দেবর্ষি সারগীর ‘গল্পকার’ : আস্তিক দর্শনের রূপময় আখ্যান। লিখেছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

দেবর্ষি সারগীর ‘গল্পকার’ উপন্যাসটি পড়তে শুরু করে প্রথমেই যা মনে দাগ কেটে গেল এবং নিশ্চিতভাবেই প্রতিটি পাঠককে যা ভাবাবে তা হল উপন্যাসটির নির্মাণ-প্রকরণ। এখানে তিনি যে গদ্যরীতির অনুসারী তা বুঝিয়ে বলতে আমাকে বিশ্বসাহিত্যের কয়েকটি বিশেষ প্রকরণ-রীতির প্রসঙ্গে আসতে হয়। পাঠক যেন আমাকে ভুল না বোঝেন, তাই প্রথমেই জানিয়ে রাখি আমি কোনো বিদগ্ধ আলোচক নই, একজন মনোযোগী পাঠক মাত্র। পাঠসূত্রেই যেটুকু জেনেছি তা ভাগ করে নিতে বিশ্বসাহিত্যে বহু আলোচিত এইসব প্রকরণের অবতারণা। অন্যথায় এই উপন্যাসের অভিনবত্বের স্বাদটুকু হয়তো অধরা থেকে যেতে পারে।

বিশ শতকে লেখালেখি করেছেন এমন একজন আইরিশ লেখক জেমস জয়েস এবং ইংরেজ লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ তাদের গল্প-উপন্যাসে প্রথম একটি বিশিষ্ট সাহিত্য-রীতির প্রচলন করেন। এই রীতির নাম ‘স্ট্রিম অব কনসাসনেস’ বা ‘চেতন প্রবাহ’। মূল চরিত্রের চিন্তা, অনুভব এবং প্রতিক্রিয়ার অবিরল স্রোতে গড়ে উঠতে থাকে গল্প বা উপন্যাসের অবয়ব।

দ্বিতীয় একটি রীতির প্রবর্তক হলেন জয়েস এবং উলফ-এর সমসাময়িক জার্মানভাষী ইহুদি লেখক ফ্রাঁ কাফকা। অল্প বয়সে প্রয়াত হন ইনি, কিন্তু বিশ্ব-সাহিত্যকে তুমুলভাবে প্রভাবিত করে তাঁর অতুলনীয় সাহিত্য-রীতি। এক বিশেষ গদ্যরীতিতে বাস্তবের সঙ্গে ফ্যান্টাসিকে মিলিয়ে হতাশার অন্ধকারেও কঠোর সংগ্রামের চেতনাকে একই সঙ্গে আশা ও আশাহীনতায় জাগরুক রাখেন তাঁর রচনায়। তাঁর রীতি-অনুসারী একাধিক লেখক পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়েছেন বিশ্বসাহিত্যে।

এই কাফকেস্কি উপাদানেরই রকমফেরে পরবর্তীকালে আর এক নতুন সাহিত্য-রীতির উদ্ভাবন করেন ল্যাটিন আমেরিকার এক লেখক, গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেজ। আধুনিক বিশ্বের বাস্তব জীবনের ছবিতে ফ্যান্টাসি, রূপক এবং মিথকে মিশিয়ে দেন তিনি। এই রীতিও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে বিশ্বসাহিত্যে ‘ম্যাজিক্যাল রিয়েলিজম’ বা ‘জাদু বাস্তবতা’ নামে।

দেবর্ষি সারগীর ‘গল্পকার’ উল্লিখিত তিন রীতির স্বতঃস্ফূর্ত এবং নিপুণ সংমিশ্রণ। এই ব্যতিক্রমী রীতির জন্যই উপন্যাসটি বিদগ্ধপাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে বলে আমার ধারণা। এবার উপন্যাসের বিষয়ের গভীরে ঢোকা যাক।

‘গল্পের জাদুকর’ হওয়ার বাসনা হৃদয়ে পুষে রাখেন এমন এক তরুণ গল্পকার এই উপন্যাসের মূল চরিত্র। উপন্যাসে তাঁর কোনো নাম নেই। একেবারে শেষ অংশ ছাড়া পুরো উপন্যাসে এই গল্পকার উত্তম পুরুষে তাঁর চেতনা প্রবাহ প্রকাশ করে চলেছেন। বাস্তব জীবনে তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে আছেনতাঁর বিধবা মা, কুমারী বোন আর তাঁর সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের এক বন্ধু। এই কটি চরিত্র এবং তাঁর নিজস্ব নিমগ্ন চেতনা। এই নিমগ্ন-চেতনায় জড়িয়ে আছে তাঁর গল্পকার হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার উদগ্র বাসনা এবং তাঁর একদা প্রেমিকা তমসার রংবেরঙের স্মৃতি। এই কটি বাস্তব চরিত্র এবং নিজস্ব চেতনার টানাপড়েনে তৈরি হতে থাকে আলগা বুননের এক আখ্যান।

উল্লিখিত পরিমণ্ডল ছাড়াও অন্য এক পরিমণ্ডলে ঘোরাফেরা করে গল্পকারের ভাবনা। তার অর্ধেক অংশে সাহিত্যের কফি-আড্ডার সাথীরা। তাদের আলোচনায় সাহিত্য-তত্ত্বের কচকচি এবং গল্পকারের সাহিত্য-প্রচেষ্টার প্রতি উপেক্ষা বা অবজ্ঞা শ্লেষ-সরসতায় ব্যক্ত হতে থাকে। গল্পকার যেহেতু একটি কলেজে পড়ান, সুতরাং বাকি অর্ধেক অংশে আছে তার সহকর্মীরা। তার সাহিত্য-কৃতির প্রতি সেখানেও অবজ্ঞা ও উপহাস তাঁর চেতনাকে বিক্ষুব্ধ করে তুলতে থাকে।

এইভাবে সমগ্র উপন্যাস জুড়ে গল্পের আবর্তেই ঘুরপাক খায় গল্পকারের চিন্তাধারা। তিনি নিজে গল্প বানান, তাঁকে নিয়েও একটা গল্প তৈরি হতে থাকে। গল্পকারের ভেতরে আর এক গল্পকার। তিনি বানিয়েছেন বংশীকা নামে এক গল্প-কথককে। সেই কথকের গল্পে আছে ‘জাদু’, ‘ঘোর ও সম্মোহন’। তাঁর অনেকগুলি গল্প পত্রিকার সম্পাদকরা বাতিল করার পর তিনিসেই কথকের গল্প থেকে গল্প লিখতে শুরু করেন। এইভাবে উপন্যাসের মধ্যেই তৈরি হচ্ছে পৃথক পৃথক একটা করে গল্পের কুঠরি। এই গল্পগুলি তৈরি হচ্ছে কাফকেস্কি উপাদান দিয়ে। কোথাও কোথাও সেখানে ঢুকে পড়ছে যাদু বাস্তবতা। উপন্যাসের ভেতরে আছে এমনই তিনটি নিটোল এবং একটি অসমাপ্ত গল্প। প্রত্যেকটিই আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। সেই গল্পগুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমি একটু পরে আসছি।

গল্পকারের চরিত্রের বিপরীত মেরুতে বিচরণকারী গল্প-কথক বংশীকা হয়ে ওঠে এই উপন্যাসের এক বিশিষ্ট চরিত্র। স্বল্পশিক্ষিত অথবা স্বশিক্ষিত বংশীকা প্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পরিশ্রমী এক মানুষ। সে গল্প লেখায় বিশ্বাস করে না। লেখক-খ্যাতি তার কাছে অবান্তর। সে বলে, ‘গল্প ত বলার জিনিস আর শোনার জিনিস। লিখে রাখলে কি ভাবছেন চিরকাল টিকে থাকবে?’

বংশীকার কাছে শোনা অর্থাৎ ‘বংশীকা সিরিজ’-এর প্রথম যে গল্পটি গল্পকার লেখেন সেটির নাম ‘হারটা কোথায়?’ ধোপার মেয়ে অপরূপ সুন্দরী সোনাদাসী আর তার দুই প্রেমিক স্থানীয় জমিদারের দুই ছেলেকে ঘিরে গড়ে ওঠা প্রেমের আখ্যান এক সময় বাস্তবকে ছাড়িয়ে রূপকথার দেশ ছুঁয়ে ফের এসে দাঁড়ায় ইহজীবনে, ঈশ্বর-জিজ্ঞাসার এক নিগূঢ় তাৎপর্য নিয়ে। সোনাদাসীর প্রেমিকের উপহার, খোয়া-যাওয়া হার নিয়ে জমিদারের গুরু ধীরাজ যোগী বলেন, ‘বলছি বাইরে যতই খুঁজুক, সোনাদাসী ত হারটা পাবে না। কারণ, হারটা ঝুলছে যে ওর গলাতেই!’

দ্বিতীয় গল্প ‘পূর্ণজ্ঞানী দামোদর’। সদানন্দ কোবরেজের ছেলে দামোদর। তিনিও কোবরেজি শিখেছেন কিন্তু রুগির চিকিৎসায় তাঁর মন নেই। তিনি পূর্ণজ্ঞানী হতে চান। বিশ্বের সমস্ত রহস্যের উৎসকে জানার জন্যে তিনি নিজের বসবাসের ঘরটিকেই রহস্যময় করে তুললেন। বাইসনের খুলি, পাখির বাসা, নকশা-আঁকা তরোয়াল জড়ো করলেন সেই ঘরে। বাইসনের খুলিতে লম্ফ জ্বলে, পাখির বাসায় আকাশনীল ডিম। তরোয়ালটি তাঁর কাছে অজ্ঞানতা নাশের প্রতীক। জৈব ও জাগতিক ব্যাপারে নির্লিপ্ত দামোদরের মনে যৌন-ঈর্ষা জাগিয়ে প্রেম ফিরে পেতে তাঁর স্ত্রী প্রতিবেশী এক তরুণের সঙ্গে মাখামাখি শুরু করেন। দামোদরের তরুণ ছেলে বঁটি দিয়ে প্রতিবেশী তরুণটিকে কোপাতে উদ্যোগী হয়। দামোদর তাকে নিরস্ত করেন। সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতির ঊর্ধ্বে তখন তিনি অবস্থান করছেন। কিন্তু অপরাধবোধে কাতর তাঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করলেন, ছেলে নিরুদ্দেশ হল। সম্পূর্ণ নির্ভার ও মুক্ত দামোদর নির্জন ঘরে নিজেকে বন্দী রেখে একদিন দিব্যদৃষ্টি লাভ করলেন। সেই দৃষ্টিতে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন জীবজগতের জন্ম ও মানুষের আদিম ইতিহাস। তারপর অবশেষে একদিন দামোদরের ঈশ্বরদর্শন হল। ঈশ্বর তাঁর যন্ত্রণায় বিচলিত হয়ে তাঁকে বর দিতে সম্মত হলেন। দামোদর বললেন, ‘আমি জগৎ ও জীবনের সব রহস্য জেনে ফেলতে চাই।’ঈশ্বর তাঁকে এই শর্তসাপেক্ষে বর দিলেন যে সে তাঁর জানা জ্ঞান অন্য কাউকে দিতে পারবে না। দামোদর তাঁকে বললেন, ‘তুমি নিশ্চিন্ত থাক। আমি জ্ঞানের ব্যাপারে ক্ষুধার্ত, খ্যাতির ব্যাপারে নয়। তাছাড়া আমি বিশ্বাস করি জ্ঞানের পথ চিরকালই একক। নিজের অভিজ্ঞতায় না এলে ওটার বেশি মূল্য নেই।’ এইভাবে দামোদর পূর্ণজ্ঞানী হলেন, জগতের কোনও কিছু তাঁর কাছে রহস্যময় রইল না, অথচরিক্ত, নিঃস্ব মানুষের মতো একাকী নির্জন ঘরে বসবাস করতে লাগলেন এবং একদিন সাপের খোলসের মতো দেহটিকে ফেলে রেখে জীবনের ওপারে চলে গেলেন।

একদিকে প্রতিদিনের গল্প তৈরি হচ্ছে গল্পকারের বাস্তব জগতে। তাঁর মাকে নিয়ে, বোনকে নিয়ে, তাঁকে পরিত্যাগ করে যাওয়া প্রেমিকা তমসাকে নিয়ে। পত্রিকার সম্পাদকরা তাঁর বংশীকা সিরিজের গল্পগুলি বাতিল করছেন নির্বোধ, উদ্ভট আখ্যা দিয়ে। সেই প্রত্যাখ্যান থেকে মুখ ফিরিয়ে গল্পকার ফের ঢুকে পড়ছেন যাদু-বাস্তবতায়, বংশীকার গল্পের জগতে।

তৃতীয় গল্প, ‘বলাই পুত্রশোক ভুলল’। এক পত্রিকার সম্পাদক গল্পকারকে উপদেশ দিয়েছিলেন, এমন গল্প লিখতে হবে যাতে পাঠকের চোখ থেকে অশ্রু ঝরবে, তা নইলে সে গল্পই নয়। এই তৃতীয় গল্পে বাস্তবের দুঃখকে গল্পের শরীরে আনার একটা চেষ্টা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটাও হয়ে দাঁড়ায় একটি অনুসন্ধানের গল্প। অতি সাধারণ এক মানুষ বলাই বাগদির রূপসী বউ নিজের ছেলেকে বাপের কাছে ফেলে রেখে পরপুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যায়। সেই ছেলেটিই তখন থেকে বলাই-এর ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে। দৈবাৎ একদিন ছেলেটি মারা যায়। তার শোকে পাগলপ্রায় বলাই জগত ভুলে একটা প্রশ্নের ঘূর্ণিপাকে হাবুডুবু খেতে থাকে, ‘খোকাটা কোথায় গেল?’ শিক্ষিত মানুষদের রকমারি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা তাঁর মাথায় ঢোকে না। শেষ পর্যন্ত সে একদিন নিজেই নিজের মতো করে প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে নেয়। অন্যকে সেই উত্তর জানানোর একটি অনন্য দেহভঙ্গিও সে আবিষ্কার করে ফেলে। উদ্ভট ও আজগুবি কলঙ্ক থেকে রেহাই মেলে না এই গল্পটিরও। গল্পকারের সাহিত্য-সাথীরা এই গল্পটি শুনতে তাঁর বাড়িতে আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। অবশেষে গল্পকার যখন বুঝলেন, তাঁরা তাঁর সঙ্গে মস্করা করেছেন, তখন তিনি তাঁর টেবিলে থাকা ষাঁড়ের মূর্তিটিকেই তাঁর গল্পটি পড়ে শোনালেন। ষাঁড়-এর পাঠ-প্রতিক্রিয়া বিশেষ আলাদা হল না। সে বলল, ‘গল্পটা একটি উদ্ভট। আর এ গল্পেও তুমি চতুরভাবে ঈশ্বরের কথা বলেছ। তোমার গল্পে বড় বেশি ঈশ্বরের কথা,…’। হতাশ ও ক্ষুব্ধ গল্পকার ষাঁড়ের মূর্তিটিকে আছড়ে ভেঙে ফেললেন। চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে তিনি বংশীকার শেষ গল্প, যেখানে একটি গুহাচিত্র সজীব হয়ে উঠে চলাফেরা শুরু করবে – সেটিকে নির্মাণ করার সংকল্প ত্যাগ করলেন।

এইভাবে প্রেমহীন এবং স্বীকৃতিহীন জীবনকে বয়ে নিয়ে যাওয়া নিরর্থক-বোধে অবশেষে গল্পকার আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিলেন। এক ভোরবেলায় মা ও বোনের ঘুম ভাঙার আগেই হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে তলিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে গঙ্গার জলে নেমে গেলেন।

এই পর্যন্ত এসে গল্পকারের স্বগতকথন ছেড়ে উপন্যাসের কাহিনি-বর্ণনার রাশ নিজের হাতে নিলেন লেখক। তিনি জানাচ্ছেন, গল্পকার আত্মহননে অসফল হয়েছিলেন। সেই ভোরবেলাতেও কিছু মানুষ গঙ্গায় চান করছিল। তারা বুঝতে পারে যে লোকটা সাঁতার জানে না, ডুবতে বসেছে। ফলে তারা দ্রুত সাঁতরে গিয়ে উদ্ধার করে আনে তাঁর জ্ঞানহীন দেহ। বেঁচে যান গল্পকার এবং মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসে একটা পরিবর্তন ঘটে যায় তাঁর মানসিকতায়। তিনি মৃত্যুকে উপহাস করতে শিখলেন। বোন এবং মায়ের দিকে অনেক বেশি মনোযোগ ও সময় দিলেন এবং গল্প লেখার চেষ্টা ছেড়ে দিলেন। তবুও বংশীকার শেষ গল্পটার গুহাচিত্ররা তাদের শিল্পীর খোঁজে তাঁর মাথার মধ্যে চলাফেরা করতেই থাকে। এভাবেই গল্পকার পৌঁছেছেন পঞ্চান্ন বছর বয়সে। তমসার বদলে তিনি পেয়েছেন মীরা নামে অবিবাহিতা, স্কুল-শিক্ষিকা এক মরমী বন্ধুকে। তিনি তাঁকে গল্প শোনান, তাঁর সান্নিধ্য তাঁকে দিয়েছে এক অদ্ভুত প্রসন্নতা। লেখক জানাচ্ছেন, এই পরিবর্তনের পিছনে আছে এক অদ্ভুত ঘটনা। আত্মহত্যার চেষ্টার পরবর্তী এক সময়ে গল্পকার কিছুদিনের জন্য ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন। এক জায়গায় এসে তিনি সাক্ষাৎ পেলেন খ্যাতির মোহহীন ধ্রুপদী সংগীতের অপূর্ব এক বৃদ্ধ গায়কের। তিনি তাঁকে বললেন, ‘খ্যাতি আনন্দ দেয় বলে শুনেছি। কিন্তু গান গাইবার সময় যে আনন্দ পাই, খ্যাতির আনন্দ তাঁর চেয়ে বেশি বলে বিশ্বাস করি না।’…‘সমস্ত জগৎ যিনি রচনা করেছেন তিনি নিজেই ত সবচেয়ে খ্যাতিহীন শিল্পী।…’‘মানুষ ত তাঁরই সৃষ্টি। তাঁর অসীম উপন্যাসের একটা চরিত্র। তাই মানুষের দেওয়া খ্যাতির তাঁর কাছে কি মূল্য? তাঁকে খ্যাতি দিতে পারত আর একজন ঈশ্বরই। কিন্তু জগতে যে দ্বিতীয় ঈশ্বর নেই।’তাঁর সান্নিধ্য এবং তাঁর কথা যেন নিমেষে ভোজবাজী ঘটিয়ে দিল গল্পকারের অন্তরে। তিনি বংশীকার চার নম্বর গল্পখানির পাণ্ডুলিপি কাগজের নৌকা করে পুলের জলে ভাসিয়ে দিলেন।

সমস্ত উপন্যাসটি যেন এক পরিক্রমা, যে পরিক্রমা শেষ হয়েছে গিয়ে এক ব্যক্তিগত দর্শনে। ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষজন যেমন বিশেষ কোনো তীর্থে গিয়ে ঈশ্বরদর্শনের স্বাদ পান, তেমনই গল্পকার খ্যাতির মোহহীন এই অপূর্ব গায়কের সাহচর্যে ঈশ্বরদর্শনের স্বাদ পেলেন, খ্যাতির মোহ থেকে মুক্তি পেয়ে কামনার বস্তুকে ভাসিয়ে দিলেন কালের নৌকায়।

শেষ পর্যন্ত উপন্যাসটি হয়ে ওঠল জীবনের বাস্তবতার আড়ালে থাকা এক নিগূঢ় তাৎপর্যের সন্ধানে আস্তিক দর্শনের রূপময় আখ্যান।

………………………………………

বইয়ের নাম : গল্পকার
লেখক : দেবর্ষি সারগী
প্রচ্ছদ : সুনীল দাস
মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
প্রকাশক : তবুও প্রয়াস

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *