অকূলের কাল। পর্ব ৯। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

আঙুলে আগুন

হস্টেলে রাজনৈতিক আলোচনা কমই হয়। যতই কম হোক, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এমনই টালমাটাল অবস্থা চলছে যে মাঝে মাঝেই কথাবার্তা শুরু হয়ে যায়। একবার হলে তা ডালপালা মেলতে শুরু করে। তা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় কে কোন দলের সমর্থক। ইদানীং মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জির সঙ্গে উপ-মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বনিবনা হচ্ছে না। কাগজে সেই নিয়ে হেডলাইন। নকশালবাড়ি আন্দোলনের সূত্রে সিপিএমের ভাঙ্গন নিয়েও নিত্য আলোচনা। কাগজ থেকে স্বাভাবিকভাবেই তার কিছু উঠে আসে নিজেদের আলোচনায়। কাকুর ব্র্যাকেটের সবাই একসুরে গায় না। শচি আর দিনু প্রবল সিপিএম সমর্থক। প্রদীপেরও সহানুভুতি সেদিকেই। জ্যোতি বসুকে পছন্দ নয় কাকুর। ধুতি পরলেও মানুষটা আদ্যোপান্ত শহুরে। সেই কারণে তার সহানুভুতি অজয় মুখার্জির দিকে। অভীক ঘোষিতভাবে রাজনীতি-বিরোধী। রাজনীতি নিয়ে কথা উঠলেই সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে – Politics is the last resort of scoundrels। কথাটা না-কি বার্নার্ড শ-এর। ঠিক কিনা জানে না কাকু। ইউ পি বি শ-এর ড্রামা পড়ান তাদের ক্লাসে। রাজনীতি নিয়ে এমন কথা শ বলে থাকলে তিনি কি কথা প্রসঙ্গেও বলতেন না! কেবল অনুপমের সমর্থন কোন দলের দিকে সেটাই কেউ বুঝতে পারত না। এখনও দিনু আর কাকু ছাড়া কেউ সেটা জানে না। দিনু শচি দুজনেই সিপিএমের ঘোর সমর্থক জেনেও দিনুর কাছে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে কেন তার বাধেনি, কাকু সেটা বুঝতে পেরেছে। দিনু চাঞ্চল্যকর খবর নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারে, শচি বা প্রদীপ সেটা পারে না। অনুপমের রাজনীতি ভীষণই বিপজ্জনক। অনেকের কাছে তা প্রকাশিত হলে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়বে। নিজেদের মধ্যে যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সেজন্য খানিক বাধ্য হয়েই সেদিন দিনু আর কাকুর কাছে মুখ খুলেছিল। মাঝখান থেকে কাকুর মন বিপ্লবের দিকে ঢলতে শুরু করেছে। ‘লাল সূর্য তোমার পায়ের তলায়, মাও’ বলে যে কবিতাটা সে লিখেছে, দুঃখ যে সেটা কাউকে পড়ানো যাবে না। অনুপমকে একবার দেখিয়ে লুকিয়ে রেখে দিয়েছে।

বড়দিনের ছুটি সামনেই। বেশির ভাগ ছেলেই এইসময় বাড়ি চলে যায়। যারা অন্য রাজ্য থেকে এসেছে তাদের কথা আলাদা। ট্রেনে আসতে যেতেই দু-তিন দিন যায়। এক সপ্তাহের ছুটিতে কুলোয় না। শচি কাকুর ব্র্যাকেটকে তার নিজের গ্রামে নিয়ে যাবে বলে লাফাচ্ছে। কাকুর খাওয়া নিয়ে তার খুব দুঃখ। কাকু আমিষ খায় না। দিনের পর দিন একটা ছেলে শুধু ডাল ভাত সবজি খেয়ে কীভাবে বেঁচে থাকতে পারে সে ভেবে পায় না। নিরামিষ খায় বলে মাছ মাংসের বদলে বিকল্প কিছু নিরামিষ রান্নার কোনো ব্যবস্থা নেই হস্টেলে। দিনু আর শচি একদিন ব্যোমকেশকে বলতে গিয়েছিল। সে পাত্তা দেয়নি। একজনের জন্যে আলাদা করে হাতিঘোড়া নিরামিষ রান্না সে করতে পারবে না। দরকার হলে সুপারের কাছে যাক তারা। সুপারের কাছে তো যাওয়া যায় না, মেস সেক্রেটারিকে গিয়ে ধরেছিল তারা। সে বলেছে, রোজ রোজ ব্যোমকেশকে আলাদা রান্নার কথা বলা যাবে না। তবে রবিবার তো মাংস হয়, সেদিন ক্ষিতির জন্যে এক ভাঁড় দই আনানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেই ব্যবস্থাই হলো, যদিও মিষ্টি দই কাকুর মোটেই পছন্দ নয়। সে একটুখানি খেয়েই পাশের জনদের বলে ভাগাভাগি করে খেয়ে নিতে।

দিনের বেলায় একসঙ্গে সবাই খেতে বসে না। যার যখন ক্লাস থাকে, সে খেয়ে বেরিয়ে যায়। ব্যোমকেশ রান্না সেরেই কেটে পড়ে। দফায় দফায় পরিবেশন করতে হয় মাধোদা আর সেই ফাইফরমাশ খাটা ছেলেটাকে। রাত্রে ডাইনিং হল ভরভরন্ত। প্রায় সবাই একসঙ্গে খেতে বসে। রাত্রের মেনু রুটি, মুসুর ডাল, একটা সবজি, আধখানা ডিম সহ ডিম-আলুর ঝোল আর চাটনি। এক একজনের রুটি খাওয়ার বহর দেখলে চোখ কপালে উঠে যায়। আগুয়ান আর অসিত বলে দুটো ছেলে থাকে নীচের তলায়। দুজনেরই লম্বা, মেদহীন চেহারা। পেট আর পিঠ একাকার হয়ে থাকে। প্রতিদিনই তাদের মধ্যে রুটি খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। রোজই প্রায় চল্লিশ ছুঁয়ে যায়। অসিত বিয়াল্লিশ, আগুয়ান চল্লিশ বা অসিত চল্লিশ, আগুয়ান একচল্লিশ। হিসেব মোটামুটি এরকম –

ডাল দিয়ে ৭ খানা, তরকারি দিয়ে ৮, ডিমের ঝোল ১০, বাড়তি ডাল তরকারি নিয়ে ১০, বাকি চাটনি ৫/৭।

কাকুর ব্র্যাকেট সেখানে কেবলই দর্শক।

শচি তার মনের ইচ্ছা পূরণ করেই ছাড়ল। কেবল অভীককেই বাগাতে পারল না। সে ছুটিতে হস্টেলেই থাকবে। নেশাবাজগুলোর জ্বালায় তার পড়াশোনা হচ্ছে না, সেগুলো বিদায় হলে কদিনে অনেকটা মেক আপ করতে পারবে। গুহ্য কথা সবাই জানে। বহু ধৈর্য আর অধ্যবসায় দিয়ে সে সুবুকে জয় করতে পেরেছে। এখন কদিন চুটিয়ে তার স্বাদ নেবে। তার বাবা-মারও অভীককে খুব পছন্দ। কাজেই বালিগঞ্জে তার অবারিত দ্বার।

দিনু, প্রদীপ, অনুপম আর কাকু শচির সঙ্গে সকালেই বেরিয়ে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে বর্ধমান লোকালে উঠে বসল। শচির গ্রামের নাম গোবর্ধনপুর। বর্ধমানে নেমে তারা কাটোয়া লাইনের ট্রেন ধরল। ভারী মজার ট্রেন। মিটার গেজ লাইন, নাম নাকি মার্টিন রেল। তিনটে কি চারটে বগি। দৌড়চ্ছে সাইকেলের বেগে। চলন্ত ট্রেন থেকেই যখন খুশি যাত্রীরা নামছে আবার খানিক দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়ছে। দেখেশুনে মজা পেয়ে গেল চারজনে। শুরু করে দিল ট্রেনের সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা। ট্রেনে ভিড় বিশেষ নেই। মানুষের চাইতে বোঁচকাবুচকিই বেশি। ওরা উঠেছে শেষের কামরায়। দিনু আর কাকু প্রথমে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে সামনের দিকে দৌড় লাগাল। তিনটে কামরা টপকে গিয়ে উঠে পড়ল সামনের দিকের একটা কামরায়। উঠেই দেখে পিছন পিছন প্রদীপ আর অনুপমও ছুটে আসছে সামনের দিকে। শচিই কেবল সকলের ব্যাগ আগলে বসে আছে নিজেদের জায়গায়। এই করতে করতে সব কামরাই দেখা হয়ে গেল তাদের। ভর দুপুরে ট্রেন এসে দাঁড়াল ‘নিগন’ নাম লেখা একটা ন্যাড়া স্টেশনে। শচি বলেছিল নিগোন স্টেশনে তাদের নামতে হবে। তাহলে এটাই কি সেই স্টেশন? ঠিক বুঝতে না পেরে তারা সবাই নেমে নিজেদের কামরার দিকে এগোচ্ছে, তাকিয়ে দেখে শচি পাঁচ পাঁচটা ব্যাগ কাঁধে পিঠে নিয়ে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে নামছে।

স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম বলতে কিছু নেই, খানিকটা উচু এবড়োখেবড়ো মরা ঘাসে ঢাকা জমি। যাত্রীদের বসার জন্য বেঞ্চ-টেঞ্চ কিচ্ছু নেই। স্টেশনের নাম লেখা একটা সাইনবোর্ড, তার খুঁটিগুলো একপাশে হেলে আছে; আর একটা এক কামরার পাকা ঘর। গাছপালা খুব কম, চারিদিকে ধু ধু করছে কাটা ধানগাছের গোড়া-ভর্তি ন্যাড়া মাঠ, মাঠের আলে অনেক ছাড়া ছাড়া দুটো একটা শ্যাওড়া আর বাবলা গাছ ধূলিধূসরিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গরুর গাড়ির লিকের একটা পথ মাঠের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে উত্তর দিকে চলেছে। সেই লিক ধরেই চলতে শুরু করল শচি, তার পিছন ধরল বাকি সবাই। চাষের জমি পেরিয়ে লিক চলল লম্বা একটা পোড়ো মাঠের উপর দিয়ে। শচি বলেছিল তিন মাইল রাস্তা। সে রাস্তা আর শেষ হতে চায় না। একটাও গ্রাম দেখা গেল না। তবে এবার বেশ ঘন গাছপালা দেখা যাচ্ছে। তার আড়ালেই লুকিয়ে ছিল গোবর্ধনপুর গ্রাম। টিনে ছাওয়া মাটির বাড়ি শচিদের। বিরাট উঠোন জুড়ে অনেকগুলো ধানের পালই। এই সবে মাঠের ধান ঘরে ঢুকেছে। ধান ঝাড়া শুরু হয়নি এখনও। শচির মা-বাবার বয়স খুব বেশি নয়। ভাই বোনদের মধ্যে শচিই বড়ো। মাঝারি গোছের চাষি শচির বাবা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকও বটেন। বাড়ির অবস্থা সচ্ছলই বলতে হবে। খুব খিদে পেয়েছিল সকলের। বাড়ির পিছনের পুকুরে চান সেরে নিয়ে চটপট খেতে বসে গেল সকলে।

তিন দিন ছিল ওরা। শচির মা সত্যি সত্যিই দারুণ সব নিরামিষ রান্না করে কাকুকে খাওয়ালেন। শুক্তো, ঘন থকথকে  আলুপোস্ত, সর্ষে দিয়ে সজনে ফুলের চচ্চড়ি, ধোকার ডালনা। ভাজাভুজি তো ছিলই। আর ছিল কাকুর ভীষণ প্রিয় তেঁতুলের চাটনি। বাকিদের জন্য পুকুর থেকে ধরা টাটকা রুই মাছ ভাজা আর কালিয়া। সন্ধেবেলায়  শচির মায়ের হাতে ভাজা হলুদ মুড়ি খেয়ে কাকু তো মোহিত। চালভাজার সঙ্গে বাদাম ছোলা আর কুসুম বীজ মেশানো সেই মুড়ি জীবনে প্রথম খেল কাকু। তাদের দেশে এর চল নেই। কুসুম বীজও সেই প্রথম দেখা। আহা কী দারুণ গন্ধ!

প্রথমের সেই শেষ নয়। আরও এক নিষিদ্ধ জিনিসের প্রথম স্বাদ পেল। দ্বিতীয় দিন সন্ধেবেলা শচি বলল, – চল আজ তোদের এমন একটা জিনিস দেখাব ভুলতে পারবি না জীবনে।

কী দেখাবে শচি! সবাই কৌতূহলে টইটম্বুর। মেয়েঘটিত কিছু না-কি! হাজার প্রশ্নেও কোনো ক্লু দিচ্ছে না সে। কাকুর একটু ভয় হচ্ছে – কী না কী দেখাতে গিয়ে ঝামেলায় ফেলে দেবে না তো! গ্রামের অন্ধকার রাস্তা দিয়ে শচির পিছন পিছন চলেছে তারা। বেশ কিছুটা এসে একটা খড়ো চালের মাটির ঘরের দরজার কাছে এসে শচি হাঁক দিল, — ধনাদা আছো নাকি?

একটা রোগা আধবুড়ো লোক দরজার বাইরে একটা কুপি হাতে এসে দাঁড়াল। শচিকে দেখেই বেশ খুশি খুশি গলায় বলল, –আরে সচেখুড়ো, কবে এলে?

শচি বলল, –জিনিস আছে তো? এই দেখ কাদের নিয়ে এসেছি। সবাই আমার কলেজের বন্ধু।

খুব ব্যস্ত হয়ে উঠল লোকটি। –এস এস – বলেই কুপিটা ঘরের মেঝেতে নামিয়ে ঘরের কোণ থেকে একটা তালাই নিয়ে পেতে দিল। বলল, –আসেন আসেন, বসুন সবাই।

শচি বলল, — ভালো জিনিস বের করো দেখি একটা।

লোকটি একটা বেঁটে বোতল ঘরের কোণ থেকেই বের করে এনে তালাইয়ের একপাশে রাখল। সঙ্গে শালপাতায় এক দলা নুন।

কাকু ভীষণ অবাক। প্রায়ান্ধকার ঘরের বাতাসে একটা কড়া গন্ধ ঘুরপাক খাচ্ছে। জিনিসটা কী হতে পারে আন্দাজ করতে পারছে সবাই। কিন্তু নুন কেন?

শচি বলল, নুন দিয়েই এটা খেতে হয়। এক চুমুক দিয়ে একটুখানি নুন জিভে ঠেকালেই মাথা পরিষ্কার। মেজাজ ফুরফুরে। ধনাদা একবার দেখিয়ে দাও তো তোমার চোলাইয়ের মহিমা।

ধনাদা বোতল থেকে একটুখানি তরল তার আঙুলে ঢেলেই আঙুলটা কুপির শিখায় ধরল। সঙ্গে সঙ্গেই দপ করে আগুনের শিখা জ্বলে উঠল ধনাদার আঙুলে।

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply