অকূলের কাল। পর্ব ৪৪। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
গল্পের আইনি বয়ান
সত্যকিঙ্করের মুখ থেকে সদাই ম্যাজিক-কথা বেরিয়ে আসে। বলে কি – মনসুর সাহেব যেরকম চিঠি চাইছেন সে-চিঠির হদিশ আমি বাতলে দিচ্ছি তোমাকে। তুমি তো গল্প লিখতে পারো, আর এ তো সামান্য চিঠি! ধরো নাও তোমার গল্পের নায়িকা দোলনের মতো বাপের বাড়িতে বন্দী। ধরে নাও সে – তোমার মতো নয়, সত্যিকারের সাতপাকে ঘোরা স্বামীর কাছে আকুল হয়ে চিঠি লিখছে সে যেন অবিলম্বে তাকে নিজের কাছে নিয়ে যায়। এবার সেইরকম চিঠি গোটা তিনেক চটপট লিখে ফেলো। তারপর সেগুলো জলির হাতে তুলে দাও। তার কাজ হবে দোলনের সঙ্গে দেখা করে বলা, সে যেন চিঠি তিনটে নিজের হস্তাক্ষরে হুবহু নকল করে জলির হাতে চালান করে দেয়।
নিখুঁত পরিকল্পনা। তবুও খুঁতখুঁত করে ক্ষিতির মন। শেষ পর্যন্ত জাল চিঠির সাহায্যে এরকম একটা পবিত্র সম্পর্কে ঢুকতে হবে তাকে! দ্বিধা কাটতে দেরি হলো না অবশ্য। সে তো পণ করে বসেই আছে কবে থেকে যেকোনো মূল্যে দোলনকে নিজের করে পাওয়ার জন্য।
সেদিন রাতেই সত্যকিঙ্করের হিসেবমতো পিছনের তারিখ দিয়ে চিঠি তিনটি রচনা করে পরের দিনই জলির হাতে সেগুলো দিয়ে এল ক্ষিতি। জলি তিন দিন মাত্র সময় নিল কাজটা হাসিল করতে। চারদিনের দিন সে নিজেই এসে হাজির নরজিতের কোয়ার্টারে দোলনের হস্তাক্ষরে ক্ষিতি-রচিত চিঠিগুলি নিয়ে। জলির দক্ষতায় সত্যকিঙ্করও বিস্মিত। সে ক্রমশই জলির গুণমুগ্ধ হয়ে উঠছে। বলেই ফেলল, – তোমার মতো মেয়ে দু-চার জন যদি আমাদের পার্টিতে পাওয়া যেত!
জলি সেকথায় অবশ্য কর্ণপাতও করল না। ভদ্রতার হাসি দিয়ে উত্তর এড়িয়ে গেল। সত্যকিঙ্কর অগত্যা চিঠিগুলোকে নিয়ে কিছুক্ষণ কসরত করে তাদের চেহারার টাটকা ভাব কিছুটা মলিন করে তুলল।
পরের দিন সত্যিকারের চারটে আর তৈরি করা তিনটে মোট সাতটা চিঠি নিয়ে ক্ষিতি হাজির হলো মনসুর সাহেবের চেম্বারে। চিঠিগুলো পড়ে নিয়ে পুরনো একটা আর নতুন তিনটে চিঠি বেছে নিলেন মনসুর সাহেব। তারপর তার উলটো দিকে বসা তার জুনিয়ার সেই দীঘল তরুণীটিকে ডিক্টেশন দিতে শুরু করলেন। সামান্য দূরে বেঞ্চিতে বসে ক্ষিতি মুগ্ধচিত্তে মনসুর সাহেবের গল্পের আইনি বয়ান শুনে যেতে লাগল।
In the High Court of Calcutta.
Extra-ordinary Original Criminal Jurisdiction.
In the matter of
An application under section 491 of the Code of Criminal Procedure
And
In the matter of
Illegal and or improper detention of Smt. Dolan Goswami, nee Dolan Basak alias Putul Basak by the Respondent.
And
In the matter of
Kshiti Goswami on behalf of his wife Dolan Goswami, nee Basak alias Putul Basak
Petitioner
Versus
Shri Panchanan Basak son of Late Khagesh Chandra Basak, resident of 28/1A Hari Ghosh Street P.S Burtolla Calcutta- 6.
Respondent.
To
The Hon’ble Mr. Sankar Prasad Mitra, Chief Justice and his companion Justices of the said Hon’ble court,
The humble petition of the petitioner above named,
Most respectfully sheweth :-
১। বীণাপাণি পর্দা গার্লস স্কুলের সার্টিফিকেট থেকে দেখা যাচ্ছে যে উপরোক্ত দোলন ইত্যাদি নামের মেয়েটির জন্ম তারিখ ২১/০৫/১৯৫৪ (annexture A) এই দরখাস্তের সঙ্গে দেওয়া হল।
২। দরখাস্তকারী ক্ষিতি এবং দোলন ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং দিনে দিনে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গাঢ় হয়। মেয়েটি যখন নেহাতই শিশু তখনই তার মা-বাবা দুজনেরই মৃত্যু হওয়ার ফলে সে তার মামা, রমানাথ বসাকের ৫৬, হরি ঘোষ স্ট্রিটের বাড়িতে বড় হতে থাকে। আট-দশ বছর বয়স হওয়ার পর থেকে তার দাদা, উপরোক্ত বিবাদী পঞ্চানন বসাক তাকে মামাবাড়ি থেকে নিয়ে আসে এবং তার পর থেকে সে নিজের দাদাদের যৌথ পরিবারে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করে। তবে সে প্রায়শই মামার বাড়ি আসত এবং সেখানে থেকেও যেত কয়েকদিন। দরখাস্তকারীর সঙ্গে তার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা কিছুদিন পরেই জানাজানি হয়ে যায়। প্রথমে মামাবাড়িতে, পরে নিজের বাড়িতে। এই সম্পর্কের কথা জানতে পেরেই বিবাদী অর্থাৎ দোলনের বড়দা ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং তাদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করার এবং সেই সম্পর্ক ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হন। তাকে বাড়িতে আটকে রাখা ছাড়াও তার উপরে দৈহিক নির্যাতনও করতে থাকেন।
৩। সেই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দোলন বিগত ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট তার হরি ঘোষ স্ট্রিটের বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে নদীয়া জেলার অন্তর্গত দেবগ্রামে দরখাস্তকারীর সঙ্গে দেখা করে। সেসময় দরখাস্তকারী সেখানেই অবস্থান করছিল। সেখান থেকে তারা দুজনে চলে আসে কলকাতার যাদবপুর থানার গোবিন্দপুরের ১ এ, রহিম ওস্তাগর রোড ঠিকানায়। ২০ আগস্ট তারিখে হিন্দু বিধি ও রীতি অনুসারে দরখাস্তকারী এবং দোলনের বিবাহ সম্পন্ন হয় নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে – বাড়ির কর্তা শ্রী সুকুমার হালদার, সনাতন নাগ, দোলনের মাসতুতো বোন অঞ্জলি বসাক, অমিয় সিংহ মহা পাত্র, নরজিত দাস এবং অন্যান্য। পুরোহিত শ্রী রাম চক্রবর্তী হিন্দু বিবাহের মন্ত্র পাঠ এবং অন্যান্য যাবতীয় পদ্ধতি মেনে বিবাহ সম্পন্ন করান। বিবাহের পর উক্ত বাড়িতেই স্বামী-স্ত্রী হিসাবে সেই রাত্রি অতিবাহিত করে দরখাস্তকারী ক্ষিতি এবং দোলন। পরের দিন দরখাস্তকারীর দাদা তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং জানান যে বিবাদী পঞ্চানন বসাক এই বিবাহ মেনে নিয়েছেন এবং দোলন বাড়ি ফিরে এলে কিছুদিনের মধ্যেই বিবাহের সামাজিক স্বীকৃতি স্বরূপ এক অনুষ্ঠানে আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবকে নিমন্ত্রণ করে প্রীতিভোজের আয়োজন করবেন। দরখাস্তকারী এবং দোলন বুঝতে পারেনি যে প্রকৃতপক্ষে সেই প্রস্তাব ছিল তাদেরকে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য বিবাদীর পাতা একটা ফাঁদ। যাই হোক, দাদা শ্রী অমরশঙ্করের কথায় ভরসা করে ভালো ভবিষ্যতের আশায় দরখাস্তকারী দোলনকে নিয়ে বিবাদীর বাড়িতে উপস্থিত হয়। বিবাদী পঞ্চানন বসাক সেখানে দরখাস্তকারীর সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেন। তাকে নিজের পড়াশুনায় মনোযোগ দিয়ে সফল হওয়ার উপদেশ দেন এবং তিনি যে অতি সত্বর বিবাহের সামাজিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন সে-ব্যাপারে তাকে আশ্বস্ত করেন। দরখাস্তকারীর বিশ্বাস হয় যে তিনি তাদের বিবাহ সম্পূর্ণরূপে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার ভুল ভেঙ্গে যায় এবং সে বুঝতে পারে যে তার স্ত্রীকে বেআইনিভাবে আটক করে রাখা হয়েছে, তাকে রীতিমতো মারধোর করা হচ্ছে যাতে তাদের অপছন্দের এই বিয়েটা সে অস্বীকার করতে বাধ্য হয়। কীভাবে দোলনের বাবামায়ের মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে তাকে একটা ঘরে তালাবন্ধ করে রেখে তার প্রতি নির্যাতন চলছে, তার বিবরণ সহ যে-চিঠিগুলি সে তার মামাতো বোন জলি এবং দরখাস্তকারীকে লিখেছে সেগুলি এই দরখাস্তের সঙ্গে (annexture B, C, D & E) যুক্ত করা হল।
৪। দরখাস্তকারী যথাসম্ভব চেষ্টা করেছে বিবাদীর সঙ্গে একটা শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় আসতে কিন্তু সে তার স্ত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। শারীরিক নির্যাতন ছাড়াও তাকে প্রতিনিয়ত শাসানো হচ্ছে এই বলে যে তাদের পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে তার আবার বিয়ে দেবে। সে তাতে রাজি না হলে তাকে প্রাণে মেরে ফেলা হবে।
৫। বর্তমান অবস্থা এমনই যে তা বিবাদী-কর্তৃক দরখাস্তকারীর পত্নীকে অন্যায় এবং বেআইনিভাবে আটক করা থেকে মুক্ত করতে এবং এই মামলার নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো তৃতীয় পক্ষের আশ্রয়ে তাকে রাখার ব্যবস্থা করতে আপনার হস্তক্ষেপ দাবি করছে, ধর্মাবতার।
In the circumstances aforesaid, your petitioner humbly prays that Your Lordship would graciously be pleased to order:-
- that a rule do issue calling upon the respondent to show cause why the wife of the petitioner, said Dolan alias Putul who is being illegally and improperly detained, should not be recovered from the custody of the Respondent and set at liberty,
- that the body of the said Dolan alias Putul be brought in, on the sheriffs’ return of Cope corpus to a writ of Attachments,
- that the said Dolan alias Putul be recovered from the custody of the Respondent and produced before this Hon’ble court to be dealt with according to Law,
- that upon hearing the cause shown and hearing the parties said Dolan alias Putul be set at liberty and live according to her choice,
- pass such order or orders as your Lordships may seem fit and proper.
And your petitioner as in duty bound shall ever pray.
Affidavit
(ক্রমশ)
