কাফিরনামা । পর্ব ১। লিখছেন রাণা আলম
কলকাতা শহরের সবচেয়ে বিপদে বোধহয় কবিরা। তারা মে মাসের টাকফাটা গরমে ‘শীতকাল কবে আসিবে সুপর্ণা?’ বলে চিৎকার জুড়ে দ্যান, জুন মাসের বিকেলে কলেজ স্কোয়ারের আকাশে এক চিলতে মেঘ দেখলেই বৃষ্টি নিয়ে দুলাইনের পদ্য নামাতে শুরু করেন। আমরা, মাস মাইনের চাকুরেরা যখন ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির ওখানটায় এক কোমর কালো জল ঠেলে পার আপিসের দিকে হাঁটি, তখন তারা সোসাল সাইটে বৃষ্টিভেজা জানালার ফ্রেমে খিচুড়ি আর ডিমভাজার অশ্লীল ছবি পোস্ট করেন। আর কে না জানে, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম সওগাতের আপিস থেকে হাতিবাগানের দিকে যাওয়ার সময় আর্মহার্স্ট স্ট্রীটের জলের পাহাড়ের মত ঢেউ দেখেই লিখেছিলেন,
“দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তরও পারাবার হে…”। তাপ্পর একখানা ঠেলা রিকশাতে চড়ে বসেই লিখলেন,
“আমি ভীম ভাসমান মাইন”।
তা যাকগে, কলকাতার কবিরা ভরাবর্ষায় হেদোর জলে হাবুডুবু খান, ডুব সাঁতার দিন তাতে কিস্যু এসে যাচ্ছেনা যতক্ষণ না তারা আপনাকে উত্তর আধুনিক কবিতা লিখে আপনাকে শোনাতে আসছেন। অবশ্যি, বাঙালি এম্নিতেই জাত-কবি। আমাদের ডিএনএ তে কাব্যিরোগ লুকিয়ে আছে। বাঙালি কিশোর গোঁফ গজাবার প্রাক্কালে পাশের বাড়ির ছাদে কিশোরীকে চুল শুকোতে দেখে কবিতা লেখে। সাহস গজালে বারান্দার গ্রিল গলিয়ে প্রেমপত্র ফেলে আসে। তবে সচরাচর অধিকাংশ কিশোরকালের ডন জুয়ানই যৌবনকালে সেই কন্যার বিয়েতে কোমরে গামছা বেঁধে পাড়াতুতো দাদার রোলে জিজ্ঞেস করে,
“আর দুটো রসগোল্লা দিই?”
লিটল ম্যাগে বিপ্লব আনার চেষ্টায় বাঙালি ছাপাখানার ফর্মা বোঝে, খালাসিটোলায় উঁকি মেরে শক্তি-সুনীল হবার চেষ্টায় মাঝরাতে কলকাতার রাজপথে পুলিশের তাড়া খায়। সাধারণতঃ কবিতার দৌড় ওই আঠেরো-কুড়িতেই শেষ হয়ে যায়।তারপরও যারা টিঁকে থাকেন তারা কবিতাকে ভালোবেসে ফ্যালেন। তাদের কবিতায় জেগে থাকে ট্রামের সারি আর অর্ধেক চাঁদের আলো। সেই শব্দের মায়াময় ধূসর পথ ধরে হেঁটে চলেন জীবনানন্দ।
আর আমার মত যাদের পেটে ডুবুরি নামিয়েও কবিতার ‘ক’ খুঁজে পাওয়া যাবেনা, তারা রোজ বিকেলে আপিস ফেরতা ঘেমো জামায় বাসের জানালা দিয়ে উঁকি দ্যায় এক চিলতে আকাশ। শ্রান্ত চোখে ঝাপসা হয় আদুরে বিকেল। ক্যালেন্ডারে আমাদের বয়সের সংখ্যা বেড়ে যায় । গভীর রাত নামে নদীর চরে। শুধু ইঁটের দেওয়ালে লেখা আমাদের ফেলে আসা স্বপ্নের হিসেব মেলেনা।
তা না মিলুক, ধার বাকির হিসেব মেলানোর জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মাথায় জনাব শক্তিকান্ত তসরিফ গ্রহণ করেছেন। কিরম ম্যাজিক কালিতে বড়লোকেদের লোন সব ‘ভ্যা-নি-স’ হয়ে যায় সেটা ওনার কাছ থেকে শেখার আছে বৈকি।
ইয়ে, এসব পলিটিক্যাল কথাবার্তা লেখা দূরে থাক, মনে আনলেও নাকি আজকাল দেশদ্রোহী তকমা জুটে যাচ্ছে। সুতরাং, বাদ দিন স্যার। আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নিয়ে কি লাভ? মাস্টারি করে পেটের ভাত জোটে, তাই দু-চার কথা সেটা নিয়েই বলা যাক। নইলে, সম্পাদক মশাই গোঁসা করতে পারেন যে কি মশাই, দুটো সাদা পাতা আপনার জন্য ফাঁকা রাখলুম আর সেখানে বিস্তর বাজে বকে যাচ্ছেন। ডিজিটাল অপচয় কি অপচয় নয়? আমরা কি এরম কলমচি চেয়েছিলুম ইত্যাদি ইত্যাদি…
ফি-বছর ভর্তির সময় আমরা একটা দুটো ফোন পাই ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে। আর্থিক সমস্যাজনিত কারণে তারা ফোন করেন। যাতে ভর্তির টাকাটা কম লাগে। সেক্ষেত্রে, আমরা ফোনে তাদের বাবা-মায়ের সাথে কথা বলি তারপর সেটা রেফার করি। উত্তর কলকাতার যে পেল্লাই শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটায় আমি মাস্টারি করি তার একটা বড় অংশই হিন্দিভাষী। এদিকে গড়পড়তা বাঙালির হিন্দিতে দক্ষতা বেশ বাঁধিয়ে রাখার মতই। আমার প্রয়াত মাস্টার মশাই বৈদ্যনাথবাবু দিল্লীতে একটা কনফারেন্সে গিয়ে রেস্তোরায় শুধিয়েছিলেন,
“ভাত আছে হ্যায়?’
এই গর্বিত ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে আমার হিন্দি শুনলে গর্গ চট্টোঃ গর্ব বোধ করতেন। চাই কি কপালে একটা বঙ্গ-ভূষণও জুটে যেতে পারতো। নেহাত নিন্দুকদের জন্যই তা আর হল না।
এরমই এক সময়ে, এক হিন্দিভাষী ছাত্রীর ফোন। তার সাথে বলিউডি হিন্দিতেই বাতচিত হল। তাপ্পর জিগালুম যে তোমার মা কে ফোনটা দাও। ওপার থেকে ছাত্রীটি বললো,
“ও বাত তো ঠিক হ্যায় সার। পার মেরি আম্মিকো হিন্দি কে অলাবা আউর কুছ সমঝ নেহি আতা”।
এরপর থেকে ক্লাসের বাইরে বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলি।তারা কি বোঝেন সেটা খোদায় মালুম। এই সেমেস্টারে এক ছাত্রী ফোনে জানালেন যে তার আর্থিক সমস্যা আছে। বিপিএল নেই। ফলে কলেজে আর্থিক ছাড় পাওয়ার ক্ষেত্রে একটু সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া একদম শেষ মুহুর্তে তিনি জানাচ্ছেন।
বললাম, ‘বাবা কে ফোনটা দাও’।
ছাত্রীটি এক মুহুর্ত থেমে বললেন,
‘স্যার, বাবা কথা বলতে চাইছে না। লকডাউনে বাবার কাজ চলে গেছে। তারপর থেকে বাবা ক্যামন গুটিয়ে গেছে। কারুর সাথেই ঠিক করে কথা বলে না। আগে তো আমাদের এত অবস্থা খারাপ ছিল না’।
‘তোমাদের চলছে কি করে তাহলে?’
‘মা কাজ করেন স্যার। আর আমি ট্যুইশন পড়াই। আমার হাজার টাকা কম হচ্ছে স্যার। এইটুকু একটু ছাড় করে দেবেন? আমি না হয় পরে দিয়ে দেবো’। আর্ত গলায় কথাগুলো ভেসে এলো।
ফোনের এপারে চুপ করে কথাগুলো শুনছিলাম। প্রিভিলেজড পজিশনে থাকার যন্ত্রণা বোধ হচ্ছিল। বললাম,
‘তোমার অ্যাকাউন্ট নাম্বার টা দাও। ভর্তি নিয়ে ভাবতে হবে না’।
ভর্তির দুদিন পরে ফোন এলো। ছাত্রীটির কাছ থেকে। ওপার থেকে তিনি বললেন,
“স্যার, বাবা আপনাকে টাকাটা ফেরত দিতে বলেছেন’।
‘আরে ধুর, দিতে কে বলেছে? পড়াশুনো করো মন দিয়ে’।
‘না স্যার। বাবা সাহায্য নিতে চান না। টাকাটা আমরা যোগাড় করেছি। আপনি প্লিজ নিয়ে নিন স্যার’।
টাকাটা ফেরত নিলাম বাধ্য হয়েই। আমি সেই মানুষটিকে ভাবছিলাম। আমার ছাত্রীটির বাবাকে খুঁজছিলাম। বছর পঞ্চাশের আহিরিটোলার কোনো গলিতে থাকা সেই মানুষটি। লকডাউনে যিনি কাজ হারিয়েছেন। আর্থিক অবস্থা নেমেছে। হয়ত খুব কষ্ট করেই এই হাজার টাকা তিনি যোগাড় করেছেন। কিন্তু কারুর দাক্ষিণ্য নিতে চান নি।
মনে পড়লো, আমার পাশের পাড়ার বেসরকারী ক্ষেত্রে কাজ করা আরেকটি মানুষের কথা। কাজ হারিয়ে প্রচন্ড মানসিক চাপে পড়ে যিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন আট মাস আগে। অথবা, মাথায় কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় ফেরি করে বেড়ানো সত্তর বছরের সেই অসুস্থ বৃদ্ধের কথা, করোনা যার একমাত্র রোজগেরে সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে।
আমাদের শুকনো সরকারী পরিসংখ্যানে এই মানুষগুলোর কথা লেখা থাকে না। ঠান্ডা ঘরে দিস্তের পর দিস্তে কাগজ জমা হয়। প্রতিনিয়ত সরকারী নিয়নবাতির রোশনাই এর আড়ালে একটু একটু করে তৈরী হয় আরেকটা ভারতবর্ষ যেখানে খিদেটাই এরকমাত্র বাস্তব।
আমরা দেখতে চাইনা, তাই দেখতে পাইনা…
(ক্রমশ)
বাস্তব।
কলম চলুক।
চলমান ছবি
দারুণ হচ্ছে। আরও চাই