হাফ প্যাডেলের কাল । পর্ব ১৬। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

(গত পর্বের পর)

এই রবিবার গোস্বামীবাবুর অফ ডে পড়েছে। বালকেরও স্কুল নাই। এফ টাইপ থেকে জি টাইপ কোয়ার্টারে পা দিল আশালতার সংসার। আগে ঢুকল মালপত্র। একটা মাত্র ঠেলাগাড়ি। তাতে চাপল একটা কাঠের তক্তপোশ, একটা দড়ির খাট, শতরঞ্চি দিয়ে বাঁধা বিছানাপত্র, আর বড়ো বড়ো তিনটা ব্যাগ। পিছন পিছন পায়ে হেঁটে মানুষজন। মানুষজনের একজন তো গোস্বামীবাবুর কোলে। তাই হাঁটা বলতে বুবু-কোলে তিনি, আশালতা আর স্যানরেলে। বালকের আবদারে স্যানরেলে তার সঙ্গি হয়েছে। তার গায়ে চেপে বালক তিন চক্কর মেরে যখন জি টাইপে এল, বাকি তিনজনও সেই সময়ে নতুন কোয়ার্টারের দোরগোড়ায়।

কোয়ার্টারের দেওয়ালে নতুন চুনকাম, দরজা-জানলায় সবুজ রঙ। বড়ো দুজন জিনিসপত্তর খুলছেন, গুছোচ্ছেন, বালক বুবুবুড়ির হাত ধরে রঙ শুঁকে বেড়াচ্ছে। এই কোয়ার্টারে দুটো শোয়ার ঘর। তাহলে কি বালক একটা ঘরে একা ঘুমাবে? আশালতা যা বলবেন তাই হবে, বালক জেনে গেছে। কাল থেকে তার হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা শুরু হবে। প্রথম দিনেই অঙ্ক। আজ ভাগ্যিস নতুন কোয়ার্টারে আসা হলো, নইলে দাদা তার অফ ডের সবটাই তার অঙ্কের পিছনে খরচ করে দিতেন। এখন যা মনে হচ্ছে, গোছানো, রান্না-খাওয়া করতে করতে বিকাল হবে। দাদার ভলিবলের মাঠে যাওয়ার সময় হয়ে যাবে। ফিরে এসেও খুব একটা সময় অঙ্ককে দিতে পারবেন না। কাল তার মর্নিং ডিউটি, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার নিয়ম।

সেদিন রেহাই মিললেও সোমবার অঙ্ক পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পরেও অঙ্কের কথা ভুললেন না দাদা। কোশ্চেন পেপার নিয়ে বালককে বসতে হলো তাঁর কাছে। পরীক্ষা দিতে দিতে প্রতিটি অঙ্কের পাশে উত্তর লিখে রাখা পুরনো নিয়ম। দাদা এখন মনে মনে এক একটি অঙ্ক করছেন আর বালকের উত্তরের সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছেন। কোনো কোনো অঙ্কে সাদা কাগজে একটু আধটু গুণ ভাগও করে নিচ্ছেন। কোশ্চেন পেপারের সামনের দিকটা ভালোয় ভালোয় কাটল। উলটো দিকে যেতেই একের পর এক হোঁচট। সে দিকটায় লসাগু গসাগুর রাজত্ব। লসাগু গসাগু খুব পারে বালক। উৎপাদক কী জিনিস দিব্যি জানে। জানে যেকোনো অঙ্কের বৃহত্তম এবং ক্ষুদ্রতম সংখ্যা। কিন্তু প্রশ্নগুলো দেয় জট পাকানো। সেখানে তাঁর না জানা অনেক শব্দ থাকে। সে বিভাজ্য মানে জানে না, গুনিতক আর গুণনীয়কের তফাত বোঝে না। কোন প্রশ্নে লসাগু করলে উত্তর মিলে যাবে আর কোন প্রশ্নে গসাগু করতে হবে সেটা আন্দাজে ঠিক করে। কিন্তু লসাগু গসাগু করেই অঙ্কের উত্তরে পৌঁছনো যায় না, তারপরেও যোগ-বিয়োগের ব্যাপার থাকে। অঙ্ক বইয়ের উদাহরণ দেখে দেখে বোঝার চেষ্টা করেছে বালক। কিন্তু উদাহরণের থেকেও জট পাকানো সব প্রশ্ন এসেছে পরীক্ষায়। একটা ভুল, দাদা ঢ্যাঁড়া মারলেন, পরেরটা ভুল, আবার ঢ্যাঁড়া। দাদার জিভ উলটে গিয়ে তালুতে চটাস চটাস আওয়াজ করল। বালকের বুক কাঁপতে শুরু করেছে একটু একটু। তার পরেরটায় একটা অঙ্কের দুটো ভাগ। প্রথম ভাগ ঠিক, পরের ভাগ ভুল। চার নম্বরটাও ঢ্যাঁড়া। দাদার চটাস চটাস বেড়ে গেল। –৩৫ নম্বর জলাঞ্জলি দিয়ে চলে এলি! কেন পারিসনি বল?

বালক চুপ। দাদা রেগে গেলে বালক যা কিছু বলার মনে মনে বলে। দাদা শেষের অঙ্কটার শেষ দেখে ছাড়বেন ঠিক করেছেন। জিজ্ঞেস করছেন, –৫ অঙ্কের বৃহত্তম সংখ্যা জানিস না?

বালক মনে মনে বলে, পাঁচটা ৯। দাদা বলেন, –চুপ করে আছিস কেন? বল বল(চটাস চটাস)। জানিস তবু বলবি না! এই এই সংখ্যা দিয়ে বিভাজ্য হবে সবচেয়ে বড়ো পাঁচ অঙ্কের কোন সংখ্যাটা? এই সংখ্যাগুলোর লসাগু করিসনি?

বালক মনে মনে বলে, করেছি কিন্তু বিভাজ্য মানে কী?

দাদা বলছেন, –আবার চুপ করে আছিস? তাহলে উত্তরটা কোথায় পেলি বল?

হঠাৎ একটু চুপ করলেন দাদা। কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, – ও, এ তো দেখছি পাঁচ অঙ্কের বৃহত্তম সংখ্যার থেকে লসাগু করে পাওয়া সংখ্যাটা বিয়োগ করে দিয়েছিস? গর্দভ কোথাকার! তাতে কি সেই সংখ্যাটা বিভাজ্য হলো? করে দেখেছিস? গর্দভ মাথামোটা – বেকার এটাকে এতদূরে নিয়ে আসা! বাড়িতে থেকে গরুবাগালি করলে কাজে দিত।

বালকের কান মুচড়ে পিঠের উপর দুটো থাবড়া মেরে উঠে পড়লেন দাদা। বেকার সময় নষ্ট। এখনও গেলে গোটা কয়েক ম্যাচ খেলা যাবে। প্যান্ট-সার্ট আর কেডস পরে সাইকেলে উঠে ভলিবলের মাঠের দিকে চলে গেলেন তিনি। রাগ আর কান্না চেপে বালক পায়খানায় ঢুকে গেল।

একটা অন্ধ রাগ মুখ থেকে ‘মর মর মর’ চাপা শব্দে বেরিয়ে ফোঁপানির আকারে বেরোতে লাগল। কী বলছে, কাকে বলছে কিছুই জানে না বালক। চোখ থেকে বেশ কিছু জল বেরিয়ে যাওয়ার পর দাঁত কিড়মিড় করে ‘হিমাংশু’ নামটাকে যতটা পারে বিকৃত করে উচ্চারণ করে গেল। –তুই তো জানিস, কেন তবে একবারও বললি না আমাকে বিভাজ্য কাকে বলে!

অনেকটা চোখের জল ঝরে যেতে মাথাটা শান্ত হলো বালকের। কী সব বলছিল ভেবে লজ্জা পেল মনে। সহসা মনে হলো, সেই বা কেন দাদাকে মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করল না বিভাজ্য কাকে বলে।

অপরাধীর মতো মুখ নিচু করে পায়খানা থেকে বেরিয়ে আসতেই বুবুবুড়ি ছুটে এসে প্রায় লাফ দিয়ে কোলে উঠে গেল বালকের। দুপুরের ঘুম শেষ হলেই তার চোখ বালককে খোঁজে। এখন সে কেবল রাস্তায় হাঁটতে চায় না, জঙ্গলে ঢুকে গাছের পাতা ছিঁড়ে খুব মজা পায়। এতক্ষণ তাকে দেখতে না পেয়ে সঙ্গি কোথায় ভেবে অস্থির হয়ে পড়েছিল বোধ হয়। তাকে কোলে নিয়ে বালকের মন খুব ফুরফুরে হয়ে গেল। রাস্তায় নেমে আসতেই একটু ধাক্কা খেল সে। জঙ্গলকে পাশে নিয়ে পরিচিত রাস্তাটি উধাও। নতুন কোয়ার্টার কলোনির মাঝখানে, বুবুবুড়ি এখানে পাতা ছিঁড়তে পারবে না। তাকে নিয়ে পুরনো কোয়ার্টারের দিকে যাবে কি না ভাবতে লাগল বালক। কিন্তু সূর্য ডুবব ডুবব করছে। এখন অতখানি রাস্তা গেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। আশালতা রেগে যাবেন নির্ঘাত।

(ক্রমশ)

+ posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may have missed