এক যৌথখামারের স্বপ্ন। দুর্লভ সূত্রধরের ‘অনন্যবর্তী’ পড়ে লিখছেন নবনীতা পাল
“…একদিন তোমাকে সাতপর্ণীতে নিয়ে যাবো টুকু। দেখবে কাব্যি করে বলা ‘আমার সোনার বাংলা’ কবেই মরে হেজে গেছে।
আমি যাচ্ছি ঐ গাঁয়ে। ওদের আলো দিতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে, জমি চষে ওরা, আর ওরাই আধপেটা খেয়ে থাকে। একদিন এই সব জমি ওদের ছিল, আজ ওদের এক ছটাক জমি নেই…
…ওদের বোঝাতে হবে, ওদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কেননা, ওরাই তো আসল ভারতবর্ষ…হাতে-কলমে এসব কাজ শিখতে হবে। আমাদের মতাদর্শ আসলে কর্মের পথ-নির্দেশিকা।
তুমি তো জানো টুকু, আমি কী স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্নে বাড়ি-গাড়ি নেই, আছে সকলের হাসি-আনন্দ গানে ভরা পৃথিবীর স্বপ্ন।
বদলানোর কাজটা কিন্তু সহজ নয়।
আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে সেটা হবে না? নিশ্চয়ই হবে।
আমার পাশে থাকা চাই…”
সদ্য মাধ্যমিকের গণ্ডী পেরোনো এক নব্য যুবকের তার কিশোরী প্রেমিকাকে লেখা অকপট প্রেমপত্র। প্রেমপত্র নাকি প্রেমের ইস্তেহার? দুর্লভ সূত্রধর-এর ‘অনন্যবর্তী’ পড়তে গিয়ে বারবার ফিরে আসে এমন অনন্য সব ইস্তেহার। ঋজু, অকপট, অনড়। অথচ কী ভীষন কমনীয়, নির্ভার, সাবলীল।
মফস্বলের উঠতি বয়সের এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে। কারোর বয়স মাধ্যমিক ছুঁইছুঁই, তো কেউ আবার এইচ এস-এর টেস্টপেপারে জীবনের হিসেব যুজছে। শোভন,তনয়, টুকু, কাজু, তরণী, মনোজ, শিবু, তপেশের বন্ধুত্বকে ঘিরে, তাদের জীবনের ভাঙচুর আর প্রেমের সহজিয়া প্রতিশ্রুতিগুলোকে ঘিরে আবর্তিত হয় এ উপন্যাসের মায়াবী গদ্যের চলন। আরও পাঁচটা সম্পর্কের মতই এ বন্ধুত্বের পথও বন্ধুতাময়। তবে তা কারোর একার পথ নয়। তাই তরণীদের ঘরে চাল বাড়ন্ত হলে বিকল্প ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এর ওর বাড়ি থেকে চাল ‘সাপ্লাই’ দেওয়ার সহজ বন্দোবস্ত হয়ে যায়। পরীক্ষাটা মিটতে না মিটতেই ‘বিকল্প’ ব্যবস্থার খোঁজে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে তরুন তুর্কীর দল। কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ে তরণী বলেই ফেলে—”তোররা মাইরি সত্যযুগগে আমমার মায়ের পেটটের ভাই ছিলিস্।” ওদের বড় হয়ে ওঠার ছোট্ট মফস্বলটাকে ঘিরে থাকে ওদেরই একটা আরো “বড়” স্বপ্ন। অবৈতনিক নাইটস্কুলের স্বপ্ন। থাকে সেই নাইটস্কুলকে ঘিরে অবন দা, কৃষ্ণা দি’র অনুক্ত ভালবাসার গল্প। থাকে আনন্দ দাদা-আনন্দী দিদির ছকভাঙা, সহজিয়া, ঘর বাঁধার গানেরা। আর থাকে মায়ের আঁচলের মত ঘিরে থাকা স্বচ্ছতোয়া কুন্তী নদী, আর তার পাড়ে বসে যৌবন ছুঁইছুঁই এক দঙ্গল কিশোর-কিশোরীর সুখের উদযাপন কিংবা দুঃখ যাপনের চিরন্তন আখ্যানমালা।
এর সমান্তরালে এগিয়ে চলে চার আপোষহীন প্রৌঢ়ের বেঁধে থাকার, বেঁচে থাকার কথামালা। প্রথম যৌবনে তেভাগার সাক্ষী থাকা সতীশচন্দ্র মোক্তারি শুরু করার পর পরই হয়ে ওঠেন আশেপাশের দশটা গ্রামের প্রান্তিক চাষীদের উকিল। ওষুধের দোকানের কম্পাউন্ডারি করে আর রাতবিরেতে ইঞ্জেকশন দিয়ে কোনমতে দিন গুজরান করা ফণিভূষন প্রায় শেষ বয়েসে এসে হয়ে ওঠেন গরীব-গুর্বো মানুষগুলোর অসুখবিসুখে একমাত্র ঠাঁই। চাষবাসের ব্যাপারে নীরদের অগাধ জ্ঞান ও প্রবল আগ্রহ। অবসর পরবর্তী জীবনে শচীপ্রসাদের ঝোঁক চাপে ফার্ম হাউজ তৈরীর। তিন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে শটিডাঙার বিঘে পাঁচেক জমিতে শুরু হয় খামার বাড়ি তৈরীর কাজ। ধীরে ধীরে সে খামার বাড়ির স্বপ্নে জুড়ে যায় আখে শেখ, আনোয়ারা বিবি, ফারহান ঘরামি, জাহান আলিদের শ্রমসাধনা। শটিডাঙার খামারবাড়ি আক্ষরিক অর্থেই হয়ে ওঠে যৌথখামার। নবীন প্রৌঢ়ের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যৌথখামারের স্বপ্নকে শটিডাঙার মাটিতে এভাবেই বোধহয় মূর্ত রূপ দিলেন লেখক।
দুশো ছত্রিশ পাতার এই উপন্যাসে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের আখ্যান। যেখানে অনেক না পাওয়ার মাঝেও আদর্শের ভিতটুকু ছিল মজবুত। এক অদ্ভুত অকপট সময়। কিশোরী ভালোবাসায় ফতোয়া জারি যেমন ছিল, তেমনি ছিল অবাধ মেলামেশার অনুক্ত প্রশ্রয়। আদর্শের ভিত যেমন মজবুত ছিল, তেমনি ছিল ক্ষমতার মৃদু আস্ফালন। তবু কোথায় যেন আদর্শের কাছে ক্ষমতার পরাজয় কেউ নিশ্চিত করে রেখেছিল। তখনও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে গুরুজনরা মাথায় হাত রেখে বলতেন— ‘কখনও বড়োলোক হওয়ার চেষ্টা কোরো না।’ তখনও ছোটোদের মধ্যে আদর্শের উত্তরাধিকার সঞ্চারিত করার অবকাশটুকু বেঁচে ছিল। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যের বুনট তাই সম্পূর্ণ হয় নবীন-প্রবীণের মেলবন্ধনের আটপৌরে মেদুরতায়়। সেই মেদুরতার আঁচেই নৌকোর লগি ঠেলে কাল্লু বলে ওঠে— “এই আম দুটো বাপ্ খাবে। মা মরে যাওয়ার পর তো আর আম…।” কাল্লুর মাঝি মাল্লারি রোজনামচায় রিনরিনে ব্যথার মত বেজে ওঠে—
“কুনোদিন আমো নেমনতন খাইনিকো!”
ঢালটার মুখে নৌকো এসে দাঁড়ালে কাজু কাল্লুর দিকে তাকি অদ্ভুত নরম গলায় বলে—
“আমাদের সবার বাড়ির সব অনুষ্ঠানে, সব আনন্দে তোদের ‘নেমনতন’ পাকা! তুই তো আমাদেরই বন্ধু, নাকিন?”
কুন্তীর দু-পাড় ভেসে যায় বিকেলের আলোর অবগাহনে। কাল্লুরাও জুড়ে যায় যৌথখামারের স্বপ্নে। এমন মায়াবী বিকেলেই বোধহয় রোদে ঝলকে ওঠা রূপালি ডানার চিলের মত স্বপ্নের উড়োজাহাজেরা উড়ে যেত। সেসব আজ যেন গতজন্মের কথা বলে মনে হয়…!
বইয়ের নাম : অনন্যবর্তী
লেখক : দুর্লভ সূত্রধর
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী, দুর্লভ সূত্রধর
মুদ্রিত মূল্য : ৩২০ টাকা
প্রকাশক : সুপ্রকাশ
সুপ্রকাশের পক্ষ থেকে এই বইয়ের অংশবিশেষ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘অনন্যবর্তী পড়ার ভূমিকা-পুস্তিকা’।
এই লিঙ্ক থেকে ডাউনলোড করে নিতে পারেন বিনামূল্যে, বন্ধুদের সঙ্গেও ভাগ করে নিতে পারেন।