সার্কাসের ইতিকথা : প্রান্তজনের করতালি। পর্ব ৩। বরুণদেব

0

গত পর্বের পর

রোমে যারা এসেছিল, তারা সবাই পুরুষ। নারীবিহীন রোমের স্থায়িত্ব তাই একটা প্রজন্ম মাত্র। অতএব এক আমি বহু হব-র উপায় খুঁজতে সেনেটের সঙ্গে পরামর্শ করে রোমুলাস দূত পাঠালেন পার্শ্ববর্তী নগরগুলিতে- রোমান পুরুষদের জন্য কন্যা সম্প্রদান করুন। নিষ্ফল হল  সে আবেদন। রোমুলাস ভিন্ন পথ নিলেন।

শস্যরক্ষার দেবতা নেপচুনের আরাধনায় এক বর্ণাঢ্য উৎসবের আয়োজন নতুন শহরে। দেদার আয়োজন। খাদ্য, মদ্য, বিনোদন। গ্রীকদের কাছে জনপ্রিয় ছিল ঘোড়ায় টানা রথের রেস। উৎসবের আয়োজনে থাকল সে রেসের বিনোদন। রইল ঘোড়দৌড়। বন্যপ্রাণীর প্রদর্শনী। দিকে দিকে চলল প্রচার। আসুন, সকলে মিলে নতুন নগরের এ ধর্মোৎসবে  যোগ দিন। সাড়া মিলল। দলে দলে লোক সে উৎসবে যোগ দিতে রোমে এল। অবাক হয়ে দেখল রোমের দ্রুত উত্থান। নিকটবর্তী শহর কাইনিনা (Caenina) থেকে লোক এল। ক্রাস্টুমিনাম শহর (Crustuminum)  থেকে লোক এল। অ্যান্টেম্না (Antemnae) থেকে এল। সাবাইন পুরুষরা এল। আর তাদের সাথে দলে দলে এল স্যাবাইন মেয়েরা।

ক্রীড়াঙ্গনে যখন খেলা শুরুর কাউণ্টডাউন চলছে, খাদ্য-মদ্যে সম্পৃক্ত দর্শক যখন খেলার দিকে মনোনিবেশ করছে, সেইসময় রোমান সেনেট থেকে সঙ্কেত গেল রোমান যোদ্ধাদের কাছে। যে যার নিকটবর্তী নারীর হাত ধরল। অপহৃত হল সাবাইন মেয়েরা। আগে থেকেই চিহ্নিত করা সুন্দরীদের সেনেটারদের ঘরে পৌঁছে দিল অন্ত্যজরা। রোমান পুরুষ পেল নারী। স্থায়িত্ব পেল রোম নগরী। কুরুক্ষেত্র থেকে রোম- যুগে যুগে দেশে দেশে ক্রীড়ামঞ্চ রাজনৈতিক ক্ষমতার আস্ফালনের রেস, নারীত্বের অপমান, লাঞ্ছনার ক্লেদাক্ত প্রাংগণ। সে মঞ্চ কোথাও পাশা খেলার, কোথাও রথের রেসের। সে নারী কোথাও পাঞ্চালী, কোথাও সাবাইন।

ক্ষোভে অপমানে অভিশাপ দিতে দিতে স্যাবাইন পুরুষরা রোম ছাড়ল। প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধ হল শুরু। স্যাবাইন বনাম রোমান। দুধর্ষ রোমুলাস বাহিনীর হাতে পরাজিত হল  স্যাবাইনরা। এ যুদ্ধজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে কাপিটোলাইন (capitoline) পাহাড়ের ওপর জুপিটারের মন্দির বানাল রোমানরা। রোমের প্রথম মন্দির।

রোমুলাস রোমের স্যাবাইন মেয়েদের বললেন, রোমান পুরুষকে স্বামী হিসাবে মেনে নিলে তারা  রোমের নাগরিকত্ব পাবে। সন্তান উৎপাদন ও প্রতিপালনের মেশিন হিসাবে ব্যবহৃত হওয়া সেই বিশ্বে নারীর কাছে এ বড় কম পাওনা নয়। মেয়েরা সে যুগে নাগরিকত্ব পেত না।

স্যাবাইন -রোমান যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হল। স্যাবাইন রাজা টাটিয়াস( Tatius) এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলে এক রোমান কম্যান্ডারের মেয়েকে ঘুষ দিয়ে নগরীর প্রবেশদ্বার খুলিয়ে রোমে ঢুকে পড়লেন এক রাতে। পরদিন রোমানরা দেখল, দুর্গের দখল নিয়েছে স্যাবাইনরা। প্যালেন্টাইন (Palatine) ও ক্যাপটাইন পাহাড়ের মাঝে যুদ্ধ বাঁধল। পিতা বনাম স্বামীর দ্বৈরথ বন্ধ করতে দু’দলের মাঝে দাঁড়াল রোমের স্যাবাইন মেয়েরা। যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে সন্ধি হল। রোমান রোমুলাস ও স্যাবাইন টাটিয়াস যৌথভাবে রোমের শাসক হলেন। কয়েক বছরের মধ্যে এক যুদ্ধক্ষেত্রে টাটিয়াসের মৃত্যু। রোমের একচ্ছত্র শাসনভার এলো রোমুলাসের হাতে। রোমুলাসের ছত্রিশ বছরের শাসনে রোম হয়ে উঠল এক ঈর্ষণীয়  সামরিক শক্তি।

রেমাস-রোমুলাস ও রোম নগরীর  পত্তনের এই যে জনপ্রিয় লোকগাথা, তা কতখানি ঐতিহাসিক আর কতখানি গল্পগাথা তার মীমাংসা ভেসে গিয়েছে টাইবার নদীর স্রোতে। রোম নগরীর ইতিকথায় এই গল্পগাথা এতই জনপ্রিয় যে খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে এই মিথকে নিয়ে ‘উলফ এন্ড টুইনস’-এর ব্রোঞ্জ মূর্তি বানানো হয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, এই আখ্যানে কিছু ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকতে পারে। ৫৯ খ্রীস্টপূর্বাব্দে জন্মেছিলেন  রোমান ঐতিহাসিক লিভি । তিনি এই পৌরাণিক কাহিনীতে কিছু যুক্তি আরোপ করেছেন। রাজার কঠোর শাস্তি এড়াতে রেমাস ও রোমুলাসের গর্ভধারিনী কুমারী মা  সিল্ভিয়া তাঁর মানবপ্রেমকে দৈবপ্রেমের নামে চালিয়েছিলেন। প্রেমিক হয়ে গিয়েছিল  দেবতা মার্স। যুগে-যুগে দেশে-দেশে বিভিন্ন পুরাণকথায় কুমারী মায়েদের ঔরসে জন্ম নেওয়া শিশুরা-  কোথাও কর্ণ, কোথাও রেমাস-রোমুলাস। তাদের পিতা কোথাও সূর্য, কোথাও মার্স। লিভির মতে রোমাস-রোমুলাসকে টাইবার নদীর ধার থেকে উদ্ধার করা  স্ত্রী-নেকড়েটি আদতে এক রূপোপজীবী। অপভাষায় বেশ্যাকে বলা হত ‘সি-উলফ’ বা স্ত্রী-নেকড়ে। মেষপালকের স্ত্রী-ই আসলে স্ত্রী-নেকড়ে।

ঐতিহাসিক ও প্রত্নত্বাত্বিকদের মতে রোমান সভ্যতার উন্মেষের কারিগর ল্যাটিনভাষী একদল মানুষ যারা খ্রীস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে টাইবার নদীর ধারে প্যালেন্টাইন পাহাড়ের উর্বর উপত্যকায় কৃষিভিত্তিক বসতি গড়ে তুলেছিল। রোমের পত্তনে মধ্য ইতালির শক্তিশালী এট্রুস্কান সভ্যতার  (etruncan) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ধীরে ধীরে সেই কৃষিপ্রধান গ্রাম সাত পাহাড়ের শহর রোম হয়ে উঠে রোমান সভ্যতার সূচনা করেছিল, যে সভ্যতা প্রায় গোটা ইউরোপ, এশিয়া  মাইনর, উত্তর আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম রাজত্ব হয়ে উঠেছিল।

এট্রুস্কান শব্দ ‘রুমা’ (Ruma) বা গ্রীক শব্দ ‘রোম’ Rho-me যেখান থেকেই ‘রোম’ শব্দটি আসুক না কেন, তার মূলগত অর্থ – শক্তি (power), ক্ষমতা (might)। সে অর্থ প্রায় বারোশো বছরের রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে সার্থক রূপ পেয়েছিল। সেই সংস্কৃতির একটি প্রধান স্তম্ভ সার্কাস ম্যাক্সিমাস।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply