রুরাল লাইফ ইন বেঙ্গল। কোলস্‌ওয়ার্দি গ্রান্ট। পর্ব ২। অনুবাদে অর্ণব রায়

0

গত পর্বের পর

 

প্রথম চিঠি

মূলনাথ হাউস

মূলনাথ (১), জানুয়ারি ১০

 

আমার প্রিয় বোনেরা,

শরীর খারাপ হওয়ার কারণে বহুদিনের বকেয়া আমন্ত্রণ রক্ষা করার সুযোগ ঘটে গেল। তাছাড়া নিজেরও অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল। আমি আবারও কয়েকদিন হল আমার প্রিয় বন্ধু মিঃ জে- এফ- (২) এর অপূর্ব সুন্দর বাড়িতে থাকছি। এই এলাকাটা সমস্ত নিম্নবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আর স্বাস্থ্যকর।

এখানে থাকাকালীন আমি যাতে অলস না হয়ে যাই বা তোমাদের কথা ভুলে না যাই, সেজন্য, আর তাছাড়াও আমি ভালো ছেলের মত তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে যখনই সম্ভব হবে, তোমাদের চিঠি লিখতে অবহেলা করব না আর আমাদের এইসব মাসিক চিঠিপত্রের মাধ্যমে এই মফঃস্বল ও শহরতলী এলাকায় থাকাকালীন বা ভ্রমণ করতে গিয়ে যা যা দেখছি তার বর্ণনা দিয়ে তোমাদের চিত্তবিনোদন করব, আরও বেশী করে সেই প্রতিশ্রুতি রাখার জন্যও এই চিঠি লিখছি। এতে করে আমাদের জীবনের প্রতিদিনের একঘেয়েমিও কিছুটা কাটবে। বিশেষ করে, এই মুহূর্তে বাংলার সবচেয়ে আকর্ষনীয় পণ্য, নীল, কীভাবে প্রস্তুত হয় সে সম্পর্কেও আলোকপাত করা যাবে। আমার বিশ্বাস, ইংল্যাণ্ডে আমাদের বন্ধুদের দুই তৃতীয়াংশ এই নীল সম্পর্কে শুধু এটুকুই জানে যে এটা এক ধরণের নীল রঙের রঞ্জক পদার্থ, বাইরে থেকে আনা হয়, বাড়িতে জামাকাপড় কাচার লোকে এই জিনিসটা তাদের কাপড়ে দেয়, ছোট ছোট বলের আকারে পাওয়া যায় আর তাদের সুতির কাপড় নীল রঙ করতে কাজে লাগে— এর বেশী কিছু নয়। এই শুকনো অপ্রয়োজনীয় তথ্যগুলির বাইরে যদি আমি এই বস্তুটির বিষয়ে বা এর সঙ্গে জড়িত আরও অন্যান্য অজস্র ব্যাপারে তোমার আগ্রহ আর উৎসাহ জাগাতে পারি, তাহলে আমি বুঝব আমার তরফ থেকে অন্ততঃ ইচ্ছেপূরণ হয়েছে।

আমার সঙ্গে এই যাত্রায় বেরিয়ে পড়তে হলে আর পথে যা যা আকর্ষনীয় ব্যাপারস্যাপার আসবে, তার অভিনবত্ব সম্পর্কে জানতে হলে শুরু থেকে শুরু করতে হবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, প্রথমেই জানতে হবে, আমি কীভাবে এখানে এসে উপস্থিত হলাম। এর সাথে এখানে কী কী দেখা যেতে পারে, সে সম্পর্কেও সামান্য ভূমিকা দেওয়া প্রয়োজন।

যারা কাউকে অনুসরণ করে, তাদের পেছনেই থাকতে হয়। বর্তমানে আমাদের সমাজের কোনও ক্ষেত্রেই কোনওরকম উন্নতি করতে চাইলে আমাদের বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতে হয়। তা সে শিল্পকলা, বানিজ্য বা উৎপাদন, যে কোনও দিকেই হোক না কেন।  আর এটা শুধু উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা নয়, হামেশাই এর নমুনা চারপাশে দেখা যায়। এই যেমন আধুনিক যুগের সবচেয়ে বড় বিপ্লবটির কথাই ধরা যাক না কেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা। একটু খেয়াল করে দেখলেই দেখা যাবে এই যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমাদের মাতৃভূমি ভীমবেগে এগোচ্ছে আর আমরা তার সাথে তাল রাখতে না পেরে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। প্রথমতঃ, আমাদের এখানে রেলওয়ে নেই। যদিও আমরা পেয়ে যাব। আর তা বছর দুয়েকের মধ্যেই। কেননা জমিতে রেললাইন বিছানোর কাজ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই মাইলের পর মাইল গ্রামদেশ জরিপ করা, সমান করা আর যে সমস্ত মাপ করা জমিতে মানুষের বসতি আর ক্ষেতখামার বাগান ছিল, সে সমস্তকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আমার আশঙ্কা, এইসব এলাকা থেকে পীড়িত দেশীয় মানুষদেরকে, অস্থায়ীভাবে হলেও, বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। এদিকে আমাদের দেশীয় সাউথওয়ার্ক, নদীর ওপারের শান্ত শহর হাওড়া, কলকাতার দিকে মুখ করে বসে আছে। ইতিমধ্যেই সেখানে ভারতের প্রথম রেল টার্মিনাস হওয়ার সব লক্ষণ ফুটে উঠেছে। সেখানে বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, গাছপালা উপড়ে ফেলা হয়েছে। বিপুল এক কাজের সমস্তরকম সক্রিয়তা সেখানে দেখা যাচ্ছে। আমাদের মাতৃভূমি পরবর্তী পদক্ষেপে কী যাদু দেখাবে, তা আমরা বলতে পারি না ঠিকই, কিন্তু অন্ততঃ এই একটা ব্যাপারে আমরা তাদের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছি [1]।  ইতিমধ্যে, আরও একটা যোগাযোগ মাধ্যমেও আর আমাদের পিছিয়ে পড়া বলা যাবে না। এখন কলকাতা ও উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলি আর আসামের মধ্যে স্বাধীনভাবে পাঁচটা সরকারী স্টিমার বিভিন্ন সময়ে যাতায়াত করে। এছাড়াও এখন এখানে অন্তর্বর্তী নদীপথে স্টিমার চালানোর জন্যও দুখানা সংস্থা রয়েছে। আড়ে বহরে সেগুলি ইংল্যান্ডের এরকম যে কোনও স্বাধীন স্টিমার কোম্পানির সমান। এদের মধ্যে প্রথম আর সবচেয়ে পুরোনো কোম্পানিটি হল ‘ইন্ডিয়া জেনারেল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি’ (৩)। আজ থেকে নয় বছর আগে এর প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এদের কাছে পাঁচটা নদীপথে চলে এরকম চালু স্টিমার রয়েছে যেগুলি সমসংখ্যক মালবাহী চ্যাপ্টা নৌকোকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। আর একটি কোম্পানি হল ‘গ্যাঞ্জেস স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি’ (৪)।  এদেরও সমসংখ্যক দৈত্যাকার সব স্টিমার রয়েছে। কিন্তু এদের স্টিমারগুলি একইসঙ্গে মালবাহী ও যাত্রীবাহী স্টিমার হওয়াতে বছরের যে সময় নদীগুলি জলে পূর্ণ থাকে, সেই সময় তো দ্রুতগতিতে মানুষ ও মালপত্র এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে, কিন্তু গ্রীস্মকালে খরার সময় যখন নদীবক্ষ শুকিয়ে যায় তখন অন্য কোম্পানির ছোট ছোট মাল ও যাত্রীবাহী স্টিমারগুলিই সুবিধে পেয়ে যায়। এরা এমন এমন সব পথ ধরে যাতায়াত করে যেগুলো দিয়ে ভারী স্টিমারের পক্ষে যাতায়াত করা একেবারেই অসম্ভব। এইভাবে দুতরফই সমান সমান সুবিধে পেয়ে থাকে।

দুটি কোম্পানির স্টিমারই মাল আর যাত্রী নিয়ে এলাহাবাদ [2] যাতায়াত করে। যাতায়াতের পথে মাঝের জায়গাগুলোতেও থামে। যদি বছরের সেই সময় সেইসব জায়গাগুলোর ওপর দিয়ে যাতায়াত করা সম্ভব হয় তবেই। কেননা বছরের চারমাস ভাগিরথী আর জলঙ্গী, গঙ্গার দুই মূল ধারা বা মুখ, যা কিনা পরে হুগলিতে নদীতে এসে মেশে, জায়গায় জায়গায় অগভীর হয়ে পড়ে। স্টিমারগুলিকে হুগলি নদীর উজানে যাওয়ার বদলে ভাটির দিকে যেতে হয়। আর তারপরে সমুদ্রের জলে সিঞ্চিত অসংখ্য জালের মত ছড়িয়ে থাকা খাল বেয়ে বাঘে ভরা সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অনুকূল পরিস্থিতিতে এলাহাবাদের এই যাত্রায় সতেরো থেকে আঠেরো দিন সময় লাগে, এই সময় সেটা বেড়ে গিয়ে মোটামুটি পঁচিশ দিন বা তারও বেশী লেগে যায়।

  সুতরাং বছরের এই সময়টায় যদি কোনও লোকের এলাহাবাদের পথে পড়ে এরকম কোনও যায়গায় যাওয়া প্রয়োজন এবং যদি তার যাত্রাপথের মধ্যে সুন্দরবন না পড়ে, তাহলে তাকে স্টিমার পরিত্যাগ করে তিনটি বিকল্প যাতায়াত ব্যবস্থার যে কোনও একটা বেছে নিতে হবে। যে যাত্রীর তাড়া আছে আর যার মালপত্রও সামান্য তাকে এরকম পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহে সরকারী ডাকগাড়ি বা এরই সমতুল ‘ইনল্যান্ড ট্রানজিট কোম্পানি’-র কোনও গাড়িতে চড়ে বসতে হবে। আর পুরোনো দিনের রীতিতে যাতায়াত করতে হলে, তোমাদের জানাই আছে, পালকি বেহারার ব্যাবস্থা রয়েছে। রাস্তায় মোটামুটি আট মাইল অন্তর অন্তর বেহারা বদলানোর রিলে ব্যবস্থা রয়েছে। এতে করে সারারাত ও সারাদিন একটানা যাত্রা করা সম্ভব।

(ক্রমশ)

লেখকের টীকা:

[1]  এই চিঠি লেখার পরে চার বছর কেটে গেছে। আমাদের রেলওয়েরও প্রসার ঘটেছে। এখন ভারতীয় রেল হাওড়া থেকে রাণীগঞ্জ দৌড়োয়। দূরত্ব প্রায় ১২১ মাইল। এখন একজন পর্যটক যদি লেখক বর্ণিত রাস্তা ধরে চলতে চায়, তাহলে সে হাওড়া থেকে চুঁচুড়া ট্রেনে করে যাবে। তারপর নৌকো করবে। এমনি করে সে একটা গোটা দিন সময় আর ধৈর্য বাঁচাতে পারবে। এছাড়া একটা বিরক্তিকর, আরামহীন, ক্লান্তিকর নৌকোযাত্রার হাত থেকে রেহাই পাবে। স্থলপথে সে রেলে চেপে এই পথটা দেড়ঘন্টায় পাড়ি দেবে।

[2]  জায়গাটার নাম ‘উলাহাবাদ’  বললেই বোধহয় ঠিক হয়। কিন্তু ইদানিং শব্দটির ইংরেজীকরণ ঘটেছে। আমি তাই সাধারণ বানানটিই রেখেছি।

 

অনুবাদকের টীকা

১। মূলনাথঃ মূলনাথ বা মূলনাথ হাউস নদীয়া জেলায় ইছামতী নদীর ধারে নীলকর সাহেবদের বসবাস করার জন্য একটি বড় বাড়ি। বাড়িটির সঠিক অবস্থান এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে এদেশে যখন নীলচাষের রমরমা, তখন এই বাড়িটির যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল বলে নানা জায়গায় উল্লেখ পাওয়া যায়।

২।  মিঃ জে এফ-ঃ জেমস ফরলং। গ্রান্ট যখন মূলনাথে যান, ফরলং সেখানে ম্যানেজার হিসেবে বাস করছেন। কোম্পানীর নাম হান্ড্রা, মালিকের নাম জনৈক মিঃ হিল। যতদূর জানা যায় ফোরলং ১৮৩০ নাগাদ বাংলায় আসেন একজন সহকারী প্ল্যান্টার হিসেবে। ক্রমে কাজে উন্নতি করে উনি মূলনাথের বিরাট সংস্থার ম্যানেজার হন। ১৮৫৪ সাল নাগাদ তিন প্রায় ২৩ টি কারখানার ম্যানেজার ছিলেন। নিজের কাজের পাশাপাশি উনি প্রচুর জনকল্যানমূলক কাজ করেন যে কারনে প্রভূত জনপ্রিয়তা পান। সেসব কল্যানকর কাজের কথা গ্রান্টের এই চিঠিতেও খানিকটা বলা আছে।

৩। ইন্ডিয়া জেনারেল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানিঃ ব্রিটিশ মালিকানার স্টিমার কোম্পানি যা গঙ্গা ও আসামের বিভিন্ন নদীতে যাত্রী ও মালপত্র বহন করত। আসাম অঞ্চলে চা ও গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চলে পাটশিল্পের উন্নতিতে এই কোম্পানীর বড় হাত রয়েছে। ১৮৯৯ সালে এই কোম্পানী নাম বদল করে হয়ে যায় ইন্ডিয়া জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়ে কোম্পানী

৪। গ্যাঞ্জেস স্টিম নেভিগেশন কোম্পানিঃ মোটামুটি ১৮৪০-৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি কলকাতা-পাটনা-এলাহাবাদ এই রুটে মাল ও যাত্রী পরিবহন করত।

Author

Leave a Reply