সার্কাসের ইতিকথা : প্রান্তজনের করতালি। পর্ব ৫। বরুণদেব

0

গত পর্বের পর

দেবতা জুপিটারকে ঘিরে প্রাচীন রোমের ধর্মীয় উৎসবের ভক্তিমূলক অর্ঘ্য রোমান ক্রীড়াউৎসব- রোমান লুডি। সেই রোমান লুডির উদযাপনের স্থান সার্কাস ম্যাক্সিমাস। প্রথমদিকে বছরে ৩৪ দিন, পরে ৭৫ দিন। সংগঠক – রোমের শাসক ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। প্রজাতন্ত্রের যুগে রোমান শাসক পম্পেই (pompey) এখানে বর্বর গ্ল্যাডিয়েটর ও কুড়িটি হাতির যুদ্ধের আসর বসিয়েছিলেন। রথের রেসের পাশাপাশি ক্রমে ক্রমে অন্যান্য খেলাও ঢুকে পড়ল সার্কাসের এরিনায়। বন্য প্রাণীর প্রদর্শণী  , সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ, গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই ইত্যাদি প্রায় কুড়িটি খেলা ঢুকে পড়ে সার্কাস ম্যাক্সিমাসের আসরে। তার হাজার বছরের যাত্রাপথে ছিল রোমানদের জনপ্রিয় খেলা -ভেনাটিও (venatio), যেখানে সিংহ বাঘ  হাতি বুনো শুয়োর ভাল্লুককে ছেড়ে দেওয়া হত শিকারী বা গ্ল্যাডিয়েটরদের  সামনে। মানুষ ও পশুর সে অসম প্রতিযোগিতায় সার্কাস ম্যাক্সিমাস নৃশংস উল্লাসে মত্ত হত। ছিল  দাগী অপরাধী, যুদ্ধবন্দী, রাষ্ট্রদোহী, ধর্মদ্রোহীদের মৃত্যুদণ্ড। বন্য পশুদের সামনে নিক্ষেপ। লুডির অফিসিয়াল উদ্বোধনী হতো বন্দী বর্বর উপজাতীয় নেতাদের প্রাণদণ্ড দিয়ে। প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডও একটি ইভেন্ট।  সে রক্তখেলা  জনতার কাছে রোমাঞ্চ। বছরের অন্যান্য দিনে যখন অনুষ্ঠান থাকত না, সার্কাস ম্যাক্সিমাসে মহড়া চলত খেলাধুলার । আবার কাছের পশুবাজারের জন্য খোঁয়াড় হিসেবে ব্যবহৃত হত ম্যাক্সিমাস সেই সময়।

প্রায় বারোশো বছরের  রোমান শাসনের ভাঙা গড়ায় সার্কাস ম্যাক্সিমাসের চৌহদ্দি শাসক ও অভিজাততন্ত্রের কাছে  শাসনযন্ত্রেরই এক অংশ হয়ে গিয়েছিল।  শাসকের পরিবর্তন হয়েছে, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, সার্কাস ম্যাক্সিমাস ঘিরে বিনোদন ও ধর্মীয় উপাসনায় কোনো ভাটা পড়ে নি যেমন, তেমনি শাসকের শৌর্য বীর্য প্রদর্শণে, প্রজার মনোরঞ্জনে ও শাস্তি বিধানে, রাজনীতির রথ ও অশ্ব পরিচালনায় সার্কাস ম্যক্সিমাস ছিল শাসনব্যবস্থার শোভাযাত্রার এক প্রকৃষ্ট প্রাঙ্গণ। রথের রেসগুলি রোমের যুদ্ধজয়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। যুদ্ধজয়ের উদ্ধত কীর্তিস্তম্ভের পাশাপাশি ধর্মীয় মঠ, মন্দির, মাজার, মূর্তি। যেন এক রোমান মিউজিয়াম। শাসকের ধর্মশাসন। বিনোদন, ধর্ম, রাজনীতি ক্ষমতা সার্কাসের এরিনায় একসূত্রে বাঁধা।

স্পাইনা অর্থাৎ রেসিং ট্র্যাকগুলির মধ্যে যে বিভাজন, সেখানে স্থান পেত যুদ্ধজয়ের স্মারক। ইজিপ্ট রোমানদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করলে ইজিপ্ট জয়ের স্মারকস্তম্ভ স্পাইনায় এমনভাবে রাখা হয়  যাতে প্রজারাও সার্কাসে এসে রণবিজয়ের হুঙ্কারে রোমের আধিপত্যের উল্লাসে মাতে। গৃহযুদ্ধে জয়ী হলে সম্রাট অগাস্টাস সার্কাস ম্যাক্সিমাসে স্মারকস্তম্ভ রাখেন।জুলিয়াস সিজার ম্যাক্সিমাসের সংস্কারে হাত দেন রাজনৈতিক সমর্থন লাভের আশায়। সার্কাসে সম্রাটের আসন এমন জায়গায় যে গোটা ম্যাক্সিমাসের দর্শক তাঁকে দেখতে পায়। লুডির উদ্বোধন হত কুচকাওয়াজ দিয়ে- রথের রেসের প্রতিযোগী, গ্ল্যাডিয়েটর, জন্তু-জানোয়ার। সম্রাট নিজে এই কুচকাওয়াজের নেতৃত্ব দিতেন।  রোমান  দর্শক স্যালুট ঠুকত। আনুগত্য ও দেশাত্মবোধ একাকার।

লাল নীল সবুজ সাদা রথের দলগুলি ক্ষমতার অলিন্দে পদচারণা করা রোমান তরুণদের পরিচলানায়। গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা শাসকের। লুডির সময় স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন সম্রাট ও অভিজাতবর্গ। শাসকের সাথে প্রজাদের মিলনমঞ্চ ছিল সার্কাস ম্যাক্সিমাস। সেখানে শাসক শ্রেণী প্রথম শ্রেণির নাগরিক। সার্কাস ম্যাক্সিমাসের উৎসব দর্শকের মনে আনত দশপ্রেমের ঢেউ।  তারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি। শাসকরা কখনো ম্যাক্সিমাস বন্ধ করে দেন নি বা বন্ধ করার সাহস দেখান নি।

গুরুতর অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী , বিশ্বাসঘাতক, বিদ্রোহী বা ফসল বিনষ্টকারীদের জনগণের সামনে প্রাণদণ্ড দেওয়া শুধু শাস্তিদানের আসর ছিল না, ধর্মদ্রোহী রাষ্ট্রদ্রোহীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানের প্রকাশ্য আসর আসলে প্রজার ওপর শাসকের নিয়ন্ত্রণ, প্রজাকে শিক্ষা দেওয়া ও আনুগত্য আদায় করার আসরও। একইসঙ্গে শাসক ও  প্রজার মাঝের বিভেদরেখা মুছে দিয়ে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির আসর। উদারতা প্রদর্শনের মঞ্চও। রথরেস শুরু হওয়ার আগে রোমান সম্রাটদের শিশুদের আশীর্বাদ করা একটা ট্র্যাডিশন। রাজশক্তি প্রসাদ বিলোতো প্রজাদের- খাবার, পুরস্কার, অর্থ। একই সঙ্গে সম্রাটদের সাথে গণ্যমান্য ব্যক্তির মিলিত হওয়ার আসর।প্রভাব প্রতিপত্তি দেখানো ও প্রভাব খাটানো, রাজনৈতিক সমর্থন আদায়। সার্কাস ম্যাক্সিমাসে একটা দিন কাটানো শাসকের কাছে এক বড় সুযোগ।  গোটা রোম ডুবে থাকত সার্কাসে। নীতিহীনতা, প্রশাসনিক পঙ্গুত্ব, শোষণের শ্বদন্ত ঢেকে দিতে চাইত শাসক সার্কাসের মদিরায়। রোমের দ্বিতীয় শতকের স্যাটায়ারিস্ট কবি জুভেনালের (juvenal) কলম থেকে প্রবাদে পরিণত হওয়া সেই অমোঘ শব্দবন্ধ – গিভ দেম ব্রেড এন্ড সার্কাস এণ্ড দে উইল নেভার রিভোল্ট।

রোমান উপকথায় একদিন যে খেলাধুলার প্রাঙ্গণের গায়ে লেগেছিল সাবাইন মেয়েদের ধর্ষনের কলঙ্ক, যে পুরুষতান্ত্রিক রোমান সভ্যতায় যৌনসঙ্গী ও সন্তান ধারনের যন্ত্র হিসাবে নারীর স্বীকৃতি, সেই রোমান সভ্যতা সার্কাস ম্যাক্সিমাসের বিনোদিনী ক্রীড়ার আসরে নারীকে জানিয়েছিল স্বাগত । প্রাচীন রোমের একমাত্র আসর যেখানে পুরুষদের পাশে বসে রোমান নারীও খেলা দেখতে পারত। ম্যাক্সিমাসের গ্যালারি নারী-পুরুষের সঙ্গী খুঁজে নেবার মঞ্চ। ট্র্যাকে যখন রক্ত ঝরছে প্রতিটি ল্যাপে, দর্শকাসনে তখন ‘বনের বসন্ত এলো, এলো, মনের বসন্ত এলো’। এর পিছনে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল কিনা তা প্রাচীন রোমান সেনেটের পাথুরে আসন জানে কিন্তু  সার্কাস ম্যাক্সিমাসের প্রত্যেক লুডির নয় মাস পরে রোমে নাটকীয়ভাবে সন্তান প্রসব বেড়ে যেত। রোমান উপকথায় সাবাইন মহিলাদের ধর্ষনের কলঙ্ক লাগা খেলার আসর ছিল রোমুলাসের প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার মরিয়া প্রয়াস।সেই ট্র্যাডিশন চলেছে হাজার বছর ধরে, শুধু মেয়েদের আর্তনাদ বদলে গিয়েছে ভালোবাসার সমর্পণে। পুরুষতান্ত্রিক রোমান সভ্যতায় সার্কাস ম্যাক্সিমাসের মুক্ত মঞ্চ প্রাচীন রোমান নারীজাতির কাছে  এক পোয়েটিক জাস্টিস।

রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যের সুদীর্ঘ ভাঙাগড়ার রোমান যাত্রাপথে ঘোড়ার খুরের ধুলোয়, রথের চাকার ঘূর্ণনে, বন্য জন্তুর ভয়াল লম্ফনে, গ্ল্যাডিয়েটরের তরবারিতে, রক্তের হোলিখেলায়, লাখো মানুষের উল্লাসে-কান্নায়-হুঙ্কারে, হাজার বছরের পরিক্রমায় সার্কাস ম্যাক্সিমাসের হাপরে টান ধরল যখন, ততদিনে রোমান সাম্রাজ্যের সূর্যও দিকচক্রবালে ঢলে পড়ছে। রোমান সূর্যাস্তের দেরি নেই আর। রোম সাম্রাজ্য শেষ হয়েছিল ৪৭৬ খ্রীস্টাব্দে। আরও তিয়াত্তর বছর সার্কাস ম্যাক্সিমাস টিকে ছিল। বিবর্ণ হতে হতে, প্যালেটাইন পাহাড়ের অন্ধকার বুকে নিয়ে ম্যাক্সিমাস নিশ্চুপ হলো ৫৪৯ খ্রীস্টাব্দে। ম্যাক্সিমাসে শেষ রথের রেস। শেষ হলো এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের।

ম্যাক্সিমাসের শেষের দিনগুলোয়, রোমের অভ্যন্তরীণ সঙ্কটে খেলাধুলা ধীরে ধীরে পিছনের সারিতে চলে গেল, অবহেলিত হয়ে পড়ল। রোমের সাংস্কৃতি সার্কাস ম্যাক্সিমাসকে ঘিরে আবর্তিত হত। কলোসিয়াম তৈরীর ফলে সার্কাসের উত্তেজনা ও  আবেগ ধীরে ধীরে কলোসিয়ামগামী হল যেমন, তেমনি রোমের সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের ঝোড়ো ঝাপটা সজোরে আঘাত করল ম্যাক্সিমাসকে। রাজনৈতিক ভূমিকম্পে ক্ষমতার কুর্সী টালমাটাল হলে, শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রমশঃ ভাটার টান আসে। এ সত্য চিরকালীন। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে ম্যাক্সিমাস কখনো বাজার হিসাবে, কখনো গ্যাস সাইট হিসেবে , নানান কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ম্যাক্সিমাসে রাখা স্মারকস্তম্ভ, স্মৃতিসৌধ, দেবদেবীর মূর্তি শহরের অন্যান্য জায়াগায় স্থান পাচ্ছে। টাইবার নদীর ঘনঘন বন্যার আঘাতে আঘাতে, সার্কাসের ট্র্যাক মাটির ছয় মিটার গভীরে চলে যেতে যেতে, রোমের একসময়ের  বিস্ময়কর স্থাপত্য ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে হতে, শাসকের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে মুছে যেতে যেতে, ম্যাক্সিমাস সিডবল ছুঁড়ে দিচ্ছে সার্কাসের, দূর-সুদূরের দিকে। ধ্বংস হলেও ম্যাক্সিমাসকে ঘিরে চিরকালীন আবেগ রয়ে গেল। দুহাজার ছয়ের এর ফুটবল বিশ্বকাপ জয়ের পর এই প্রাঙ্গণেই ইতালির বিজয় উৎসব। সার্কাস ম্যাক্সিমাস বেঁচে রইল ইতালির আবেগে। বেঁচে রইল সার্কাসের ইতিকথায়। এক চিরকালীন গাথা।

রোমের পতনের পর ইউরোপ থেকে  সার্কাসের বর্ণময় উপস্থিতি মুছে গেল। ভ্রামণিক শোম্যানরা শহরে শহরে ঘুরে ঘুরে সরাইখানায়, মেলায়, জমায়েতে খেলা দেখাতে লাগল। প্রাচীন রোমান সভ্যতায়  অ্যাক্রোব্যাটিক রাইডারদের বলা হতো ডেসাল্টোরেস(desultores)। পাশাপাশি চারটি ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে একটা থেকে আর একটায় লাফ দিয়ে খেলা দেখাত তারা। এরকমই একজন,  ফ্লোরোয়াস,  আস্তাবলে ঘোড়া দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত, দশম শতাব্দীতে ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে চেপে ক্ষুরের মতো ধারালো তরবারি নিয়ে জাগলিং দেখিয়ে বাইজেন্টাইন মানুষদের বিনোদন দিতেন। প্রাচীন রোমান সার্কাস ও আধুনিক সার্কাসের মাঝে যোগসূত্র হয়ে রইল ইউরোপের জিপসি সম্প্রদায়। ব্রিটেনে পঞ্চদশ শতাব্দীতে জিপসিদের সূত্রে এলো সার্কাসীয় দক্ষতা আর জন্তু জানোয়ারের প্রশিক্ষণ। আর আধুনিক সার্কাস এল অষ্টাদশ শতকে। ইংলণ্ডেরই ফিলিপ অ্যাস্টলের ঘোড়ার খুরে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply