রুরাল লাইফ ইন বেঙ্গল। কোলস্ওয়ার্দি গ্রান্ট। পর্ব ৮। অনুবাদে অর্ণব রায়

শ্রীরামপুর
শ্রীরামপুর বানিয়েছিল ডেন-রা, ১৭৫৫ সালে। ১৮০৮ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তাদের হাত থেকে নিয়ে নেয়। ১৮১৫ সালের শান্তিচুক্তিতে তার আবার ডেনমার্ক ফিরে পায়। ১৮৪৫ পর্যন্ত ডেনমার্ক সরকার এই শহর নিজের অধিকারে রাখতে পারে। তারপর ব্রিটিশরা বারো লাখ টাকা বা ১২০০০০ পাউন্ড দিয়ে এই শহর ডেনমার্কের কাছ থেকে কিনে নেয়। ইংরেজদের কাছে নিজেদের স্বত্ত্ব ছেড়ে দেওয়ায় ইংরেজ ঋণদাতাদের কাছে আশ্রয় নেওয়ার সুবিধে এদের বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজদের ঋণ দেওয়ার পদ্ধতির হাত থেকে শুধু এদের মুক্তি ঘটে। কোনও দাবীদার চাইলে ডেনিশ কোর্টের দড়জায় কড়া নাড়তেই পারে। যদিও খুব কম লোকই সেই যন্ত্রণা নিতে চায়।
বাংলায় প্রথম যে মিশনারী কার্যকলাপ হয়েছিল, শ্রীরামপুরের সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। বাংলায় আসা বিখ্যাত মিশনারি ফাদাররা, ডঃ ক্যারি আর মার্শম্যান, মিঃ ওয়ার্ড, যাদের কথা ভারতের বইপত্রে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, সবাই এখানেই প্রথম এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন আর শ্রমদান করেছিলেন [1]। এখানকার কলেজটি, যেটি একেবারে নদীর পাড়ে অবস্থিত, ১৮১৮ সালে স্থাপিত হয়। ডেনমার্কের সরকার এই কলেজটির জন্য জমি দান করেছিল। শোনা যায়, শ্রীরামপুরের মিশনারীদের ব্যাক্তিগত তহবিল থেকে এই কলেজটি বানানো হয়েছিল। কলেজের বর্তমান উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আশেপাশের দেশীয় ছেলেদের ভালো শিক্ষা দেওয়া নয়, ভালো শিক্ষক তৈরি করা ও কলকাতার ব্যাপ্টিস্ট মিশনারী সোসাইটির জন্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত মিশনারী তৈরি করাও। বর্তমানে প্রায় আধডজন পূর্ব ভারতীয় ছাত্র এই তৃতীয় উদ্দেশ্যে শিক্ষালাভ করছে।
কলেজের ঠিক পাশে, সেটা এলাকা অনুযায়ী এবং কলেজের সুবিধে অনুযায়ীও বটে, রয়েছে বাস্পে চলা কাগজ তৈরীর কারখানা। এই কারখানা শুধুমাত্র প্রথম কাগজ তৈরীর কারখানা নয়, ভারতে স্থাপিত প্রথম স্টিম ইঞ্জিনও বটে। আর সে ইঞ্জিন এখনও চালু অবস্থায় আছে। এই দেশ এই ইঞ্জিন নিয়ে এখনও অহংকার করে। এইদেশে এই ইঞ্জিন আর কারখানা স্থাপনের পুরো কৃতিত্ব মিঃ মার্শম্যানের। এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল মিশনারী কার্যকলাপের জন্য কাগজ তৈরি করা। সেই কারখানা এখনও চলছে। মিঃ মার্শম্যানের সুযোগ্য পুত্র মিঃ জন মার্শম্যান এখান থেকেই তার যোগ্য সম্পাদনায় সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সবচেয়ে প্রতিভাবান স্থানীয় খবরের কাগজ, ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া, এই শ্রীরামপুর থেকেই প্রকাশ করে থাকেন। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় খবরের কাগজ তার প্রধান বিক্রির ক্ষেত্র থেকে ষোল মাইল দূরে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হচ্ছে।
ব্যারাকপুর থেকে মাইল তিনেক উত্তরে গেলে নদীর একই পাড়ে একটা খুব সুন্দর দেখতে ভিলা চোখে পড়বে। উঁচু উঁচু গাছে ছাওয়া। সামনে রুচিপূর্ণ বাগান। এই বাড়িতে, এই ছাদের তলায় আমার অনেক মনোরম দিন কেটেছে। এই দিনগুলি আমার ভারতবর্ষে ঘুরে বেড়ানোর পুরো সময়টার মধ্যে অত্যন্ত আলোকোজ্জ্বল অধ্যায়। জায়গাটা ইছাপুর। মেজর ডাব্লিউ অ্যান্ডারসন, সি বি-র বাসস্থান। তিনি অনারেবল কোম্পানীর গানপাওডার কারখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক। কারখানাটা তার বাসস্থানের পেছন দিক থেকে একটুখানি দেখতে পাওয়া যায় [2]।
ইছাপুর হাউসের একটু নিচের দিকেই রয়েছে ফেরিঘাট। শহর থেকে যারা আসে তাদের কাছে এই ঘাট পলতা ঘাট নামে পরিচিত। সাধারণভাবে বলতে গেলে, এই ঘাট হল টার্মিনাস। কলকাতা থেকে মাল ও যাত্রীবাহী নৌকা এখানে এসে খালাস হয়। যাত্রীরা এখানে নেমে নদী পার করে উত্তর পশ্চিমের বিখ্যাত ডাক রাস্তা ধরে। ফেরিঘাটের উল্টো পাড়ে দুখানা সমাধিসৌধ রয়েছে। বলা হয়, তাদের মধ্যে একখানা বানানো হয়েছে একজন ইংরেজ ভদ্রলোকের স্মৃতিতে যিনি খুন হয়েছিলেন। আর আমার বিশ্বাস, এখানেই প্রথম দিকে বানানো ডাকবাংলোগুলির একটিকে পাওয়া যাবে। আর যেমনটি আমি ইতিমধ্যেই বলেছি, এগুলি যাত্রীদের সুবিধের জন্য বানানো।
এগোতে এগোতে আমরা এবার একটি অত্যন্ত সাধারণ দেখতে অনাকর্ষনীয় স্থানীয় ছোট শহরের পাশ দিয়ে যাব, নাম বুদ্দেশ্বর (ভদ্রেশ্বর)। যদিও এই শহরটি খাদ্যশস্যের একটি বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ বাজার। আর দেখেই বোঝা যায় এটি একটি ঘনবসতিপূর্ণ ব্যস্ত এলাকা। আরও বারো মাইল এগিয়ে গেলে নদীর একই পাড়ে, অর্থাৎ পশ্চিম পাড়েই চোখে পড়বে ফরাসী উপনিবেশ চন্দননগর। এখানে নদীর ধারে সরকারী উঁচু বাড়ি ও গুদামঘরগুলির মাথায় ফরাসী তেরঙ্গা পতাকা উড়তে দেখা যাবে।
চন্দননগরের কিন্তু একটি অত্যন্ত সাংঘাতিক ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। বলা হয়, কলকাতা যখন কয়েকটা মাটির কুটির দিয়ে গড়া একটা গ্রামমাত্র ছিল, তখন এই চন্দননগর একটি বিস্তৃত আর উন্নত শহর ছিল। আর মোটামুটি একশ বছর আগে এই শহরেই ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যে সংক্ষিপ্ত কিন্তু ধুন্ধুমার লড়াই হয়েছিল। সেই যুদ্ধে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন মাত্র তিনজন যুদ্ধবাজ বীর সঙ্গীকে নিয়ে কামান দাগতে দাগতে এই শহরটির দখল নিয়েছিলেন (তবে এখন আর ওইরকম বড় বড় জাহাজ নিয়ে নদী বেয়ে আসা সম্ভব নয়। নদীতে অত গভীরতাই নেই!) পরে ১৮১৫ সালে আমাদের ফরাসী বন্ধুরা এই শহরটিকে পুনরায় তাদের দখলে নিয়ে আসে।
আরও খানিকটা এগিয়ে গেলে, মোটামুটি মাইল তিনেক পরে নদীর একই পাড়ে পড়বে ডাচ বসতি চিনসুরা বা চুঁচুড়া। কপাল যদি ভালো থাকে আর স্রোতের টান যথেষ্ট সময় পর্যন্ত থাকে তাহলে মোটামুটি বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমরা এখানে পৌঁছে যাব। আর এখানেই আমাদের প্রিয় বন্ধু জি— থাকে। তাদের সঙ্গে দেখা হলেই তাদের আতিথেয়তার টানে এখানে রাতটুকু কাটিয়ে যেতে লোভ হয়। আর যদি তাড়া না থাকে, আরও কয়েকদিনও কাটানো যেতে পারে।.

চুঁচুড়া
শ্রীরামপুরের মত চুঁচুড়াও এখন, মানে ১৮২৬ সাল থেকে আরকি, ইংরেজদের অধিকারে রয়েছে। আর শ্রীরামপুরের মতই এই জায়গাটিও স্বাস্থ্যকর ও নানা দিক দিয়ে সুবিধেজনক হওয়ার জন্য এখানেও সামরিক ঘাঁটি গড়ে উঠেছে। বিশাল জায়গা জুড়ে ছড়ানো সেনাছাউনিগুলি ছাড়াও এখানে একখানা ইংলিশ চার্চ, একখানা ব্যাপটিস্ট চ্যাপেল, আর একখানা দারুন সুন্দর দেখতে কলেজ রয়েছে। লোকমুখে তার নাম হুগলী কলেজ। কলেজের বাৎসরিক খরচ মোটামুটি ৬২০০০ টাকা। একজন অধ্যক্ষের অধীনে একজন অধ্যাপক আর চোদ্দজন মাস্টার রয়েছেন এই কলেজের বিভিন্ন বিভাগে। পাঁচশোর ওপরে দেশীয় ছাত্র এখানে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন শাখায় পাঠগ্রহণ করে থাকে। এছাড়া পার্সী এবং আরবী সাহিত্যও পড়ানো হয়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এখানে বাংলা শেখানোর জন্য একখানা ক্লাস খোলা হয়েছিল, সেটি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্রের অভাবে সেটিকে অপ্রয়োজনীয় বলে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ছাত্রদের মধ্যে চারশো জনই হিন্দু। গোটা দুতিনেক খ্রীস্টান বাদ দিলে বাকী সব মুসলমান।
লেখকের টীকা
[1] এখানেই “প্রথম মিশনারী প্রেস স্থাপন করা হয়েছিল। এই প্রেসিডেন্সির ভাষায় বাইবেল প্রথমবার এখানেই ছাপা হয়। এছাড়া বাংলা ভাষায় প্রথম পুস্তিকা এখানেই ছাপা হয়। প্রথম বাংলা মাধ্যম স্কুল এখানে, প্রথম হিন্দুকে খ্রীস্টধর্মে ধর্মান্তকরণ এখানে, এমনকি ভারতের প্রথম স্টিম ইঞ্জিনও এখানেই দেখা যায়। প্রবিত্র ধর্মগ্রন্থ ছাপার জন্য যে কাগজের দরকার, তা জোগান দেবার জন্য এখানে কাগজের কল স্থাপন করা হয়েছিল।”— নোটস্ অন দ্য রাইট ব্যাঙ্ক অফ দ্য হুগলী। ক্যালকাটা রিভিউ। নং ৮ ভলিউম ৪।
[2] “ আগে এটি জন ফারকুহার-এর রক্ষণাবেক্ষণে ছিল। এই বিপুল সম্পত্তি জমানোর বুদ্ধিটা তারই মস্তিস্কপ্রসূত। সম্পত্তির পরিমান প্রায় আশি লাখ টাকা। আজ এই কথা বললে তার স্মৃতির প্রতি অবিচার করা হবে না যে এই বিপুল সম্পদ শুধুমাত্র ভদ্রলোকের উপরি কামাইয়ের জোরে হয়নি। এই কৃপণের চুড়ামনির অপ্রতিদ্বন্দী মিতব্যায়ীতাও এর জন্য যথেষ্ট দায়ী। শোনা যায়, বাড়ির একমাত্র চাকরটিকে বলা ছিল, দিনান্তে তার টেবলে দু আনা করে খরচ রেখে যাওয়ার জন্য! ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে তিনি কোনও একটি স্কটিশ বিশ্ববিদ্যালয়কে ১০০০০০ পাউন্ড দেবার প্রস্তাব করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নাস্তিকতার ওপর একটি অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করার জন্য। তার প্রস্তাব অবধারিতভাবে খারিজ হয়ে যায়। ” নোটস্ অন দ্য রাইট ব্যাঙ্ক অফ দ্য হুগলী। নং ৬ ভলিউম ৩।
১৮৫৮– কারখানার কাজকর্মের দায়িত্বে এখন আছেন কর্নেল ভিনসেন্ট এয়ার, সি বি। লেখক হিসেবে ও সৈন্য হিসেবে এই ভদ্রলোকের প্রতিভা গোটা পৃথিবীর সামনে স্পষ্ট। তার লেখা ‘ন্যারেটিভ অফ দ্য ক্যানবুল ডেসার্টার্স’ এবং সাম্প্রতিক বিদ্রোহে তার গুরুত্বপূর্ণ ও উৎসাহী অবদান তার উভয় দিকের প্রতিভার সাক্ষ্য দেয়।
(ক্রমশ)
