হাফ প্যাডেলের কাল । পর্ব ১৯। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

ঠাকুনানার হাসি-হাসি মুখ। বললেন, –একা একা এতদূর রাস্তা চলে আলি, ভয় লাইগল নাই?
বালক দোনোমনো – আসল কথা বলবে, না কি এই দামি মানুষটার কাছ থেকে বাহবা নিতে সেটা চেপে যাবে? বাহবার লোভটাই জিতে গেল। বালক বলল, –ভয় কীসের! আমার তো সব জানা। বাঁকুড়া স্টেশনে বাস থেকে নেমে টিকিট কাউন্টারে টিকিট কেটে ট্রেন আসতেই উঠে পড়লাম।
পচুবাবু মুচকি হেসে বললেন, –হিমাংশু তো বাঁকুড়া পর্যন্ত আস্যে তোকে ট্রেনে চাপাই দিয়ে ফিরে যাত্যে পাইরতক।
এই দাদাটিকে বিশ্বাস নাই, তাঁর মুচকি হাসি দেখে কেমন সন্দেহ হলো বালকের – তার মিথ্যা কথাটা তিনি কি ধরে ফেলেছেন! বালক যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তাঁর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে সঙ্গিসাথীদের সঙ্গে ভিড়ে যেতে চায়। কিন্তু দাদার প্রশ্ন আর শেষই হয় না। তাঁর ইস্কুল, হিমাংশুর কোয়ার্টার, তাঁর ডিউটি যাওয়া, ভলিবল খেলা – সব যেন তাঁকে এবেলার মধ্যেই জেনে নিতে হবে। ভাইদের মধ্যে এই হিমাংশুকে তিনি অন্যদের চেয়ে বেশি পছন্দ করেন বলে শুনেছে বালক। সেজন্যেই কি তাঁকে নিয়ে এত কথা? কিছুক্ষণ আগে তাঁদের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছেন পাঁচ নম্বর দাদা, অহিভূষণ। এবার তাঁর দিকে তাকিয়ে দুই নম্বর বললেন, –শুনছুস অহি, অর্ধুর কথাগুলো? একবারে শহরের লোকের মতো কথা বইলতে শিখে গেছে এই ক’মাসের মধ্যেই! আমাদে’ গাঁয়ের একটুও টান পাচ্ছু উয়ার কথায়?
বালকও শুনে অবাক হয়। সে নিজেই তো জানে না সে শহরের লোকের মতো কথা বলছে। তার অজান্তে কবে থেকে যেন তার কথা বলার ভঙ্গি, উচ্চারণ সব বদলে গেছে। আর তার বদলে যাওয়া বলন শুনতে মজা লাগছে বলেই এই দামি দাদা এতক্ষণ ধরে তাকে কথা বলিয়ে চলেছেন!
তাদের গাঁয়ে সকলের চোখেই বালকের দাম বেড়ে গেল। এক নম্বর, সে একা একাই কোন দুর্গাপুর থেকে বাড়ি চলে আসতে পেরেছে। দুই নম্বর, সে শহুরে কথাবাত্তা শিখে গেছে। বাড়িতেও তার খাতির বেড়েছে। সকালে ছা তাকে দুধমুড়ির বদলে দুধচিড়ে খেতে দিচ্ছেন। নইলে তেমন জলখাবার কেবল দামি দাদার ছেলেমেয়ে প্রণব আর পুষ্পর জন্যেই বরাদ্দ। দুপুরে মধ্যম গিন্নি বালকের জন্যে আলাদা করে দু-একটা ভাজাভুজির পদ বানাচ্ছেন। কয়েকদিন পর থেকে অবশ্য খাতিরে একটু একটু করে ভাঁটা দেখা গেল। বাড়িতেও, আবার সঙ্গিসাথীদের মধ্যেও। গাঁয়ের জল হাওয়া রোদ্দুরে তার চামড়া থেকে শহুরে চেকনাই খসে পড়ল।
এই সময় হঠাৎ মনে পড়ে যায়, গোস্বামীবাবু তাকে অঙ্ক বইয়ের অনুশীলনী থেকে রোজ অন্তত দশটা অঙ্ক করতে বলেছিলেন। এক মাস কেটে গেছে, একটা অঙ্কও করা হয়নি তো! বালক তাড়াতাড়ি মাথার মধ্যে একটা অঙ্ক তৈরি করে। এক বালকের গ্রীষ্মের ছুটি ৪৫ দিন। তাকে রোজ ১০ টি করে অঙ্ক করতে হবে। বালক প্রথম ৩০ দিনে একটি অঙ্কও করেনি। বাকি সময়ের মধ্যে সব অঙ্ক শেষ করতে হলে তাকে প্রতিদিন কয়টি অঙ্ক করতে হবে?
খাতা পেনের দরকার হলো না, বালক মনে মনেই উত্তর বের করে ফেলে। ৪৫ x ১০ / (৪৫-৩০) = ৪৫০/১৫ = ৩০।
দুপুরবেলায় গাছে গাছে চরে বেড়ানো বন্ধ করতে হলো বালককে। রোজ তিরিশটা করে অঙ্ক করে প্রতি দশটা অঙ্কের নীচে একটা করে পুরনো তারিখ বসিয়ে দেয়। এইটা করে তার কোনো অপরাধবোধ হয় না। উল্টে অন্য ধরনের একটা আনন্দ হতে থাকে। আর সেই আনন্দের উপর ভর দিয়েই বালক প্রতিদিন ঠিক ১০ টি করে অঙ্ক দিয়েই দেড় মাসের অঙ্কের খাতা ভরিয়ে ফেলে।
ছুটি ফুরিয়ে এল। ফেরার সময় এগিয়ে আসছে। বাড়িতে বালকের খাতির আবারও পূর্ণ মাত্রায়। কিন্তু কে নিয়ে যাবে বালককে? ইতিমধ্যে গোস্বামীবাবুর চিঠি জানিয়ে দিয়েছে বালকের একা আসার আসল গল্পটা। তাতে অবশ্য কারোর চোখে বালকের কৃতিত্ব কমে যায়নি, সেই কোন ওন্দা থেকে একা একা এসে গড়বেতা স্টেশনে নেমে বুদ্ধি করে রিকশা চেপে বাড়ি আসাটাও দশ বছরের বালকের পক্ষে কম গৌরবের নয়। এটা পচাই বাবুর কথা, সুতরাং এর অন্যথা অন্য কেউ যে ভাববেন তারও কোনো উপায় নাই।
তবে গৌরব ওই একবারই ভালো, ফিরতি পথে আর একবার বালককে সেই সুযোগ দেওয়ার কথা বাড়ির কেউ ভাবলেন না। কে যাবে কে যাবে কথাবার্তার মধ্যে লখু সকলের আড়ালে তার পিসিকে মানে বালকের মাকে বলল, –পিসি, আমি লিয়ে যাইত্যে পারি অর্ধুকে, আমার দুর্গাপুরটা দেখা হয়্যে যাইথক –
লখু মানে লক্ষ্মীকান্ত, বালকের বড় মামার বড় ছেলে। অনেক দূরে বালকের সেই মামারবাড়ি, গ্রামের নাম কেঁদবেড়্যা, জেলা বাঁকুড়া। বালক তাকে লখুনানা বলে ডাকে। তিনি ইস্কুল পাস করে গড়বেতার কলেজে পড়ছেন। সেখানে উকিলবাবুর মেসে থাকেন। কিন্তু তিনি বেশির ভাগ সময়েই বালকদের বাড়িতে থাকেন। ছুটির সময় নিজের বাড়ি যেতে বোধ হয় তাঁর ভালো লাগে না।
লখুনানার সঙ্গেই বালককে দুর্গাপুর পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো। রওনা হওয়ার সময় রাস্তার খরচ হিসাবে লখুনানার হাতে মধ্যম কত্তা দশ টাকা ধরিয়ে দিলেন। পচাইবাবু বললেন, –কাকাবাবু বড়ো অমিতব্যয়ী। অর্ধুর ভাড়া আর লক্ষ্মীকান্তর আসাযাওয়া মিলে ভাড়া খুব বেশি হলে পাঁচ টাকা। ছ’ টাকা কি সাত টাকা দিলেই বেশি হতো –
‘অমিতব্যয়ী’ শব্দটা সেই প্রথম শুনল বালক। মনে মনে কয়েকবার আওড়ে মুখস্থও করে নিল কিন্তু মানে কী? মানে বুঝতে খুব বেশি দেরি হলো না বালকের। রাস্তায় যেতে যেতে লখুনানার কাণ্ড দেখতে দেখতেই পরিষ্কার বুঝে গেল কাকে বলে অমিতব্যয়ী। গড়বেতায় ট্রেনে ওঠার আগেই চারটে প্যাড়া কিনলেন। বালক একটার বেশি খেল না, তার তখন খুব মন খারাপ। যত না বাড়ির লোকের জন্যে, তার চেয়ে বেশি খালবাঁধ, শিলাই নদী, জঙ্গলের ধারে ভালুকখুন্যার ফুটবল মাঠ, আমগাছ জামগাছের জন্যে। কান্না পাচ্ছে তার। আর কান্না চেপে দেখছে লখুনানা পরপর তিনটা প্যাড়া খেয়ে ফেললেন। বিষ্ণুপুর স্টেশনে ট্রেন থামতেই দু-ঠোঙা ঝালমুড়ি কিনলেন। বালককে একটা দিয়ে নিজে একটা খেলেন। ভেদুয়াশোলে এসে যখন দেখলেন বালক ঠোঙা নিয়ে বসেই আছে, তখন সেটাও খেলেন। তারপরে বাঁকুড়ায় নেমে ভেজিটেবল চপ, বাসে চেপে বেলিয়াতোড়ে মেচা সন্দেশ। বালক সেই প্রথম মেচা সন্দেশ খেল আর সেই সঙ্গে অমিতব্যয়ী শব্দের অর্থও আবিষ্কার করে ফেলল।
(ক্রমশ)

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আগরবাঁধ গ্রামে জন্ম। সরকারি দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে অবসর গ্রহণ করে এখন পূর্ণ সময়ের লেখক, সম্পাদক এবং তন্নিষ্ঠ পাঠক। বিচিত্র বিষয়ে সন্ধিৎসার স্মারক তাঁর লেখা স্মৃতিগদ্য, গল্প ও উপন্যাস। এর আগে আমাদের ওয়েবপোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর স্মৃতিগদ্য 'স্মরচিহ্ন'। যা পরবর্তীতে বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছে একপর্ণিকা প্রকাশনী থেকে। এছাড়া গত বছরে তাঁর সম্পাদনায় সুপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে 'বাঙালির পথঘাটের খাওয়া-দাওয়া'। এ বছর কলকাতা বইমেলায় সুপ্রকাশ থেকেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই 'গরিলার ঘরকন্না'।