সার্কাসের ইতিকথা : প্রান্তজনের করতালি। পর্ব ৬। বরুণদেব

0

গত পর্বের পর

সাড়ে তিন হাজার খ্রীস্টপূর্বাব্দের দিকে আজকের উত্তর কাজাখস্তানের বোটাই (botai) গ্রামকে কেন্দ্র করে যে বোটাই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, সে সভ্যতায়  কোনো গবাদি পশু বা ভেড়ার হাড় প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া যায় নি। পাওয়া গিয়েছিল ঘোড়া ও কুকুর। গৃহপালিত। এ সভ্যতার যাযাবর শিকারী জীবন ঘোড়ার মাংসের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু বোটাই সভ্যতার গৃহপালিত ঘোড়া যেমন আধুনিক ঘোড়া ইকুয়াস কাবালুসের পূর্বপুরুষ নয়, তেমনি   আজকের স্পেন, পোর্তুগাল, জিব্রাল্টার ইত্যাদি নিয়ে গঠিত দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের ইবেরিয়া উপদ্বীপ অঞ্চলের বা তুর্কীর আনাতোলিয়া উপদ্বীপের হোমো সেপিয়ানদের যে গৃহপালিত ঘোড়া, তার থেকেই আধুনিক ঘোড়া এসেছে, এ মতবাদও  চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আধুনিক অশ্বকুলের  উৎপত্তির জেনেটিক বা ভৌগোলিক ইতিহাস নানা মতের নানান মেঘে ঢাকা। আজকের ইউক্রেন ও পশ্চিম কাজাখস্তান নিয়ে যে ইউরেশিয়ান অঞ্চল, তৃণাবৃত সমতল, সেখানে ছ’হাজার বছর আগে ঘোড়া ছিল গৃহপালিত। এই গৃহপালিত ঘোড়ার সঙ্গে বুনো ঘোড়ার প্রজননে শঙ্কর ঘোড়া। রাশিয়ার সিন্তাষ্ট সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতি জন্ম দিয়েছিল ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষার এবং ইউরেশিয়ার অশ্বারোহী সংস্কৃতি, প্রায় দু’হাজার খ্রীস্টপূর্বাব্দে সভ্যতার ঘোড়ার খুরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে, আধুনিক ঘোড়া  অশ্বজগতে আধিপত্য বিস্তার করে।  ঘোড়া হয়ে উঠল মানবসভ্যতার পরাক্রমী বাহন। পরিবহণ থেকে কৃষিকাজ, যুদ্ধবিগ্রহ থেকে খেলাধুলা – মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে ঘোড়ার খুরের ধুলো। ঘোড়া মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে গতি এনেছে, যুদ্ধকে দিয়েছে অন্য রূপ। একটি জনপ্রিয় খেলা হয়ে উঠেছে অশ্বারোহণ । ৬৮০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে গ্রীস-অলিম্পিকে চার ঘোড়ার রথের রেস অন্তর্ভুক্ত হয়। আর এই ঘোড়ার পিঠে চেপেই এল আধুনিক সার্কাস। স্থান ইংলন্ড। সময় ১৭৬৮ খ্রীস্টাব্দ। জনক- ফিলিপ্স অ্যাসলে।

 

১৭৪২ এর ইংলন্ডের শীতে ফিলিপ অ্যাস্টলের জন্ম। জন্মস্থান কারিগর ও শ্রমিক শ্রেণী অধ্যুষিত নিউ ক্যাসেল। অ্যাস্টলেদের তিন পুরুষের বাস সেখানে। ফিলিপের বাবা এডুয়ার্ড অ্যাস্টলে। এডুয়ার্ডকে তাঁর মা পাঠিয়েছিলেন লন্ডনের এক বিখ্যাত আসবাবপত্র প্রস্তুতকারকের কাছে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে। সেই সময়ের লন্ডনে বালক থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার পথে এইরকম শিক্ষানবিশ হয়ে থাকাটা ভবিষ্যৎ সুরক্ষার এক আকর্ষণীয় পথ। কিন্তু এডুওয়ার্ড শিক্ষানবিশির কাজ সম্পুর্ণ করতে পারলেন না। একুশ বছর বয়সে ফিরে এলেন ।সঙ্গে সন্তানসম্ভবা সারা লিচ। পরের  বছর জন্মাল ফিলিপ। খুব ছোট থেকেই ফিলিপের ঘোড়ার প্রতি প্রবল আকর্ষণ। স্বপ্ন দেখে ঘোড়ার পিঠে চেপে সে ছুটে যাবে। নিউ ক্যাসলে এডুয়ার্ডের ব্যবসা বেশ ভালোই চলছিল।জনবসতি বাড়ছে। চাহিদা তৈরী হচ্ছে আসবাবপত্রের। স্থানীয় অর্থনীতির লেখচিত্র উর্ধ্বমুখী। ফিলিপের বয়স যখন পাঁচ বছর, বজ্রপাত নেমে এল এই সুখী সংসারের ওপর। আর্থিক দূরবস্থায় পড়লেন এডুয়ার্ড। ঋণে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়লেন। দু’বেলা দু’মুঠো অন্নসংস্থান করা মুশকিল হয়ে পড়ল। ঋণখেলাপি   এডুয়ার্ড লণ্ডনের কুখ্যাত ফ্লিট জেলে বন্দী হলেন। ফ্লিট জেল সেই সময় সারা দেশের ঋণখেলাপিদের আস্তানা। এতটাই খারাপ সে আস্তানা, টাইফাসে আক্রান্ত হত বন্দীরা, বন্দীদের এক চতুর্থাংশ প্রতিবছর মারা যেত। ১৭৫১-র পাবলিক রেকর্ড অনুযায়ী এডুয়ার্ড জেল থেকে ছাড়া পেলেন। পরিবার সব ঋণ শোধ করে দিল । বাড়ি ছেড়ে এডুয়ার্ড বাসা বাঁধলেন এক অন্ধ গলির পুঁচকে একটা বাড়িতে, এক জুতোর কারিগর ও তার ছয় ছেলেমেয়ের সঙ্গে আশ্রয় ভাগাভাগি করে। লন্ডনের সেন্ট মেরি লে স্ট্রান্ড-এ নতুন করে জীবন শুরু অ্যাস্টলেদের। অনিশ্চিত রোজগার। দু’মুঠো অন্ন যোগাড়ের জন্য উদয়াস্ত খাটনি। ফিলিপের যখন ৯ বছর বয়স,  বাবা এডুয়ার্ডের সঙ্গে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করলেন। কিন্তু ফিলিপ কোনোদিনই সে কাজে মনোযোগী ছিল না। তাকে টানত ঘোড়া। তাদের কাঠের দোকানের বাইরে ঘোড়ার খুরের শব্দ তাকে বের করে আনত দোকান থেকে রাস্তায়। পড়ে থাকত কাজ। জুটত বাবার চামড়ার বেল্টের সাঁই সাঁই। কিন্তু ফিলিপ অচঞ্চল। হাজারো বেল্টের আছাড়েও তার পরিবর্তন নাই। এমনি করেই কেটে গেল আরও আটটা বছর। একদিন বাবার হাত থেকে বেল্ট কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল কাঠের গুঁড়ো ভর্তি মেঝেতে। বাবার ব্যবসায় যা নগদের জোগান তাতে ব্যবসা আর বড়জোর এক মাস স্থায়ী। ফিলিপকে ঘর ছাড়তেই হতো। বাবার ওপর রাগ করে ঘর ছাড়ল ফিলিপ। বয়স তখন ১৭ বছর।

কলোনেল গ্রানভিল এলিয়টের অধীনে ফিফটিনথ লাইট ড্রাগনসের অশ্বারোহী রেজিমেন্টে নিয়োগ চলছে। ফিলিপকে হাতছানি দেয় ঘোড়ার লাগাম। ডাক এসেছে যুদ্ধে যাবার। ফিলিপ যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। ততদিনে কামানের গোলা ইউরোপ ছাড়িয়ে অন্যান্য মহাদেশে এসে পড়ছে অহরহ। ‘সাত বছরের যুদ্ধ’, উইন্সটন চার্চিলের মতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, তখন মধ্যগগনে।

অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে, দুই সুপারপাওয়ার ফ্রান্স ও ইংলন্ডের সংঘর্ষ বৈশ্বিক রূপ নেয়। একদিকে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, রাশিয়া অন্যদিকে গ্রেট ব্রিটেন, প্রুসিয়া, পর্তুগাল, হ্যানোভার। ১৭৫৬ থেকে ১৭৬৩ – সাত বছরের এই যুদ্ধ, আমেরিকায় শুরু হয়ে আটলাণ্টিক জুড়ে প্রসারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপ আফ্রিকা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, এমন কি ভারতেও। মহাদেশে মহাদেশে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে উপনিবেশ ও বাণিজ্যের  লাগাম হাতে রাখার রেষারেষি। ইউরোপের আধিপত্যের পাশাপাশি উত্তর আমেরিকা ও ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের রাশ কার হাতে থাকবে বিবাদ তা নিয়েও। বিশ্ব রাজনীতির এক নতুন সমীকরণ। জটিল সমীকরণ।  সেই সমীকরণ সমাধানের যুদ্ধগুলি পিটার্সবার্গ থেকে মিনরকা, কোয়েবেক থেকে বাংলা, ছড়িয়ে পড়েছিল। যুদ্ধ শেষ হলে ব্রিটিশ শক্তি উত্তর আমেরিকা ও ভারতে দৃঢ় হল। পরাধীনতার শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হল ভারত।

যে বছর ফিলিপ সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন সে সময়ে ইংলণ্ডের বিজয়রথ ছুটছে। জার্মানিতে মিন্ডেনের যুদ্ধে অ্যাংলো-জার্মান বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত হল ফরাসীবাহিনী। ভারতে রবার্ট ক্লাইভ ফরাসীদের হাত থেকে করমণ্ডল উপকূল ছিনিয়ে নিলেন। চিনির জন্য ক্যারিবিয়ানের সমৃদ্ধশালী গুয়াডেলুপ দ্বীপ করায়ত্ত হলো ব্রিটিশের হাতে। জলযুদ্ধে ফরাসী নৌবহর ব্রিটিশের হাত পর্যুদস্ত হলো। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্রিটিশের আধিপত্য বিস্তার লাভে করল। উত্তর আমেরিকার কোয়েবেকের যুদ্ধে কানাডা ব্রিটেনের হাতে এল। এই মহাবিজয়ের মধ্যেও ইউরোপে ফ্রান্স ভয়ানক বিপদ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজন।

সেনাবাহিনীতে একবার ঢুকলে সারা জীবন কাটানো যাবে। যদি বেঁচে থাকা যায়! নবাগত সৈনিকের কাছে  যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার আগেই সেই বেঁচে থাকাটা একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ণের। সেনাবাহিনীর জীবনে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সমূহ। ক্যাম্পগুলি নোংরা ও আবদ্ধ। অশ্বারোহী বাহিনীতে আরও খারাপ দশা। সেনাব্যারাকের সাথে ঘোড়ার আস্তাবল। ঘোড়ার বিষ্ঠায়, মূত্রে সম্পৃক্ত।  অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রমিকের মত ক্লান্ত ও উঞ্ছবৃত্তির জীবন হয়ে যেত সেনাব্যারাকের জীবন। শাস্তি ছিল খুব কড়া। চাবুকের সাঁইসাঁই থেকে মৃত্যু পরোয়ানা। প্রতিদিনের পিষ্টনে বেশিরভাগ নবাগত তরুণ সৈনিকের চোখ থেকে  সেনাবাহিনীর রোম্যান্টিসিজিম খুব তাড়াতাড়ি মুছে গেলে প্রথম বছরেই ব্যারাক ছেড়ে পালিয়ে যেত অনেক সৈনিক। সেনার জীবন সকলের জন্য নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর সেনাব্যারাক বীভৎস দৃশ্যের জন্ম দিত।

অ্যাস্টলে সাহসিকতার পরিচয় দিলেন। ছ’ফুটের ওপর লম্বা, হারকিউলিয়ান চেহারা, ঘোড়ার পিঠে চেপে সেনাবাহিনীতে কিছু করে দেখানোর জন্য ছটফটানি। রাফ রাইডারদের দলে নেওয়া হলো তাকে। অশ্বারোহী বাহিনীতে খুব বিপজ্জনক দল এই রাফ রাইডারদের দল। যুদ্ধের সময় ঘোড়ার পিঠে চেপে প্রচুর পাহাড় ভাঙতে হত। ভীষণ শক্ত, বিপজ্জনক ঝুঁকির যুদ্ধ। মৃত্যুও হত প্রচুর। অ্যাস্টলের ছিল ঐশ্বরিক ক্ষমতা। প্রাণীগুলো সহজেই তাঁর পোষ মেনে যেত। ঘোড়া যাতে গোলাগুলিতে আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি না করে – সেই বোম্বপ্রুফ করার ট্রেনিংয়ে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। অ্যাস্টলের আগ্রহ  উদ্দীপনা সাহসিকতার ফল এনে দিল তাঁর পদন্নতি। তাঁকে পাঠানো হলো দেশের বিখ্যাত রাইডিং মাস্টার অ্যাঞ্জেলোর কাছে। অ্যাস্টলের প্রতিভায় মুগ্ধ অ্যাঞ্জেলো ঝুলি উজার করে শেখালেন ছাত্রকে। অ্যাস্টলে খুব দ্রুত শিখে নিলেন, তীব্র গতিতে ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে কি করে মাটি থেকে পলকের মধ্যে পিস্তল তুলে নিতে হয়, ছুটন্ত ঘোড়ার নিতম্বের ওপর শুয়ে পড়ে কি করে শত্রুর বুলেট এড়িয়ে যেতে হয়। সব কিছু খুব সহজভাবে শিখে গেলেন। ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন ছদ্মবেশী দৈত্য। বেশিরভাগ নবাগতের জন্য ফিফটিন্থ লাইট ড্রাগন রেজিমেন্টের ট্রেনিং মোটেই সুখের ছিল না। মাস্কেট থেকে ছুটে আসা ধাতব বলের আঘাতে নাক, কান, হাত, পা উড়ে যাওয়া মানুষ যন্ত্রনায় ভয়ে আতঙ্কে জীবনটুকু বাঁচাতে ছুটে পালাচ্ছে, এ দৃশ্যের জন্ম হতো অহরহ।

ফিফটিন্থ লাইট ড্রাগন রেজিমেন্ট তৈরী হওয়ার এক বছর পর যুদ্ধে গেল সে বাহিনী। অ্যাস্টলে চললেন জীবনের প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে। নর্থ সি অতিক্রম করে জার্মানিতে মিত্রবাহিনীর সাথে যোগ দিল বাহিনী। ব্রেমেনে ওয়েসার নদী পার হওয়ার সময় কিছু ঘোড়া আতঙ্কিত হয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লে, স্রোতে যায় ভেসে। অ্যাস্টলে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নিরাপদে তাদের তীরে নিয়ে আসেন। এই সাহস ও প্রত্যুৎপন্নতা অ্যাস্টলের স্বাভাবিক চারিত্রিক বিশিষ্ট্য। এই চারত্রিক বিশিষ্ট্য দৃঢ়চেতা অ্যাস্টলেকে সাফল্য এনে দিয়েছে, তাঁকে করে তুলেছে কিংবদন্তি।

সেনাবাহিনীতে সাত বছর কাটিয়ে ১৭৬৬-তে অ্যাস্টলের সৈনিক জীবন থেকে অব্যাহতি। ততদিনে ছ’ফুট লম্বা, দৈত্যের মত চেহারা, গমগমে কণ্ঠস্বরের অ্যাস্টলে হয়ে উঠেছেন এক দক্ষ অশ্বারোহী।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply