অকূলের কাল। পর্ব ৮। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

সদর দপ্তরে কবিতা দাগাও

নকশালবাড়ি, নকশাল, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল আর নকশাল আন্দোলন – এইসব শব্দ, নাম ইত্যাদি জানা ছিল ক্ষিতির। নকশালবাড়ি উত্তরবঙ্গের একটা প্রত্যন্ত জায়গা, সেখানে কৃষকরা একটা সশস্ত্র আন্দোলন করেছে জমি দখলের। পুলিশ সেই আন্দোলনকে দমন করতে গুলি চালিয়েছে কৃষকদের উপরে, নজন মারা গেছে পুলিশের গুলিতে – খবরের কাগজ পড়ে এইটুকুই জানা তার। রাজনীতি বিষয়ে আগ্রহ বা ভাবনা – কিছুই নেই ক্ষিতির। তাদের পরিবারের সকলেই অবশ্য কংগ্রেসকে ভোট দেয়। ক্ষিতির বড়দা তো কংগ্রেসের এক ছোটোখাটো নেতা। বাবা ভীষণ গান্ধিভক্ত। তাঁর ডাকে বিদেশি শিক্ষা বর্জন করে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিছুদিন জেলও খেটেছেন। স্বাধীনতার পরে তাঁর নির্দেশ মেনে কংগ্রেস দল ছেড়ে সাইকেলে চেপে ইতিউতি ঘোরেন আর নানাভাবে লোকের উপকার করে বেড়ান। কিন্তু সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে তাঁকে বিশেষ মাথা ঘামাতে দেখেনি ক্ষিতি। ৬৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস হেরে যাওয়ার পরেও তাঁর তেমন তাপ-উত্তাপ দেখা যায়নি। ৬৮-৬৯–এ সে যখন গড়বেতা কলেজে পড়ে, সেসময় চোখে ছানি হয়ে প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বাবা। বাইরে বেরোনো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময় ক্ষিতি লাইব্রেরি থেকে কয়েকটা বই নিয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে একটা শৈলেশ দে-র লেখা ‘আমি সুভাষ বলছি’। ক্ষিতি বই বলতে সাধারণত গল্প-উপন্যাস পড়ে। কিন্তু শ্যামলের মামা তাকে দুটো বই পড়তে বলেছিল কলেজ লাইব্রেরি থেকে নিয়ে – এই বইটা আর একটা সম্ভবত সৌরীন সেন বলে এক লেখকের ‘আখের স্বাদ নোনতা’। দুটো বই-ই বেশ ভালো লেগেছিল ক্ষিতির।

বাবা চোখে দেখেন না বলে সারাদিন প্রায় শুয়েই থাকেন। ক্ষিতির সঙ্গে পড়াশুনা নিয়ে দু-চারটে কথা হয়। সুভাষের বইটার নাম শুনে বললেন, – জোরে জোরে পড়ো তো শুনি কী লিখেছে।

ক্ষিতি পড়ে চলেছে, বাবা শুনছেন। আর মাঝে মাঝেই সক্রোধে প্রতিবাদ করে উঠছেন। কখনও বলছেন ‘না না’, কখনও বলছেন ‘এই লেখক নির্বোধ, গান্ধি-দর্শনের গভীরে ঢোকার বোধই নেই’; আবার কখনও বলে উঠছেন, ‘মিথ্যে লিখেছে’। বই শেষ হলে অনেকগুলো কথা বলেছিলেন বাবা। বলেছিলেন, ‘সারাটা জীবন পরীক্ষানিরীক্ষা করে অহিংসার শক্তিকে আত্মস্থ করেছিলেন মহাত্মাজি। বুঝেছিলেন হিংসার শক্তি দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা, রাষ্ট্রযন্ত্র হয়তো দখল করা যায়, স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না। অহিংসা ভয়কে জয় করতে শেখায়। ভয়কে জয় করতে পারলেই মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করে। রাষ্ট্রশক্তি বিদেশির হাতেই থাকুক বা দেশের মানুষের হাতে, তা কেবলই ক্ষমতার দাসত্ব করে চলে। সুভাষ স্পষ্টতই হিংসা ও অস্ত্রের শক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন, তাই তাঁর হাতে কংগ্রেসের নেতৃত্ব তুলে দিতে চাননি তিনি। স্বাধীনতার পরে আরও বোঝা গেল, যাঁদের উপর তিনি ভরসা করেছিলেন, তাঁরাও অহিংসা মন্ত্রে দীক্ষিত হতে পারেননি, রাষ্ট্রক্ষমতার ফাঁসে আটকা পড়েছেন।

বাবার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝেনি সেদিন ক্ষিতি। আজ অনুপমের কথাগুলোও তেমনই তার মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। অনাথদার কথার সূত্র ধরে অনুপমের কাছ থেকে সত্যটা বের করার চেষ্টা করছিল কাকুর ব্র্যাকেটের সবাই মিলে। এড়িয়ে যাচ্ছিল অনুপম। শেষ পর্যন্ত মুখ খুলতেই হলো তাকে। এখন সে তাদেরকে, বিশেষত দিনু আর কাকুকে নিজের মতে দীক্ষিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনুপম বলে চলেছে সারা বিশ্বের বিপ্লবী আন্দোলনের কথা – ফ্রান্সের নয়া বাম আন্দোলন, চিনের রেড গার্ড আন্দোলন। রেড আর্মির লং মার্চ। চিনের প্রদর্শিত পথেই ভারতের জনগণ মুক্তি লাভ করবে। মুক্তি মানে শোষণ থেকে মুক্তি, সাম্যের প্রতিষ্ঠা। কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারার নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট সরকার ক্ষমতা দখল করবে। লিন পিয়াও বলেছেন, ‘লং লিভ দ্য ভিকটরি অফ পিপলস ওয়ার, গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেল’। এই কম্যুনিস্ট পার্টি সংশোধনবাদী সিপিএম পার্টি নয়, নকশালবাড়ি থেকেই নতুন পার্টির জন্ম হয়েছে – সিপিআই এমএল, মার্কসবাদী লেনিনবাদী। আমাদের নেতা চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, সরোজ দত্ত। চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। আমাদের পার্টির উপর একযোগে আক্রমণ শানাচ্ছে পুলিশ, মিলিটারি, কংগ্রেসি গুন্ডা আর সিপিএম। সব আক্রমণ ব্যর্থ করে বিপ্লবকে জয়যুক্ত করতে হবে, হবেই। মাও বলেছেন লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে হবে। ছাত্র ও যুবশক্তি দলে দলে যোগ দিচ্ছে পার্টিতে। মেধাবী ছাত্ররা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে। কৃষকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মজবুত সংগঠন গড়ে তুলছে। শ্রেণিশত্রুদের চিহ্নিত করে খতম অভিযান চালাচ্ছে। ‘ঘটনা ঘটাও, শহরে চে, গ্রামে মাও’। শহরে গেরিলা যুদ্ধ চালাতে হবে, গ্রামের সংগঠন ক্রমশ চারিপাশ থেকে ঘিরে ধরবে শহরকে।

শুনতে শুনতে অবাক হচ্ছিল কাকু। অনুপম খুবই শান্ত, হাসিখুশি ছেলে, মাউথ অরগ্যান বাজাতে ভালোবাসে।  ভেতরে ভেতরে সে এতখানি জড়িয়ে গেছে এই ভয়াবহ আন্দোলনের সঙ্গে! দিনু তো মুগ্ধ হয়ে শুনছে। প্রভাবিত কাকুও। কিন্তু তার ভেতর থেকে বাধাও উঠে আসছে। বাবার অহিংসানীতি তার ঠিক বলে মনে হয়নি কোনোদিনই। এক গালে চড় মারলে অন্য গাল এগিয়ে দেবে – এ আবার কেমন কথা! আবার বিপ্লবের পথে যেভাবে রক্ত ঝরার কথা আসছে সেটা যুক্তি দিয়ে মেনে নিলেও মন যেন ঠিক সায় দিচ্ছে না। তার চোখে ভাসছে কলেজের বাথরুমে পড়ে থাকা এস এফ ছাত্রের ছুরিবেঁধা রক্তাক্ত শরীর।

অনুপম অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু তার কণ্ঠস্বর নিচুগ্রামে বাঁধা। ঘরের দরজা বন্ধ। কাকু নিশ্চিত অনুপমের গলার আওয়াজ বাইরে যাচ্ছে না। সে একটু থামতেই কাকু জিজ্ঞেস করল, – কিন্তু অনুপম, অনাথদা যে বলল কতোগুলো সমাজবিরোধী টাইপের ছেলে তোর খোঁজে আসে – কেন?

অনুপম একটু ভাবল। তারপর বলল, – তোদের দুজনকে আমি খুব বিশ্বাস করি। তাই খুলে বলছি। এই নিয়ে কারোর সঙ্গে, এমনকি শচি অভীক প্রদীপের সঙ্গেও একটি কথা নয়। যেকোনো দিন পুলিশের খোঁচড় আমার পিছনে লাগতে পারে, কী থেকে কী হয় কিছুই বলা যায় না। যা শুনবি, শুনেই ভুলে যাবি। পার্টির সব ইউনিটেই কাজের পদ্ধতি দুটো ভাগে বিভক্ত। একটা ভাগে মূলত ছাত্ররা কাজ করে। তাদের কাজ পার্টির তত্ত্ব প্রচার, প্রচারপত্র বিলি করা, অন্য ইউনিটের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, মূর্তি ভাঙ্গার কর্মসূচি তৈরি আর নতুন ছেলেদের নিয়ে আসা। অন্যটা অ্যাকশন স্কোয়াড। চিহ্নিত শ্রেণিশত্রুকে ‘অ্যানহিলেট’ মানে খতম করা। এই কাজটা কম ছাত্রের পক্ষেই সম্ভব। আমরা যাদের অ্যান্টিসোশ্যাল বলি তারা তো বুর্জোয়া সমাজেরই ফসল। আমাদের ভাষায় ‘লুম্পেন প্রলেতারিয়েত’। এদেরকেও অনুপ্রাণিত করা সম্ভব। খতম অভিযানে এরা আমাদের বড়ো সহায়। পার্টির আনুগত্য যতই প্রবল হোক, আমাদের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ নিঃস্পৃহ হয়ে শ্রেণিশত্রুর রক্তে হাত রাঙাতে বাধা দেয়। অথচ চারু মজুমদার বলেছেন, ‘বস্তুত একটা সময়ে আওয়াজ উঠবে, যে শ্রেণিশত্রুর রক্তে হাত রাঙায়নি সে কমিউনিস্ট নামের উপযুক্ত নয়’।

অনুপমের কথায় কাকু খুব অস্বস্তিতে ভুগছিল। এই হিংসা, খুনোখুনির শেষ কোথায়?

কাকুর কথার প্রতিক্রিয়ায় অনুপম বলল, – মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী ফানোঁ এর উত্তর দিয়েছেন, শোন। হিংসা হল শোধনকারী শক্তি – a cleansing force। হিংসাই একমাত্র ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিরাময় পদ্ধতি। হিংসা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবে। করে তুলবে নির্ভীক, তার আত্মসম্মান ফিরিয়ে এনে তাকে পূর্ণ মানবে পরিণত করবে।

কাকুর সংশয় গেল না। বিপ্লব সফল হলে হয়তো তা হতে পারে। কিন্তু সফল হবে কি? সদর দপ্তরে কামান দাগা সত্যিই কি সম্ভব হবে?

অনুপম এবার অতি সন্তর্পণে তার একটা মোটা ফিজিক্সের বইয়ের মধ্যে খোপ কেটে বসিয়ে রাখা লাল মলাটের ছোট আকারের বই বার করল। সেটা মাথায় ঠেকিয়ে বলল, – এই আমাদের বেদ বাইবেল কোরান – রেড বুক। লিন পিয়াও-এর ভূমিকা সহ এর মধ্যে আছে চেয়ারম্যান মাও-এর উপদেশ।

কাকু সেটা হাতে নিয়ে পাতা উলটাতে উলটাতে ঠিক করল, বিপ্লব সফল হোক বা না হোক, মাওকে নিয়ে একটা কবিতা তাকে লিখতেই হবে। আদর্শবাদ – যেমনই হোক, ঠিক বা ভুল – তার চোখে জল এনে দেয়। যদি এই সব তরুণের আত্মবলিদান বিফলও হয়, তার শ্রদ্ধা সে জানিয়ে রাখবে বিপ্লবের নেতা মাও সে তুং-কে।

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply