেটিই স্বাভাবিক, আমি হালকা সুরে শুধোলাম, ‘ভালো লাগে না কেন? আবার ধার করেছিস বাজারে?’
—কী করব বলো, সংসারে শুধু দ্যাও দ্যাও, চাল আচে তো নুন নাই, নুন আচে তো ডাল নাই! কী করব!
—কেন তোর মাইনের টাকা?
দু-এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘মাইনার ওইটুকুন টাকায় কী চলে! চারখান প্যাট! আর টাকা দশ হাজার! বাড়িওলা তিন হাজার, তাও দুমাসের বাকি পড়ছে, উটতে বসতে তাগদা!
—তোর বড়ো ছেলেটা ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে না?
—হুঁ, সরকারি ইস্কুল বলি বাঁচা, তাও আজ খাতা পরশু ডেরেস, তারপরদিন অন্য কিচু, হাজার বায়না, বুজলা দাদা, হাজার বায়না! সংসার মানুষে করে!
আদিগন্ত প্রান্তরে সন্ধ্যাদেবী তাঁর রেশম বস্ত্রের মতো কুয়াশার আঁচল পেতে বসেছেন, দূরে টুপটুপ আলো-গৃহস্থ উঠানের প্রদীপ, কোথাও মৃদু সুরে শাঁখ বেজে উঠল, ঝোপের মাথায় সাদা ফুলের কী বাহার, বামদিকে বাঁশবনে একমুঠি জোনাক পোকা আপনমনে খেলা শুরু করেছে, একটি গোরুর গাড়ি আমাদের পার হয়ে কাঁচাপথে নেমে গেল-হেমন্তিকার এমন রূপ দেখলে চোখ জুড়িয়ে আসে, এই রূপও সত্য আবার দুলালের গঞ্জনার জীবনও সত্য, অথবা দুটিই অলীক মায়া, কী জানি!
কয়েক মুহূর্ত পর বললাম, ‘পীরিত করেই তো বিয়ে করেছিলি, তাহলে এখন এসব কথা বলে লাভ আছে! আচ্ছা, মাধবী কী একটা কাজ করতো না?’
কার্তিক দ্বিপ্রহরের ছায়াচ্ছন্ন রৌদ্রের মতো হাসল দুলাল, ‘সে কোনকালে, ছেলাপিলা হওয়ার পরে কবে ছেড়ে দিছে।’
মন্থর পায়ে দুজন হাঁটছি, আমার মন পড়ে রয়েছে জ্যোৎস্না পানে, দুধ আলোয় কুন্দকুসুমের মতো অস্ফুট জগত বড়ো প্রিয়, কেমন অতীত আখ্যান হয়ে সে জেগে ওঠে, কতদিন দেখি নাই। হঠাৎ দুলাল জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্চা, তেলাভোলার মাট ইদিকেই, নয়?’
প্রসঙ্গ বদলে যাওয়ায় সামান্য অবাক হয়েই শুধোলাম, ‘কেন বল্ তো?’
বালকের মতো হাসল দুলাল, ‘না সেই ডাকাত দেখা পাইচেল, আর আমি তো কোনও অন্যায় করিনি, কারোর পইসা মারিনি জীবনে, সতপতে রইচি, তুমি তো জানো! কত দু নম্বরি লোক ক্যামন সুকে আচে আর যত অভাব শুদু আমার বেলা? উটতে বসতে খোঁটা দেয় লোক, মাধবীর খরখরে কতা তো শোনোনি, মুকে অন্ন উটবে না।’
শেষদিকে চৈত্র বাতাসের মতো করুণ হাহাকারে ভরে উঠল দুলালের কণ্ঠস্বর, পরিবেশ লঘু করার চেষ্টায় কৌতুকের সুরে বললাম, ‘তাঁর দেখা পেলে এই নিয়ে অভিযোগ জানাবি বুঝি?’
—নাহ! ওসব করি কিচু হয়না গো! দ্যাকো মন্ত্র নিলাম, জপ করি, তাও কি অভাব যায়! গুরু মহারাজের কাচে একদিন সব বলতে যেচি, তা এত ভিড় যে ওসব বলব কী, পনাম করে ঘর চলে এলাম!
একটি শীর্ণ নালার উপর পথটি সামান্য উঁচু হয়ে চলে গেছে দূরে, এপলক দেখলে মনে হয় কোনও রমতা সাধু সাপি নিয়ে প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যা ভুবনে হারিয়ে গেছেন, যাত্রাপথের দুপাশে মধুসুরের শব্দে জেগে উঠেছে মলিনবসনা হেমন্ত, সামনে একখানি বাধানো বটতলা দেখিয়ে দুলালকে বললাম, ‘আয় একটু বসি!’
একখান বিড়ি নিজে ধরিয়ে আমাকেও দিল, বেশ স্বাদ, কড়া তামাক। দু-এক মুহূর্ত পর বললাম, ‘একটা কথা দুলাল, তুই যখন মন্ত্র নিয়েছিলি তখন কি তোর গুরু মহারাজ বা মা কাগজে লেখাপড়া করে বলেছিলেন, যে তোর কোনও অভাব কখনও থাকবে না?’
মাথা নিচু করে বিড়ি টানছে, নতুন ধান আর কুয়াশা সুবাসে মিশে যাচ্ছে তামাকের ঘ্রান, আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী রে বলেছিলেন?’
নিঃশব্দে মাথা নাড়ল দুলাল।
‘তাহলে? এখন এই কথার কোনও মানে হয়?’
আমার দিকে শুকনো চোখে শুধোল, ‘তাহলে সাদুর কাচে আসি কী হবে? কোথাও একটুও ছায়া পাব না?’
মৃদু হেসে বললাম, ‘সাধু তো তোর ছেলের ইস্কুল, ভালো চাকরি, বউয়ের খুশি, মান যশ কিছুই দিতে পারবে না দুলাল। সে কিছুই পারে না। শুধু কী পারে জানিস?’
—কী?
—নিঃসঙ্গতা দিতে পারেন আর এই ভবহাটের কিচিরমিচিরের মাঝে ঈশ্বর কথা কইতে পারেন! তিনি চন্দনগন্ধী মলয় বাতাসের মতো ঈশ্বরকথা বয়ে আনেন!
আধপোড়া বিড়ি ছুঁড়ে নালার জলে ফেলে তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘ও দিয়ে কী হবে? গায়ে মাখব না মাতায় দেব? ছেলের দুদ কেনার পইসা না তাকলে ওই মলয় বাতাস না কী বললে ও দিয়ে কী হয় দাদা?’
সহসা উত্তরপথগামী বাতাসে ভর করে চন্দ্রদেব উঠে এলেন পূর্বাকাশে, মুহূর্তে ফিনফিনে প্রজাপতির পাখার মতো আলোয় আদিগন্ত ধানক্ষেত মায়া তরণীর মতো দুলে উঠল, কুয়াশাবৃতা জগত এখন আর অস্পষ্ট নয়-আবার স্পষ্টও নয়, যেন আমাদের সহস্র জন্মের দ্বিধা।
মলিন গলায় বললাম, ‘ওসব কিছুই হয় না রে দুলাল, শুধু তুই এই অপমান লাঞ্ছনা অভাবের দুনিয়ার মাঝে দাঁড়িয়েও অবিচল থাকবি আর খুব পরিশ্রমের শেষে অর্থ উপার্জন করে দায়িত্বের চৌকাঠে রেখে দিয়ে আপনমনে ঝলমল করে উঠবি! আনন্দ, হ্যাঁ, এই জ্যোৎস্নার মতো আনন্দে দেখবি টলমল করবে মন!’
বেশ কিছু সময় চুপ করে থাকার পর দুলাল সংশয়ী কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘ সত্যি আনন্দ পাব?’
হাসলাম আমি, ‘পাবি! সাধুসঙ্গ থেকে পাওয়া নিঃসঙ্গতাই তোর বর্ম হবে। বউ বল্ ছেলে মেয়ে বন্ধুবান্ধব বাপ মা-যার কথাই ধর্ ,কে তোকে ভালোবাসে দুলাল? কেউ না! এই জানাটুকু হয়ে গেলেই দেখবি কী আনন্দ! ন্যাংটার নাই বাটপাড়ের ভয়!’
—আর অভাব?
—ও তো আসবে যাবে! ভয় কী! আমরা দুহাতে সমস্ত অনাদর আর অপমান সরিয়ে এখানেই বাঁচব, কোথাও পালানোর দরকার নাই! এই তো আমাদের পুজোর ঘর! যম জিনিতে যাব আমরা, ভয় কী!
গহিন নিশীথে কৌমুদী-কুসুমাস্তীর্ণ ফেরার পথে দেখি এক চাষী বাড়ির উঠানে নতুন গুড় জ্বাল দেওয়া হচ্ছে, কী মধুর সুবাস, অদূরে মাতৃমন্দির, গুড়ের কড়াইয়ের দিকে দুলালকে ইশারা করে বললাম, ‘দ্যাখ, কেমন ফ্যানা তুলছে, ওই ফ্যানা কেটে গেলেই নিচে টলটলে গুড়!’
বালকের দুধ চোখে ভেসে ওঠা জলছবির মতো হাসল দুলাল।
সেদিনের মতোই আজও দুলালের মুখে অস্ফুট জোৎস্নার মতো হাসিরেণু লেগে রয়েছে, আমি পথের একপাশে ওকে টেনে এনে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানে তোর কাস্টমার কি শঙ্কর ব্যানার্জী?’
অবাক হয়ে শুধোল, ‘তুমি চেনো?’
কিছু না বলে পকেট থেকে চারমিনার বের করে দুলালের দিকে একখানি এগিয়ে দিয়ে মৃদু হাসলাম, ‘আজ শঙ্করদা মেঘ দেখে দোকান পেতে বসেন নি, চল্, তোকে ওঁর বাড়ি নিয়ে যাই!’
সেদিন শঙ্করদা’র ঘরে বেশ গল্প জমে উঠেছিল, দুলালও অনেকদিন পর সঙ্গলোভে রাত্রি অবধি বাড়ি ফিরে যায়নি-আসলে ওর মতো মানুষ এই জগতহাটে এত সস্তা যে কেউ বড়ো একটা খেয়াল করে না! আমার হাতে টাকা-পয়সা থাকায় সন্ধ্যাবেলায় মুরগি, ভালো সরু চাল,মশলাপাতি, সর্ষের তেল কেনা হল, শঙ্করদা কষিয়ে মাংস রান্না করলেন-যেন অবিকল সেই কীর্তনখোলা বালুচরে চঞ্চল কিশোরদের চড়ুইভাতি, সঙ্গে কত গল্প-শক্তি চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে পিকিং রেডিও, উত্তাল সত্তরের দিনরাত্রি, কবিতার পুরাতন আখর, কত গুমখুন, গোপন অস্ত্র, চোখের সামনে একেকটি আখ্যান থেকে নিঝুম পৌষ সন্ধ্যায় জন্ম নিচ্ছে নতুন কাহিনী, তাদের পাখায় তখন হাসিঠাট্টা, অভিমান, বেদনা আর অশ্রুচিহ্ন, কলকাতা নগরীর একপ্রান্তে পল্লীশ্রী কলোনির অপরিচ্ছন্ন টিনের চালের একফালি সংসার মুছে ধীরে ধীরে অলীক জাদুমন্ত্রের মতো জেগে উঠছে পুরাতন ভদ্রাসন, নয়না গ্রাম, কীর্তনখোলার বাতাস, সন্ধ্যা প্রদীপের ছায়াতলে শেষবারের জন্য এসে জড়ো হয়েছে অস্পষ্ট কুয়াশার মতো যত চরিত্র-তাদের কারোর গৃহ নাই, প্রেম, সংসার, সন্তান, দুমুঠি ক্ষুধার অন্ন নাই, আমি অলক্ষে সবাইকে সদ্য উনান থেকে নামানো গরম ভাত আর এক আঁজলা লবণ থালায় যত্নে সাজিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, ‘এসো, মনখারাপ করো না, তোমাদের মতোই আমারও কোথাও ফিরে যাওয়ার নাই, সব পথ চর-মজিদপুরের রাত্রি-কুয়াশার আঁচলে লেগে থাকা অনান্মী নক্ষত্রের অস্পষ্ট সীমানায় হারিয়ে গেছে!’
এরপর ধীর পায়ে অলস কার্তিক অপরাহ্নের মতোই দিনগুলি চলে গেল অন্য কোনও অলীক ভুবনে,আমিও রোজগারের তাগিদে সেই মেস ছেড়ে চলে গেলাম আরও বৃহৎ সংসারের চৌকাঠে, শেষদিকে শঙ্করদার আর বিক্রি তেমন হত না, মোবাইল ফোন তখন সহজ হয়ে উঠছে প্রতিদিন-সেই ঝলমলে দুনিয়ার আহ্বান অগ্রাহ্য করে কে আর সন্ধ্যাবেলায় পুরনো বই কিনবে, ‘লাল নিশানের দিন’ আরও বৃদ্ধ হল, শঙ্করদাকে দেখেই বুঝতাম হাতে টাকা পয়সা কিছু নাই, জোর করে সাধ্যমতো পঞ্চাশ একশো টাকা পকেটে রেখে দিতাম, না বলার সামর্থ্য আর কই তখন বৃদ্ধের, পথের ম্রিয়মান আলোয়, চাঁপা গাছের তলে দু-এক বিন্দু তামাদি গোপন অশ্রু চোখে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলতেন, ‘তুমি, আমার মতোই উন্মাদ!’
কয়েক বছর পরে ও-পথে যখনই গেছি, দেখা করেছি, একইরকম চেহারা, পরনে মলিন বিবর্ণ ফুলহাতা জামা, ঢোলা অপরিষ্কার পাজামা, হাতে লাঠি, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে, মাথার চুলগুলি এই ক’বছরে কাপাস তুলোর মতো হয়েছে, ফুটপাতের উপর পলিথিন বিছিয়ে পুরনো শতচ্ছিন্ন বই নিয়ে একাকী প্রাচীন উদ্বাস্তু বসে রয়েছেন-দুপাশে যুবতির বিবাহ বাসরের মতো উজ্জ্বল শহর, ব্যস্ত মানুষজন, বৃদ্ধের দিকে ফিরে তাকানোর সময় অবধি কারোর নাই, হেসে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘সুনীলবাবুকে এখনও একবার ফোন করলেন না?’
উত্তরে শঙ্করদাও হাসলেন, ‘আমার ফোনের ভয়েই তোমাদের সুনীলদা তাড়াতাড়ি ও-পারে চলে গেল, বুঝলা না!’
তখন আর চারমিনার পাওয়া যায় না বাজারে, এমনি সস্তার সিগারেট পুরো একখানি প্যাকেট হাতে দিয়ে বললাম, ‘আর লাল নিশানের দিন? আমাকে তো এত বছরেও এক কপি উপহার দিলেন না!’
লাঠির উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তখন বোধহয় চৈত্র মাস, ঝিমঝিম মধু বাতাসের দিন, চাঁপা গাছ থেকে একটি রাত্রি কুসুম আপন খেয়ালে ঝরে পড়ল আমাদের মাঝে, আমার মুখের দু-এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ধীর স্বরে শঙ্করদা বললেন, ‘ও আর নাই, দশ কপি ছিল, ইঁদুরে কেটে একাকার করেছে! তবে খাতাটা আছে, একদিন এসো বাসায়, চলে যাওয়ার আগে তোমাকেই দিয়ে দেব।থাক, তোমার কাছেই থাক।’
তবে আর কখনও দেখা হয় নাই, কবিতার খাতাটিও পাইনি, পল্লীশ্রী কলোনির মুখে একদিন খোঁজ খবর করায় শুনলাম, দু বছর হল মারা গেছেন। বইয়ের বস্তা নিয়ে অন্ধকারে ফেরার পথে নর্দমার মুখে পড়েছিলেন, জ্ঞান ছিল না, আর এই ভবহাটে জ্ঞান ফিরেও আসেনি!
সন্তনাদি ছিল না, শঙ্করদার একফালি ঘরের জমির উপর মাথা তুলেছে মস্ত ফ্ল্যাটবাড়ি আর জলট্যাঙ্কের মোড়ে যেখানে পুরাতন বই নিয়ে বসতেন, সেখানে এখন অবাঙালি বিয়েবাড়ি গড়ে উঠেছে-বিয়ের দিন নকল ফুল দিয়ে সাজানো তোরণ দেখলে মনে হয়, বইয়ের দোকানের বদলে সংসারী এই শহরে এরকমই তো হওয়ার কথা ছিল!
নটরাজ হোটেলও আর নাই, তার বদলে ঝলমলে প্রসাধনের দোকানে এখন কী ভিড়, একপেট ক্ষুধা আর পকেটে সামান্য পয়সা নিয়ে আমার মতো ভবঘুরে লোকজন কোথায় খেতে যায় কে জানে, হয়তো নূতন কলিকাতা শহরে আর তাদের ক্ষুধার অন্ন পাওয়া যায় না!
শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেছেন, দুলালের সঙ্গেও বহুদিন দেখা হয় না, শুধু ওই পথে এখনও কোনও নির্জন দ্বিপ্রহর বা চৈত্র অপরাহ্নে হেঁটে গেলে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, ওই তো একখানি বড়ো বইয়ের দোকান, কী ভিড়, ক্যাশ বাক্সের সামনে আশ্বিনের মেঘের মতো পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বসে রয়েছেন শঙ্করদা, হাতে দামি সিগারেটের বাক্স, দোকানের কোনও কর্মচারীকে ডেকে বলছেন, ‘ওরে, লাল নিশানের দিন এখানে দু-কপি বিল করে দে বাবা!’
বাইরে জ্বলজ্বলে সাইনবোর্ডে রক্তাক্ষরে লেখা রয়েছে, শঙ্কর পুস্তকালয়!