অভিমানভূম। পর্ব ১৮। বন্ধু সবাই হয় কি?। লিখছেন শুভদীপ চক্রবর্তী

ছোট ছোট আশা, ছোট ভালোবাসা পাই
হোক তবে তাই
১
জ্বরের দিনগুলোতে জানালাও কেমন যেন ক্যানভাস। এত ঘনঘন ওয়েদার চেঞ্জ কিংবা চেপে ধরা ক্লান্তির সুবাদেই মনে হয়, জাঁকিয়ে আসে জ্বর। লাগামহীন হলে, পারদই বা উপরে চড়তে মানা করেছে কখন? অগত্যা অদ্ভুত অচেনা দুপুর। আলস্য। বাড়ি ফিরে আসার পর দুই বাড়ির মাঝের জমিতে কাঁঠাল গাছটার দিকে নজর পড়ে কতদিন পর! কাঁঠাল গাছের পিছনে নানুদের বাড়ির অ্যাজবেস্টসের ছাদটার উপর দৌড়াদৌড়ি করে খুনসুটি করে বেড়ানো কাঠবিড়ালী দুটোর দিকেও চোখ মেলে তাকাই, যেন দিগন্ত পেরিয়ে আসার পরে ঘর খুঁজে পেয়ে আদিখ্যেতার ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা। ঘোলাটে চোখে কখন ঘুম বা কখন জেগে ওঠা, তার যেহেতু ঠিক থাকে না কোনও, অতএব রুটিন দাঁড়ায় সকালে ঘুম ভাঙার পর আবার ঘুমিয়ে পড়া আর তার মাঝে মাঝে জেগে থাকার সময়টুকুতে জানালা দিয়ে সকাল, দুপুর বা বিকেলের আলো মেখে সন্ধের বদলে যাওয়া রংগুলো চোখে নিয়ে ক্লান্তিতে ঢলে পড়া আবার। এদিকে চোখের উপর চাপ পড়লে জ্বর বাড়বে আবার, সেইরকম একটা অজুহাতে সব বই সরিয়ে নেয় মা। এইরকম একটা ছুটি তো আসলে চাহিদা হয় না কারুরই! যেখানে ক্লান্তির দৌলতখানায় বই পড়া থাকে না, একটানা সিনেমা দেখা থাকে না; থাকে না গান শোনাও।
বরং সন্ধের দিকে বাবা মাথার কাছে বসে। একটা বড় সময় অবধি কোনও কথাই হত না তার সঙ্গে সেরকম। এখন বয়স বেড়ে যাবার পর মফস্বলে ফিরলে, এটা সেটা কিনতে গেলেও মনে হয় বাবা সঙ্গে থাকলে ভালই হয় যেন। আসলে একটা ছোঁয়ার সঙ্গে থাকতে চাওয়ার চেষ্টা; যে ছোঁয়ার পরতে পরতে গল্প কবেকার। যেমন চেয়ারে বসে বাবা নিজের মনেই বলতে শুরু করে একগুচ্ছ ছোটবেলা। সেই ছোটবেলায় ঢুকে পড়ে একটুকরো ওপার বাংলা। নোয়াখালি। ঠাকুরদার সর্বস্ব রেখে চলে আসার পর নবদ্বীপের কাছে ভান্ডারটিকুরিতে এক চিলতে জমির উপর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বাঁধা ঘর। ওই গ্রামের পাশেই সাঁওতাল গ্রামের গল্প। আর, একটু বড় হওয়ার পর সেই সাঁওতালদের সঙ্গে মিশেই তীর ধনুক ছুড়তে শিখে যাওয়া বাবার। শুনতে-শুনতে আশ্চর্য লাগে, এইভাবে তো কখনও চেনা হয়নি মানুষটাকে! ভাবি, এভাবেই হয়তো ঋতু পরিবর্তন হয়ে যায় আমাদের ভিতরে ভিতরে। দিন বদলাতে বদলাতে কখন যেন হেমন্ত থেকে শীত ছুঁয়ে বসন্ত চলে আসে পাড়ায়।
২
সুস্থ হয়ে যখন আবার রওনা দেওয়া পুরুলিয়ার দিকে, তখন ঘন শীত। যদিও এবার আর একা নয়, সঙ্গে দোসর আছে। এইসব অঞ্চলে এখনও এত তীব্র এবং পরিষ্কারভাবে, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘ভিভিড’, বছরের ছ’টা ঋতুই ধরা দেয়, সেটা শহুরে কলকাতা থেকে হারিয়ে গেছে কবেই যেন। সময়ের যাতায়াত কত সাবলীল এইসব পাহাড়-ঝর্ণা-পাথুরে নদীতে! এক ঋতু থেকে অন্য ঋতুতে এই কক্ষপথ বদলের ট্রানজিশনটাও ধরা পড়ে তাই পরিষ্কার।
অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ প্রোজেক্টের চাপ বেড়েছে বেশ। বিশেষভাবে পুরুলিয়ার মতো অঞ্চলে জোর দেওয়া হয়েছে মেয়েদের একটা সার্বিক এবং গোষ্ঠীগত উন্নয়নের ব্যাপারে। সরকারি প্রকল্প ‘কন্যাশ্রী’ ততদিনে বেশ সাড়াও ফেলেছে গোটা রাজ্যজুড়েই। চলতে ফিরতে মনেও হয়, পুরুলিয়ার মতো অঞ্চলে সত্যিই ভীষণ রকম প্রয়োজন ছিল এরকম একটা প্রকল্পের। বেশ কয়েকবার জেলা অফিস এবং ইউনিসেফের সঙ্গে প্রজেক্ট প্রোপোজাল চালাচালির পর ইন্টারেস্টিং কয়েকটা কাজের বরাত আমরা পেয়েছিলাম সেই সৌজন্যেই। তার মধ্যে একটা ছিল কমিউনিটি ভিডিয়ো ভলান্টিয়ার তৈরি করা। মূল ভাবনাটা নেওয়া অবশ্য কমিউনিটি রেডিও থেকেই। ‘ভিডিয়ো ভলান্টিয়ার’ ব্যাপারটা হল, গ্রামের ছেলেমেয়েদের ভিডিয়ো কী করে তুলতে হবে এবং কীভাবে অডিও-ভিজুয়ালের মাধ্যমে গল্প বলতে হবে, সেই বিষয়ে একটা বেসিক ওয়ার্কশপ করানো। উদ্দেশ্য ছিল, বাইরে থেকে এসে কেউ তাদের গল্প বলার বদলে, তারা নিজেরাই যদি নিজেদের কথাগুলো তুলে আনে সকলের সামনে?
কারা কারা এই ব্লক ভিত্তিক ভিডিয়ো ভলান্টিয়ার ওয়ার্কশপে আসবে, সেটা লিস্ট করে পাঠানো হয়েছিল জেলা অফিস থেকেই। এখনও অবধি সবই তো ঠিক, কিন্তু একমাস ধরে প্রথমে তাদেরকে শেখানো আর তারপরে তাদেরকে দিয়ে হাতে-কলমে ভিডিয়ো তুলে তৈরি করানো— এই কাজটা করার জন্য রাজী করানো যাবে কাকে? কারণ, এক মাস ধরে কলকাতার সব কাজ ছেড়ে পুরুলিয়াতে এসে থাকা যে কোনও কারুর পক্ষেই খুব সহজ ব্যাপার নয়। বাজেটও তো আহামরি নয়। এদিকে সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে।
চিনি চাইলেই চিন্তামনি যোগান কিনা জানি না, কিন্তু এই সমস্যার সমাধানের একটা আলো দেখা গেল ইউনিভার্সিটির বান্ধবী লাবণ্যের সূত্রে। লাবণ্য, মানে সেই সময় কলকাতার রেডিয়ো মির্চির ‘মির্চি লাবণ্য’। হোয়াটসঅ্যাপে নাম্বার পাঠিয়েই ছোট্ট একটা টেক্সট এল, “সৌরভকে ফোন করে দ্যাখ! মনে হয় হয়ে যাবে…”
কিন্তু হবেটা কী করে? ততদিনে কলকাতা দূরদর্শনে কাজ শুরু করে দিয়েছে সৌরভ। ফলে, খুব বেশি হলেও দু’সপ্তার বেশি কলকাতা ছেড়ে থাকা সম্ভব নয় ওর পক্ষে। তাহলে? সৌরভ বলল, ট্রেনিংটা করিয়ে দেবে ও, কিন্তু প্র্যাকটিক্যালের সময়টা থাকা হবে না আর ওর। বদলে ওদেরই আরেক বন্ধু রানা, মানে রানা প্রতাপ কারফরমা প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপারগুলো দেখে নেবে, আর এডিটের কাজটা সামলে দেবে ওদেরই রূপকলা কেন্দ্রের বন্ধু রাজকুমার।
৩
অগত্যা সারারাত লাগেজ নিয়ে প্রচন্ড টেনশনের পর একটা শীতকালের সকালে আমি আর সৌরভ গিয়ে নামলাম পুরুলিয়ায়। আর, লালপুর, বরাবাজার, বাগমুন্ডি, মানবাজার থেকে একে একে এসে পৌঁছালো প্রেমকুমার, পঙ্কজ, ধর্মরাজ, সোমনাথ, শেফালী। এদের অনেকেরই তখন মোবাইল ফোনটাও নেই। ছবি তোলা তো দূর, ক্যামেরাই কখনও চালিয়েছে কিনা সন্দেহ! কী আশ্চর্য জাদুতে যে সৌরভ তৈরি করেছিল ওদেরকে, তার আভাস পাওয়া গিয়েছিল পরে। এটা-সেটা কাজের চাপে পাঁচ-ছ’দিন পর কলকাতা ফিরেই দৌড় দিল্লি। কাজ সেরে সেখান থেকে কলকাতা ফিরেই তারপর পুরুলিয়া আবার। ততদিনে সৌরভের কাজ শেষের পথে। অগত্যা এইবার আমার সঙ্গে যাবে রানা। রানা পৌঁছালে, ওর হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে আসবে সৌরভ।
এর মধ্যেই আবার রেডিও স্টেশনের ছেলেমেয়েদের জন্যেও একটা ওয়ার্কশপ অ্যারেঞ্জ করা জরুরি খুবই। দীর্ঘদিন ধরে একনাগাড়ে অনুষ্ঠান চলতে চলতে, একটু কিছু নতুন ভাবে ভাবতে চাওয়ার বা ভাবানোর দরকারটাও দেখা দিয়েছে খুব। নিজের ভাবনাগুলো সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে ভীষণ, বুঝতে পারছি। তাছাড়াও প্রফেশনাল এবং এক্সপার্টদের বিশেষত্বটা ঠিক কী, সেটাও সামনে আনা দরকার। ওখানকার অনেকেরই আবদার, যদি কলকাতা থেকে কাউকে নিয়ে এসে একটা একদিনের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা যায়। যদিও নিজের অভিজ্ঞতা বলে, একদিনের ট্রেনিংয়ে কাজের কাজ হয় না কিছুই। অন্ততপক্ষে একটা গোটা সপ্তাহ না পেলে, আদানপ্রদানটাই বা হবে কী করে? কিন্তু, কথা হল, কে আসবে কলকাতা ছেড়ে? মুশকিল আসান সেই লাবণ্যই আবার। এর আগে কয়েকবার ওকে বললেও, পেশার খাতিরেই সময় দেওয়া সম্ভব হয়নি ওর পক্ষে। ইদানিং একটু ফাঁকা থাকায়, ‘হ্যাঁ’ করতে অসুবিধে হল না। এবার যাত্রা তিন বন্ধুর তাই। আমার আর রানার সঙ্গেই লাবণ্যও একই ট্রেনে…
আদরে-শাসনে সৌরভ ততদিনে বেশ তৈরি করে দিয়েছে ওদেরকে। রানা আর লাবণ্যকে নিয়ে যেদিন পৌঁছনো গেল, সেদিন থেকেই ট্রেনিং শুরু লাবণ্যের। তার পরের দিনেই ওয়ার্কশপ শেষ করে সৌরভের সঙ্গেই ফিরে যাওয়া একই ট্রেনে। প্রস্তুতি জমজমাট! একটা ঘরে শুরু হল রেডিয়ো ট্রেনিং। অন্য ঘরে ভিডিয়ো ট্রেনিং রানা-সৌরভের ক্লাসে। কিছু ছেলে-মেয়ে চোখে স্বপ্ন আর মনে ভরে নিচ্ছে কনফিডেন্স— দূরে দাঁড়িয়ে মনে হয়, আর কিছুই করা হোক বা না হোক, এটুকুই নেহাৎ কম কী?
দুটো ঘরে যখন ক্লাস চলছে দুটো, আমার ‘জুগাড়ু’র কাজ চলছে পুরোদমে। ছেলেপুলেরা বায়না ধরেছে, সৌরভদা চলে যাওয়ার আগেরদিন পিকনিক করতে হবে! এদিকে একটা দিন নষ্ট হওয়া মানে, পরে কী করে সামাল দেওয়া যাবে সেটা ভাবতেই মাথা নষ্ট। খাবার দেওয়ার দায়িত্ব যে মানুষটার উপর, তাকে আমরা ডাকি লেডুদা বলে। সে আরেক অদ্ভুত মানুষ! প্রতিদিনই খাবার নিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে লেডুদার কিছু-না-কিছু ঝামেলা। এবার তাদের জন্যেই নাকি সেই লেডুদাকে ধরে রাজি করাতে হবে দুপুরের খাবার ব্যবস্থাটা কোনও ফাঁকা জায়গায় মাঠের মধ্যে কিংবা গাছের তলায় করা যায় কিনা!
“কিছুতেই সম্ভব নয়!” শুনেই তিন হাত ছিটকে গিয়ে খিঁচিয়ে উঠল লেডুদা। “এত করে বলছে ছেলেমেয়েগুলো, একটু দেখবে না? একটাই তো দিন…” মন গলানো গেলে মোটা পাওয়ারের চশমা চোখের মানুষটার, ভিডিয়োর ছেলেমেয়েরা আর রেডিয়ো ট্রেনিংয়ের সবাই দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করতে বসে মাঠের উপর। রোদ ঝলমলে শীতের দুপুর। মাটির উপর শালপাতা বিছিয়ে দিলে, তাতে নেমে আসে মোটা চালের গরম ভাত, ডাল, আলু-পোস্ত, পোল্ট্রি মাংস আর চাটনি। আর খুশি লাগামহীন। হয়ে যায় আমাদের পিকনিক…
৪
সে রাত্রিটা আচমকাই ‘চন্দ্রবিন্দু’র গান। সারা রাত ধরে হবে আড্ডা। নতন-পুরনো বন্ধুরা একজায়গায় সব অনেকদিন পর। কলকাতা থেকে দূরে ভিনগাঁয়ের এক অজ হোটেলে। পুঞ্চায় কোনও জায়গা না পাওয়াতে, গাড়ি নিয়ে অগত্যা মানবাজার। সস্তার হোটেল। নেশা, আড্ডা আর ধোঁয়ায় কেটে যাওয়া সারা রাত। পরের দিন সৌরভ লাবণ্যর ফিরে যাওয়া। কিন্তু, কোথাও একটা তাল কেটে গেল আচমকাই। হঠাৎই বেসুরো বেহাগ। অদ্ভুত সুন্দর একটা রাত্রির পর, সবকটা মুখের উপর কালো ছায়া পড়া একটা সকাল। কোনও এক অজানা কারণে তৈরি হওয়া একটা ঝগড়া থেকে ক্রমশ ভেঙে গেল সৌরভ-লাবণ্যর দীর্ঘদিনের সম্পর্কটা তারপর। সকলকে একজায়গায় আনার পরেও, এই একটা অপরাধবোধের থেকে আমারও আর মুক্তি পাওয়া হল না কখনও।
কিন্তু ব্যক্তিগত মনখারাপের খবর দায়িত্বেরা কবেই বা মনে রেখেছে? হাতে আর দুটো সপ্তাহ মাত্র! তারমধ্যেই সদ্য ট্রেনিং শুরু হওয়া ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে তুলতে হবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের উপর একটা ছোট ডকুমেন্টারি! তখনই খুব কাছ থেকে দেখা রানার হাতের কাজ। অকুন্ঠ পরিশ্রম। সারাদিন ধরে ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে চষে বেড়ানো গ্রামগুলোয়। যা শুটিং হতো সারাদিন ধরে, সেগুলো দিনের শেষে জমা করা হতো ভিডিয়োর জন্য নির্দিষ্ট একটা কম্পিউটার সিস্টেমে। তারপরেও রানা ঘরে এসে আমার ল্যাপটপে হার্ডডিস্ক গুঁজে দেখেই যেত সারাদিনের ফুটেজ। আমার ঘরেই আর একটা বিছানায় দিব্যি মানিয়ে নিয়েছিল রানা।
কোনও একটা কারণে সেবার আমাদেরকেও লেডুদার শরণাপন্ন হতে হল রাতের খাবার দেওয়ার জন্য। আর ঠিক তখনই বুঝতে পারলাম, কেন ছেলেমেয়েগুলো ঝামেলা করে লেডুদার সঙ্গে। জীবনে কখনোই খাওয়া-দাওয়া নিয়ে মাথা না ঘামানো সেই আমার থেকেও আপত্তি আসতে শুরু করল খাবার নিয়ে। তবে এই পুরো ছবিটাই বদলে গেল আচমকা আরেকদিন।
তার বছর দুই আগেই শুরু হয়েছে ইন্ডিয়ান সুপার লিগ। ফাইনালে সেবার কলকাতা আর কেরল। ভীষণ শীতের সন্ধেবেলায় আমার আর রানার ক্রমাগত হা-হুতাশ বেড়েই যাচ্ছে কেবল। দু’জনের গায়েই চাপানো দুটো কম্বল। এদিকে জেতার গোলটা আসবে কখন? একশো কুড়ি মিনিটের শেষেও ১-১! খেলা যতই এগোচ্ছে শেষের দিকে, ততই গলা চড়ছে আমাদেরও। শেষে পেনাল্টি শুট আউট। অংবার্টের পেনাল্টিটা ভুল দিকে ঝাঁপিয়েও, পা দিয়ে বাঁচিয়ে দিল কেমন করে দেবজিৎ? শেষ পেনাল্টিটা বজবজেরই ছেলে জুয়েল রাজা গোলে মারতেই, চিৎকার করে উঠলাম দু’জনে। রানা বোধহয় চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে একটু লাফিয়েও উঠেছিল। তখনই চিৎকারটাকে ঢেকে দিয়ে ‘মচাৎ’ করে শব্দ হল একটা। খানিকক্ষণ দু’জনেই চুপ। কিছুক্ষণ পর রানা বিছানা থেকে নেমে বলল, “খাটের মাঝের কাঠটা মনে হয় ভেঙে গেল বুঝলে!”
এইরকম অবস্থায় কী বলতে হয় জানা নেই। কিন্তু আবার কলকাতা জিতেছে! বললাম, “রাতে ঘুমিয়ে পড়তে পারবে তো? তাহলে কোনও চাপ নেই। সকালে দেখা যাবে।” এমন সময় লোহার গেটে ধাক্কা দিলো লেডুদা। টেবিলে রেখে গেল খাবার। প্রতিদিন খাবারের চেহারা দেখে দেখে বিরক্ত আমরা সেদিন কলকাতা জয়ের আনন্দে সব বিতৃষ্ণা ভুলে টিফিন বাক্স খুলতেই, আর একবার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা হল আনন্দে। “আরে, লেডুদা চিকেন দিয়েছে!”
৫
গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বুঝি না, কিন্তু সেবারের শীতকালটাই কেমন অদ্ভুত! একদিন ওরকমই ভীষণ ঠান্ডা রাত। কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে ঢুলছি আমি, আর রানা নিয়মমাফিক ফুটেজ চেক করে যাচ্ছে ল্যাপটপে— হঠাৎ গেট খুলে কারুর আসার শব্দ। গেট খোলাই থাকে। আসার লোক বলতে তো খাবার দিতে লেডুদা কিংবা আড্ডা মারতে ভ্যাবলা। সুতরাং এই ঠান্ডায় উঠে দেখতে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। কিন্তু সময় লাগল না ভুল ভাঙতে। হঠাৎ দেখি ঘরের মধ্যে তিন-চারজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। দরজা দিয়ে সটান ঢুকে এসে বললেন, “চলুন…”
চলুন মানে? এত রাতে কোথায় যাব? এনারা কারা সেটাও বুঝতে পারছি না। আমি আর রানা একে-অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি, ভদ্রলোকেরা আবার বললেন, “তৈরি হয়ে নিন। চলুন!” কী যে হচ্ছে! এমন সময় ঘরে হাসতে হাসতে ঢুকে এল আকাশ। “আমার বাবা আর জেঠু। তোমরা চলো…” ব্যাপারটা পরিষ্কার হল এতক্ষণ পর! দু-তিন দিন আগে তিন দিনের ছুটি চেয়েছিল আকাশ। বোনের বিয়ে। আমরা মজা করেই ওকে একটু রাগ দেখিয়ে বলেছিলাম, “তোমার বোনের বিয়েতে আমাদেরকে নিমন্ত্রণ করলে না তো?” অপরাধবোধ বাড়িয়ে দিতে সামান্য বাড়তি নাটকীয়তা— “আমার কথা বাদই দাও, এই রানাদা এতদূর থেকে এসেছে, দু’দিন পরে চলে যাবে। তোমাদের জন্য এই ঠান্ডায় এত কষ্ট করে থাকছে। তোমার কি একবারও উচিত ছিল না রানাদাকে একবার নিমন্ত্রণ করা?” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপচাপ আকাশ। থতমত ভাব কাটাতেই তারপর পিঠ চাপড়ে দেওয়া ওর, “ঠিক আছে। বোনের বিয়ে সামলে নাও। তারপর কাজে আসো…”
এটাকেই থ্রেট ভেবে নিয়ে, তার উল্টো রিয়্যাকশন যে এইভাবে হবে, সেটা চূড়ান্ত অপ্রত্যাশিত ছিল একদমই। কিন্তু যাওয়াটা হবে কীভাবে? আকাশ তৈরি হয়েই এসেছে। “আমার স্কুটিতে আরামসে হয়ে যাবে দু’জনেরই…”
আকাশের স্কুটি চলতে শুরু করার পর বুঝলাম, মারাত্মক গন্ডগোল হয়ে গেছে একটা। এতই ভয়ানক ঠান্ডা, পায়ের আঙুলগুলোও মনে হচ্ছে জমে গেছে মোজার ভিতর দিয়ে। হাতের আঙুলে বিন্দুমাত্র সাড় নেই। রানা পিছনে বসে কাঁপছে রীতিমতো। আকাশের হাতে গ্লাভস; পায়ে পা ঢাকা জুতো। রানার পায়েও কভার্ড শ্যু। এদিকে পা ঢাকা কিছু পড়াই হয় না আমার। বাধ্য হয়ে মাঝরাস্তাতে আকাশকে ধরে-টরে থামাতেই হল গাড়ি। স্কুটি থেকে নেমে মাটির রাস্তাতেই লাফালাফি করে নিয়ে একটু, একটা দেশলাই জ্বেলে ধরানো গেল সিগারেট। সেই আগুনে হাত থেকে কাটিয়ে ফেলার চেষ্টা করলাম জড়তা। এত তীব্র শীত কি আর কাটাতে পারে ওইটুকু একচিলতে আগুন? পথের দু’ধারে নিচু ক্ষেত। ক্ষেতের উপর সাদা কুয়াশা। সরীসৃপেরা শীতঘুমে সব। একটা বাচ্চা মেয়ে তৈরি হচ্ছে সংসারধর্মের জন্য। রওনা হওয়া গেল তার নতুন সংসারের দিকে।
এর আগে আকাশ ছাড়া আর কারুর সঙ্গে দেখাও হয়নি কখনও। কিন্তু প্রথমবার দেখা হওয়ার পর, সেটা মনে হচ্ছে না একবারও। কেউ অযথা ভদ্রতা দেখিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে না চেয়ার-টেবিল। তাতেই নতুন জায়গার সংকোচ কেটে যাচ্ছে অনেকটাই। বরং নিজেদের লোক মনে করে জিজ্ঞেস করছে কেউ কেউ, “মেয়ের সাজানো ঠিক আছে তো?” যে ঘরে মেয়ে বসে আছে খাটে, সেখানে তার মাথার উপর একটা হলুদ রঙের বাল্ব। মাটির মেঝেতে গুঁড়ো গুঁড়ো পড়ে আছে খাটের দু’পাশে ছড়িয়ে রাখা রজনীগন্ধার পাপড়ি। তার মাঝে একটা অল্প বয়সী মেয়ে যেন বুঝেই উঠতে পারছে না তার লজ্জা পাওয়া উচিৎ নাকি সবার সঙ্গে কথা বলা উচিৎ কলকল করে। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, নিজের তো বোন নেই কোনও… অথচ এমন সময়ে ডাকাডাকি শুরু করল ওরা, সঙ্গে করে উপহার আনা গেল না কিছুই। কুন্ঠিত লাল বেনারসীর পাশে কুন্ঠিত আমরাও খানিক। “তোর গিফটটা পাওনা রইল!” এক গাল হাসি নতুন বউয়ের মুখে। “অবশ্যই। তোমার থেকে মনে করে নিয়ে নেব!” তারপরেই যেন চিরন্তন বাংলার সমস্ত ঘরের মা-বোনের মতোই হয়ে যায় তার আর্জি, “দাদা, তোমরা কিন্তু খুব ভাল করে খেয়ে যাবে…”
শহরের বিয়ে বাড়িতে যেরকম স্টার্টার হিসেবে পকোড়া কিংবা চা-কফি-শরবত দেখা যায়, সেরকম কোনও ব্যবস্থাই নেই এখানে। নেই, তার কারণ হয়তো, থাকাটার আদতেই কোনও প্রয়োজন নেই। তার বদলে বাইরে কয়েকটা কাঠের চেয়ারের উপর রাখা আছে কয়েকটা শালপাতার থালা। আর সেই থালাগুলোর উপর ছড়ানো আছে একগাদা মৌরি আর বিড়ি! ছেলের বাড়ি থেকেই কেউ একজন গৃহস্বামীর দায়িত্ব পালন করতে সামনে তুলে ধরে একটা থালা। “নিন!” বিড়ি খাওয়ার অভ্যেসই নেই। তবু না নিলে কি অসম্মানও করা হয় না? পাশ থেকে সায় দিয়ে যাচ্ছে আকাশও। “দু’টান দিয়েই ফেলে দিয়ো!” অতিথির দায়িত্ব পালন করতেই অগত্যা খানিক মৌরি মুখে দিয়ে ঠোঁটে একটা বিড়ি চেপে ধরতেই, জ্বালিয়ে দিলেন গৃহস্বামী ভদ্রলোক নিজেই। ভীষণই মজার ব্যাপার। রানা হাত-পা নেড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, একদমই এসব নেশা-টেশায় নেই ও। দু-একবার কাশির পর বিড়িটা ফেলতেই, খাওয়ার ডাক। বিয়েবাড়ির পদ বলতে— ভাত, ডাল, একটা তরকারি, মাছের ঝোল আর একটা মিষ্টি। পদের কোনও বাহুল্য না থাকলেও, বাহুল্য যেটার আছে সেটা হল, আন্তরিকতার। সরেজমিন তদন্তে নবদম্পতি একবার। “তোমরা কিন্তু লজ্জা পেও না একদম…” ততক্ষণে সপ্রতিভ খানিক আমরাও। “সে ঠিক আছে, কিন্তু তুই তো একটু লজ্জা পা!” খিলখিল হেসে ওঠে নতুন বউ। যেন গরীব মুক্ত ঝরে যায় কিছু অল্প আলো দিয়ে ঘেরা ফুলশয্যার আবহ মাখা আসরের মাঝখানে…
খাবার শেষে ফেরার পালা। আবার সেই ভয়ানক শীত কেটে এগোনো। কিন্তু তার আগে আরও একটা বিষম ব্যাপার যে অপেক্ষা করেছিল, কে জানত সেটা? বিয়েবাড়িতে ঢোকার আগেই দেখা হয়েছিল সেগুলোর সঙ্গে। বাইরে দাঁড় করানো বিশাল বিশাল কয়েকটা সাউন্ড বক্স। কারণটা বোঝা যায়নি তখন। কিন্তু এসব দূষণ যে এখানেও ঢুকে এসেছে এভাবে, সেটা দেখে আক্ষেপ একটু জাগে বৈকি! কনেযাত্রী ফেরৎ যাওয়ার আগে ডিজে বাজানো হবে এই বক্সে এবং তার সঙ্গে ছেলের বাড়ি-মেয়ের বাড়ি মিলে হবে তুমুল নেত্য! সে ভাল কথা। কিন্তু সমস্যাটা হল, যখন দু-তিন রাউন্ড নাচের শেষে আকাশ এসে ছাড়ল বজ্রশেলটা। “এবার তোমাদেরকেও একটু নাচতে হবে!” চোখ কপালে। এ বলে কী? রানার মাথার কাঁচাপাকা চুলে তখনই এমন একটা গাম্ভীর্য যে, ওকে আলগা দু-একবার অনুরোধ করেও লাভ না হওয়াতে, ঘাঁটানোর সাহস পেল না আর কেউ। কিন্তু আমার মিনমিনে কথা শুনছে কে? মাঝখান থেকে নতুন বউ এসে, হঠাৎ নিচু হয়ে চেপে ধরল পা! “দাদা, একবার না নাচলে শ্বশুরবাড়িতে আমার মান থাকবে না!”
এক পাল অচেনা অজানা লোক। তাদের মধ্যে হাত-পা-মাথা ঘুরিয়ে বেঁকিয়ে সে এক আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা! যখন বন্ধ হল বাজনা, তখন সবার কপালে ঘাম। মুখে লাজুক হাসি। এত সহজে মিশে যাওয়া যায় মানুষের সঙ্গে? এত সহজে অন্যের পায়ের ধুলো জড়িয়ে নেওয়া যায় নিজের শরীরে? এত অবলীলায়, অক্লেশে সহজ সাধারণ নিমন্ত্রণে এভাবেও আপন করে নেওয়া যায় কাউকে? ফিরতে ফিরতে ঠান্ডা হাওয়াও সয়ে যায় বেশ খানিকটা। সয়ে যায় এই সমস্ত অপ্রত্যাশিত ভাললাগাও। কদিন আগেও একদম অচেনা কিছু মানুষ থেকে শুরু করে, এখন একটা সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা গ্রামও কেমন বন্ধু হয়ে যায় আমাদের!
মহীনের গানে যেমন বন্ধুত্বের সহজ সংজ্ঞা দেওয়া ছিল, সেভাবেই। শুধু আর শুধুমাত্র, হাতটুকু বাড়ালেই…

শুভদীপ চক্রবর্তী
পড়াশোনা ও বড় হয়ে ওঠা মফস্বল শহর বাটানগরে। নঙ্গী হাই স্কুল সাক্ষী এইসব দিনের। পরবর্তীতে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে। অর্থনীতি নিয়ে দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ কলেজে পড়ার পর জনসংযোগ ও সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মসূত্রে ঘোরাঘুরি গ্রাম বাংলার নানান প্রান্তে। বিশেষ করে পুরুলিয়ায়। পরে কিছুদিন জনসংযোগের কাজ; কিছুদিন সাংবাদিকতা।
প্রথম কবিতার বই 'ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া সব ঢেউগুলো' ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে। পরের বছর 'নিবিড়' থেকে ব্যক্তিগত গদ্য সংকলন 'যতটুকু দৃশ্যে ছিল'। শখ বলতে খেলা দেখা, সিনেমা দেখা, কাছে বা দূরে যেখানেই হোক ঘুরে বেড়ানো। বিকেল বেলা স্টিমারে চেপে গঙ্গা পারাপার। আলমারিতে বই গোছানো নিয়ে খিটখিটে আজীবন। না-পারার তালিকা লম্বা ভীষণ...