অকূলের কাল। পর্ব ৬। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ

……………………………….

মনোজিৎদার সঙ্গে কিছুদিন ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার পর খানিক হীনম্মন্যতায় ভুগছে কাকু। লেখায় এবং জ্ঞানবুদ্ধিতে সে যে অনেক পিছিয়ে তা পরিষ্কার বুঝেছে। তখন থেকেই লেখালেখির ব্যাপারে সে নিজের মনোভাব বদলেছে। উপন্যাস আর নয়, ‘ভবেনের অস্ত্রশস্ত্র’ নাম নিয়ে অনর্থক চিন্তা না করে কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে একটা মিলনান্তক উপসংহারে শেষ করে ফেলল সেটাকে। এখন সে কবিতা লেখার চেষ্টা করছে। ইচ্ছে আছে কিছুদিন পরে ছোট গল্প চেষ্টা করে দেখবে। তবে তার পুরনো ভাষা এবং আঙ্গিক একেবারেই নয়। কবিতা লেখার সময় যেমন মনোজিৎদার কবিতার কথা মাথায় রাখে, তেমনই গল্প লেখার সময় তার গদ্য অনুসরণ করার চেষ্টা করবে।

বেশ কয়েকটা কবিতা লিখে সেগুলো মনোমতো না হওয়ায় বাতিল করার পর শেষ দুটো মনে হল, মন্দ হয়নি। মনোজিৎদার কাছে দুরুদুরু বুকে নিয়ে এল সে-দুটো। ভয় ছিল, উপন্যাসটার মতো কবিতাগুলো দেখেও ‘ওরে বাবা, ও আমি পড়তে পারব না’ যদি বলে! তেমন কিছু বলল না। বরং মন দিয়েই পড়ল। শেষ হতে বলল, – মন্দ হয়নি। ছন্দ ঠিক আছে।

কাকু তো অবাক। কবিতা দুটোয় সে অন্ত্যমিল দেওয়ার চেষ্টা করেনি। সে ছন্দ বলতে কেবল দুটোই জানে – পয়ার আর অমিত্রাক্ষর। ক্লাস ইলেভেন পর্যন্ত তার বাংলা বিদ্যা। কলেজেও পার্ট ওয়ানে একটা আবশ্যিক পেপার বাংলা। হায়ার সেকেন্ডারিতে ছন্দ আলাদা করে পড়তে হয়নি। কলেজে পাস কোর্সের বাংলাতেও ছন্দ নেই। ইস্কুলে বরং বাংলার পাঠ-সংকলনে ভারতচন্দ্র, ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে মধুসূদনেরও কবিতা ছিল। সেসব পড়তে পড়তে পয়ার আর অমিত্রাক্ষর চেনা।

মনোজিৎদা তখন কবিতা দুটো থেমে থেমে পাঠ করে শোনাল। তারপর বলল, এই ছন্দটার নাম অক্ষরবৃত্ত। প্রতিটি পর্বে নির্দিষ্ট সংখ্যায় অক্ষর বা সিলেবল আছে। কাকু বলল, – আমি না জেনে লিখে ফেললাম কীকরে?

মনোজিৎদা বলল, – এই যে কদিন ধরে তুমি আমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে এতগুলো পত্রিকার কবিতা পড়ছ, তাতেই নিজের পছন্দমতো ছন্দের কান তৈরি হয়ে গেছে। এসব হওয়ার হলে শুনেই হয়, শিখে হয় না।

কলেজে সে ক্ষিতিই। সেখানে ‘কাকু’ সংক্রামিত হওয়ার কোনো কারণ ঘটেনি। ক্লাসের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়েছে। ওইটুকুই। হৃদ্যতা হয়নি কারোর সঙ্গেই। অজয়, বিশ্বেশ্বর, কল্লোল। বিশ্বেশ্বর মেদিনীপুরের কাঁথির কোনো এক গ্রামের ছেলে। ধুতি আর শার্ট পরে কলেজে আসে। মেদিনীপুরের দক্ষিণ অঞ্চলের আরও দুজন ছেলে আছে। তারা যদিও ধুতি পরে না। বিশ্বেশ্বর, দেখা গেল, ধুতি পরলেও পড়ুয়া দুর্দান্ত। অনার্সের এলিমিনেশন টেস্টে সে ফার্স্ট হয়েছে। ক্ষিতি সেখানে কোনোরকমে উতরে যাওয়া ছেলেদের দলে। কিছুদিন পরে জানা গেল, সে ভালো সাঁতারুও। বউবাজার সুইমিং ক্লাবে এখন নানারকম কেতার সাঁতার শিখতে ভর্তি হয়েছে। ক্ষিতি নিজেও জলের পোকা ছিল। কিন্তু ভালো সাঁতারু হতে নাকি ব্যাকরণসম্মত সাঁতার শিখতে হয়। সেই ব্যাকরণ রপ্ত করার জন্য বিশ্বেশ্বরের ঝোলা ব্যাগে বইখাতার সঙ্গে সুইমিং কস্টিউমও থাকে। কলেজশেষে সে সোজা চলে যায় গোলদিঘিতে।

অজয় আর কল্লোলের সঙ্গে ইদানীং ক্ষিতির কথাবার্তা একটু বেশিই হচ্ছে। কারণ ওদেরও লেখালেখির অভ্যাস আছে। অজয় দারুণ দেখতে। সবসময় হাসিমুখ আর তার কথার ভঙ্গি খুবই শহুরে। সে নিজে খুব কম লেখে কিন্তু সাহিত্যপাঠে অনেক এগিয়ে। হাড়সর্বস্ব, চুপসানো গাল, লম্বা চুলের কল্লোলকে পাগলাটে মনে হয় ক্ষিতির। ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে সে অনর্গল লিখে যায়, মনে হয় তার কলম থেকে ঝরনা নামছে। ক্ষিতিকে পড়তে দেয় সে নিজের লেখা। জানতে চায় কেমন লাগল। বিপদে পড়ে যায় ক্ষিতি। কল্লোলের লেখায় প্রতিটি বাক্যই যেন স্বাধীন। একের সঙ্গে অন্যের কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। আবার বাক্যের পদবিন্যাস এমনই যে ক্ষিতির সন্দেহ হয় ভাষাটা আদৌ বাংলা কি-না। ক্ষিতি ততদিনে কমলকুমার মজুমদারের নাম শুনেছে মনোজিৎদার কাছে। তাঁর লেখার কিছু নমুনাও দেখেছে। তার মনে হয়, কল্লোল হয় কমলকুমারের মতো অনেক উঁচুদরের লেখক, নয় পুরোপুরি পাগল হবে একদিন।

আবশ্যিক বাংলা আর অ্যাডিশনাল ইংলিশ ছাড়া একটা অন্য বিষয়ও নিতে হয় পাস কোর্সে। ক্ষিতি নিয়েছে ফিলজ়ফি। ক্লাস করা বিশেষ হয় না – না বাংলা, না ইংলিশ, না ফিলজ়ফি। অনার্সের ক্লাস করতেই হয়। কেজিসি হলেন বিভাগীয় প্রধান। অজয় বলে ‘হেডু’। ক্ষেত্রগোপাল চট্টোপাধ্যায়। কার্লাইলের বক্তৃতা আর পোয়েট্রি পড়ান। কবিতার ক্লাস নিতে নিতে বিভোর হয়ে তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ়, টেনিসন আবৃত্তি শুরু করেন আবেগমথিত কণ্ঠে। ক্ষিতির সবচেয়ে ভালো লাগে ইউপিবির পড়ানো। উমাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। ধুতি আর শার্ট পরা কালো, লম্বা মানুষটি মূলত ড্রামার ক্লাস নেন। বার্নার্ড শ-র ‘আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান’–এর সেই চকোলেট সোলজার। আদ্যন্ত রোম্যান্টিক ক্ষিতির মাথা থেকে যাবতীয় রোমান্স ঝেঁটিয়ে বিদায় করবেন যেন শ! নাটক পড়ান আরসি-ও। রমেশ চক্রবর্তী। ফরসা ছোটোখাটো মানুষ, পরনে সাদা ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি। আর আছেন এসকেবি। সমরেন্দ্র কুমার বসু। প্যান্ট শার্ট পরেন। মাঝারি চেহারা। চার্লস ল্যাম্ব-এর ‘এসেজ় অব ইলায়া’ পড়ান। ভারী সুন্দর তাঁর কণ্ঠস্বর, তেমনই বাচনভঙ্গি। তাঁর লেকচার শুনতে শুনতে ঘোর লেগে যায় ক্ষিতির। প্যান্ট শার্ট পরেন এসজি-ও। সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়। একেবারেই তরুণ। সদ্য সদ্য অধ্যাপনায় ঢুকেছেন। ফরসা লম্বা চওড়া সুপুরুষ চেহারা। ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ পড়াচ্ছেন। বোঝাই যায় পড়ানোর জন্য বেশ পরিশ্রম করতে হচ্ছে তাঁকে। তাঁর আর একটা পরিচয় – তিনি কলেজের প্রিন্সিপাল, অমৃতলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলে। এএলজি-ও ইংরাজির অধ্যাপক। তাঁর ক্লাস করার সুযোগ পাওয়া যাবে সেই থার্ড ইয়ারে। রেটরিক অ্যান্ড প্রসোডি পড়াবেন তিনি। অলংকার আর ছন্দ। বাংলা ভাষার অলংকার ক্ষিতি ভালোই জানে। তার প্রিয় বিষয়। ইংরাজির অলংকার জানতে অপেক্ষা করতে হবে।

সেদিন একটা অনার্সের ক্লাস ছিল ইউপিবির, একেবারে শেষ পিরিয়ডে। মধ্যিখানে দুটো ক্লাসের মধ্যে একটা পাসের বাংলা ক্লাস, আর একটা অফ। নীচের গেমস হলে গিয়ে টেবিল টেনিস, ক্যারম – কোনো বোর্ডই ফাঁকা পেল না ক্ষিতি। কিছু যখন করার নেই আর ইউপিবির ক্লাস মিস করারও ইচ্ছে নেই, অগত্যা বাংলার ক্লাসে ঢুকে পড়ল। অনার্সের মতো ছোট ছোট খোপে পাসের ক্লাস হয় না। ছাত্র অনেক বেশি হওয়ার কথা বলে পাসের ক্লাস সব সময়ই হয় হলের মতো বড়ো বড়ো রুমে। দোতলার তেমনই একটা ঘরে বাংলার ক্লাসে পিছনের দিকের বেঞ্চে গিয়ে বসল ক্ষিতি। দুপুর একটা-দেড়টা হবে। ক্লাস শেষ হতে বিশেষ দেরি নেই, ভয়ংকর শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল সারা ঘরটা। নীচ থেকে একটা ক্ষীণ শ্লোগানের আওয়াজ শোনা গেল কি গেল না, সারা কলেজ যেন এক মুহূর্তের জন্য নিথর, নিঃশব্দ হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই হুড়মুড় করে সবাই একসঙ্গে ঘরের তিনটে দরজা দিয়ে বেরোবার উপক্রম করতেই স্যার চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, – কেউ বেরোবে না এখন। প্রিন্সিপ্যাল নিশ্চয়ই পুলিশকে ফোন করেছেন। পুলিশ এসে পৌঁছলে ঘর থেকে বেরোবে।

কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়াল সবাই। কিন্তু বেশিক্ষণ তর সইল না সকলের। বেশ কিছু ছেলে একটু পরেই ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। ক্ষিতিও। সিঁড়ির নীচেই বাথরুম। সেদিকে তাকিয়েই সারা শরীর হিম হয়ে গেল ক্ষিতির। একটা ছেলে বাথরুমের সদ্য-ভাঙ্গা দরজার চৌকাঠে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার পিঠে আমূল বিদ্ধ একটা ছোরা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বাথরুমের ভিতর বাহির। সম্বিত ফিরতেই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে কলেজের গেট দিয়ে বেরিয়ে গলিতে পড়ল ক্ষিতি। গলি শেষে চওড়া রাস্তা, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট। তখনই বিবেকানন্দ রোডের দিক থেকে হুটার বাজিয়ে ছুটে এল একটা পুলিশ ভ্যান। গলির আগে কলেজ হস্টেলের গেট। তার সামনেই দাঁড়িয়ে গেল ভ্যানটা। হাতে বন্দুক বাগিয়ে পিলপিল করে নেমে এল একদল পুলিশ। তাদের পিছনেই রিভলভার হাতে বুকে কাঁধে ব্যাজ লাগানো কয়েকজন অফিসার। তিনটে দলে ভাগ হয়ে তারা গলির মুখে তিন দিক ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল। কে যেন পিছন থেকে বলল, — তাড়াতাড়ি হাত দুটো উপরে তুলে দাও, নইলে পুলিশ গুলি চালিয়ে দেবে। ক্ষিতি হাত দুটো উপরে তুলতে তুলতে পিছন ফিরে দেখল তাদের কলেজেরই একটা ছেলে। মুখ চেনা – কোন সাবজেক্ট, কোন ইয়ার কিছুই জানে না। ক্ষিতি দেখল রাস্তার সবাই দুহাত তুলে হাঁটছে। একজন পুলিশ অফিসার রিভলভার তুলে সবাইকে এগিয়ে যাওয়ার ইশারা করছে। বিবেকানন্দ রোডের কাছাকাছি এসে পাশাপাশি হলো দুজনে। ছেলেটার বাড়ি শ্যামবাজার। বিবেকানন্দ রোডের মুখ থেকেই সব বাসকে ডাইনে বাঁয়ে ঘুরিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। কলেজ স্ট্রিটের দিক থেকেও কোনো বাস ট্রাম আসছে না। পুলিশ নিশ্চয় তাদের কলেজ স্ট্রিট মোড় থেকেই অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে।

ছেলেটা বলল, — নকশাল ছাত্ররা আজ বদলা নিল। ছুরি খাওয়া ছেলেটা এস এফ -এর নেতা। আমাদের কলেজ এস এফের হলেও হস্টেলটা নকশালদের ডেন। ছেলেটাকে মেরে ওরা কেউ পালিয়ে যায়নি। হস্টেলেই ঢুকে পড়েছে। পুলিশ হস্টেলে ঢুকতেই পারে না। দুর্গ বানিয়ে রেখেছে। কিছুদিন এখন গলির মুখে পুলিশ পাহারা থাকবে। আমাদের চৈতন্যদেব হয়েই যাতায়াত করতে হবে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *