সার্কাসের ইতিকথা : প্রান্তজনের করতালি। পর্ব ৪। বরুণদেব
টাইবার ও আর্নো নদীর মাঝে প্রাচীন ইতালির এট্রুরিয়াকে (Eturia) কেন্দ্র করে যে সভ্যতা বিস্তার লাভ করেছিল রোমের উত্থানের সাথে সাথে সে সভ্যতার পতন। রোমানরা ছিল মিশ্র জাতি। প্রাচীন ইতালির ল্যাটিন, সাবিন, ইট্রুস্কান এই তিন উপজাতি পরস্পর মিশে গিয়ে রোমান জাতি গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন গ্রীক ঐতিহাসিক ডায়োনিসিয়াস অফ হালিকারনাসাসের (Dionysius of Halicarnassus) মতে রোমের শুরুর দিন থেকে শুধু ইতালির নয় প্রায় সমগ্র পৃথিবী থেকেই অভিবাসীরা এসে রোমান সভ্যতায় মিশেছিল। প্রাচীন রোমে যে ক’জন এট্রুস্কান বংশদ্ভুত রাজা রোমের সিংহাসনে বসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম ছিলেন লুসিয়াস টারকুইনিয়াস প্রিসকাস । তাঁর আটত্রিশ বছরের রাজত্বকাল প্রাচীন রোমের ইতিহাসে এক মাইলফলক। তিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামগুলিকে নিয়ে নগরের রূপ দিলেন, সেচ ও জল নিকাশের ব্যবস্থা করলেন, কাঠের কুঁড়েগুলিকে পাথরের করে দিলেন। ল্যাটিন সাবিন, এট্রুস্কানদের যুদ্ধে পরাজিত করে রোমের সীমানা নিলেন বাড়িয়ে।
রোমের সিংহাসনে বসে প্রিসকাস প্রাচীন লাতিয়াম শহর Apiolae এপিওলার দখল নিলেন, লুটপাট চালালেন এবং রোমে ফিরে এসে স্থির করলেন, প্রথম যুদ্ধজয়ের কীর্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে এক মহা উৎসবের আয়োজন করতে হবে।বসল ক্রীড়া উৎসবের আসর। বেছে নিলেন অ্যাভেন্টাইন ও প্যালেটাইন (Palatine) পাহাড়ের মাঝে মার্সিয়া উপত্যকা। রথের রেস। বক্সিং। ছ’শো একুশ মিটার লম্বা, একশো আঠারো মিটার চওড়া একটা বালুকাময় ভূমিকে ঘিরে রেসের ট্র্যাক, চারদিকে কাঠের বেড়া। রেসের ট্র্যাকের বিভাজিকায় টাইবার নদীর প্রবাহকে ব্যবহার করে রেসের আয়োজন। ল্যাণ্ডস্কেপে কৃষিজমি। এট্রুরিয়া থেকে এলো বক্সার, এলো ঘোড়া। অভিজাতদের জন্য ১২ ফুট উঁচুতে পৃথক বসার ব্যবস্থা হলো। শুরু হলো সার্কাস ম্যাক্সিমাস। শুরু হলো সার্কাসের ইতিকথা।খেলাধুলা ও হিংস্রতা – এই দুটি বৈশিষ্ট্য সার্কাস ম্যাক্সিমাস ও রোমান সংস্কৃতির সাথে জুড়ে গেল। সার্কাস ম্যাক্সিমাস হাজার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে আসর বসিয়ে চলল। জনপ্রিয় হলো। অভিজাত হলো। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতার, রোমান পরম্পরার এক গর্বোদ্ধত প্রতীক হয়ে উঠল।
ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত হাজার বছর ধরে রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যের পথে রোম যেমন যেমন প্রসারিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে, সার্কাস ম্যাক্সিমাসও শাসকের যাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় গ্রীক হিপোড্রোমের সমতুল্য হয়ে উঠেছে। এক বিস্ময়কর স্থাপত্য হয়ে উঠেছে একদিকে, আর এক দিকে রোমান সভ্যাতার এক জনপ্রিয় ও দাম্ভিক প্রতিষ্ঠান হয়ে গিয়েছে, যাকে ঘিরে রোমান ধর্ম ও সংস্কৃতি, ক্ষমতা ও শাসন, বিনোদন ও সমাজ হাত ধরাধরি করে ব্যাল্যান্সের খেলা দেখিয়েছে। প্রিসকাসের সার্কাস ম্যাক্সিমাস, জুলিয়াস সিজার ও অগাস্টাসের হাত ধরে ধ্রুপদী রূপ পেল। রোমান সাম্রাজ্যের (এম্পায়ার) সময়টা সার্কাস ম্যাক্সিমাসের স্বর্ণযুগ। রথের রেসের জন্য বারোটি গেট। স্টেডিয়ামের কাঠামোটি দৈর্ঘ্যে দু’হাজার ফুট, প্রস্থে তিনশো নব্বই ফুট, তিনতলা সমান উঁচু। নিচে দোকান। রোমান রিপাবলিকের যুগে লটারিতে স্টল দেওয়া হলো। দোকানগুলির মাঝবরাবর দর্শকদের প্রবেশ-প্রস্থান পথ। সে পথ এতটাই প্রসস্থ যে দেড়লাখ (মতান্তরে আড়াই লাখ) দর্শকের সমাগমে পদপিষ্ট হবার ঘটনা ঘটে নি সার্কাস ম্যাক্সিমাসের ইতিহাসে। ম্যাক্সিমাসের স্থাপত্যে কংক্রিট ও মার্বেলের ব্লক আসার আগেই সেখানে দেড়-দু লাখ দর্শক খেলা দেখত। অভিজাত শ্রেণীর জন্য কাঠের কাঠামোর দর্শকাসন,পরে সাধারণের জন্যও, আরও পরে নিচের দুটি টায়ার কংক্রিট ও পাথরের, উপরেরগুলি কাঠের। সেনেটারদের জন্য ট্র্যাকের ধারে পাথরের আসন। সার্কাস ম্যাক্সিমাসের খনন থেকে উঠে আসা এক পাথরের আসনের গায়ে ৪৯৪ খ্রীস্টপূর্বাব্দের এক শিলালিপি জানান দিচ্ছে, সেটি মানিয়াস ভালেরিয়াস নামে কোনো এক ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য সংরক্ষিত।
বারবার আগুনের গ্রাসে পুড়েছে, ভেঙেছে সার্কাস ম্যাক্সিমাস। এগিয়ে এসেছেন রোমের শাসকরা। রোম যখন প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যের পথে হাঁটছে, ৩১ খ্রীস্ট পূর্বাব্দের দিকে ভয়ঙ্কর আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সার্কাস।সংস্কারে হাত দেন অগাস্টাস। ৩৬ খ্রীস্টাব্দে আবার বিধ্বংসী আগুন। ঝুড়ি তৈরীর দোকান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হল ম্যাক্সিমাস। পাথর ও মার্বেলে মুড়ে দিলেন দিলেন সম্রাট টিবেরিয়াস (Tiberius) । দিলেন দোকানদারদের ক্ষতিপূরণ । ৬৪ খ্রীস্টাব্দে আবার আগুন লাগে। আবার ব্যাপক মাত্রায় সংস্কার। এই বারবার আগুন লাগা ও সংস্কারের মধ্যেই একবার গ্যালারি ভেঙ্গে তেরোশো মানুষের মৃত্যু। প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে সার্কাস ম্যাক্সিমাস পুরোপুরি পাথরের হয়ে গেল। এইসব সংস্কার চলাকালীন কিন্তু সার্কাসের বর্ণাঢ্য ঘেলাধূলা বা উৎসব বন্ধ হয় নি। সার্কাস ম্যাক্সিমাস এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে প্রায় প্রত্যেক প্রধান রোমান শহরে একটি করে সার্কাস তৈরী হয়েছিল সার্কাস ম্যাক্সিমাসকে মডেল করে।
খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে খৃস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী- হাজার বছরের পরিক্রমায় সার্কাস ম্যাক্সিমাস রোমের বিনোদন, ধর্মীয় উৎসব, রাজনৈতিক ক্ষমতার জনসংযোগ ও পেশীশক্তি প্রদর্শনের এক প্রাতিষ্ঠানিক মঞ্চ। রথের রেসগুলি সাত ল্যাপের। লাল, নীল, সাদা, সবুজ রঙের রথগুলি নিয়ে ছোটে চার, ছয়, আট বা বারো ঘোড়ার দল। পরিচালনায় রোমান অভিজাত সম্প্রদায়ের তরুণরা। সেগুলি ঘিরে জনতার জুয়া। জেতা বা হারা। পছন্দের প্রতিযোগী জয়ী হলে, নায়কের মর্যাদা পেলে, সেই জয়ের মাঝে নিজ জীবনের দুঃখ, শোক, দাসত্বের পরিত্রাণ খোঁজা। আর তার রক্তে সার্কাসের মাটি ভিজে গেলে, শেষ নিঃশ্বাসের সাক্ষী হয়ে, সব হারানোর বেদনা নিয়ে, ফেরে দর্শক। অথবা ফেরে না। প্রিয় নায়কের পরাজয়ের হতাশায় যন্ত্রণায় টিকে থাকার জীবনকে বিদায় জানাতে আত্মাহুতির পথ বেছে নেয়। ঘোড়ার খুরের টগবগ, রথের চাকার ঘরঘর , লাখো দর্শকের চিৎকার অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ করে প্রতিযোগীদের কোশে কোশে। তারা হুঙ্কার দিয়ে ছুটে চলে সার্কাস ম্যাক্সিমাসের ট্র্যাকে। পরস্পরকে আক্রমণ। জেতার জন্য। বাঁচার জন্য। টিকে থাকার জন্য। জুয়া খেলে দর্শক। জুয়া খেলে প্রতিযোগীরাও। মৃত্যুর সঙ্গে। দাসত্বের সঙ্গে। দারিদ্র্যের সঙ্গে। সার্কাস ম্যাক্সিমাসের জনপ্রিয় রথের রেসে কখনও ভয়ংকর দুর্ঘটনা হয় নি বা একজনেরও মৃত্যু হয় নি, এমন ঘটনা বিরল। অভিজাত সার্কাস ম্যাক্সিমাসে কোনো দাসের মাথায় বিজয়ীর মুকুট মানে দাসত্বের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলে মুক্ত মানুষ হওয়া। যারা রেস সম্পূর্ণ করতে পারত তারা অন্ত্যজদের মধ্যে জনপ্রিয় ও সেলিব্রিটি হয়ে যেত। বিজয়ীর মুকুট নিয়ে আসত বিপুল অর্থ, পুরস্কার, খ্যাতি। বিখ্যাত সারথীরা এক ঘণ্টায় যা রোজগার করতেন তা একজন রোমান আইনজীবীর রোজগারের একশ গুণ। সার্কাস ম্যাক্সিমাসকে মডেল করে পরবর্তীকালে আরও কিছু সার্কাস- সার্কাস ফ্লামিনিয়াস, সার্কাস নেরোনিক্স, সার্কাস ম্যাক্সেন্টিয়াস গড়ে উঠলেও, সার্কাস ম্যাক্সিমাসের বিজয়ীর মুকুট সবচেয়ে অভিজাত। বিজয়ীরা হয়ে উঠত জনতার ডার্লিং। যেমন স্করপাস, দু’হাজারেরও বেশি রেস জিতেছিলেন।
(ক্রমশ)
